Monday 09 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উচ্ছ্বসিত পদ্মাপাড়ের মানুষ, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা


১০ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৫২ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২০ ১২:০৮
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পদ্মাসেতু প্রকল্প এলাকা ঘুরে এসে: অগ্রহায়ণের শেষার্ধের সকালটা ছিল হিমশীতল, কুয়াশায় ঢাকা। তবে সকাল থেকেই মানুষের পদচারণায় মুখর মাওয়া ঘাট। তাদের মধ্যে বড় একটি অংশই সংবাদকর্মী। হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্টে নাস্তা সেরে বোটে চড়ছেন একে একে সবাই। সবার গন্তব্য এবং লক্ষ্য এক— পদ্মাসেতু, যেখানে সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর বসছে এই সেতুর ৪১তম তথা শেষ স্প্যানটি। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে নৌপথে ঘণ্টা কয়েকের দূরত্ব— সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে যে স্বপ্নের পদ্মাসেতু দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে, সেই অবকাঠামোতে শেষ ফাঁকটুকু পূরণ করবে এই স্প্যান। দুই পার একাকার হয়ে মিলে যেতে আর এই একটি স্প্যানই যে বাকি। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি নিজ নিজ সংবাদমাধ্যমে প্রচারের দায়িত্ব নিয়েই তারা সবাই জড়ো হয়েছিলেন মাওয়া প্রান্তে।

বিজ্ঞাপন

কেবল গণমাধ্যমকর্মী অবশ্য নয়, ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকেই এসেছেন উৎসুক আরও অনেক মানুষ। যে স্প্যানটি মাওয়া-জাজিরার মিলন ঘটাবে, সেই স্প্যান বসানোর ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে চান তারাও। আর সে কারণেই বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) সকাল থেকেই লোকারণ্য মাওয়া ঘাট।

আরও পড়ুন-

বুধবার (৯ ডিসেম্বর) রাতেই পদ্মাসেতুর ৪১তম এই স্প্যানটি এনে রাখা হয় সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের কাছাকাছি। বৃহস্পতিবার কুয়াশার চাদর ভেদ করে বেলা যত বাড়তে থাকে, স্প্যানটি ততই এগিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের সামনে। ততক্ষণে কেবল মাওয়া ঘাট নয়, গোটা দেশের মানুষই টেলিভিশন আর অনলাইন গণমাধ্যমের কল্যাণে চোখ রেখেছে পদ্মাসেতুতে। যারা হাজির হয়েছেন মাওয়া প্রান্তে, বেলা বাড়তে থাকলে তারাও নৌকা-ট্রলারে করে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন সেতুর আরও একটু কাছে। সেখান থেকেই যে যার মতো করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভও করেছেন।

বেলা গড়িয়ে তখন দুপুর প্রায়। ঘড়ির কাঁটা তখন ১২টার দিকে ছুটছে। এরই মধ্যে স্প্যানটি উঠে গেছে দুই পিলারের ওপর। ঠিক ঠিক ১২টা ২ মিনিটে শেষ এই স্প্যান বসানোর কাজ শেষ। নদীর বুকের নৌকা-ট্রলারসহ মাওয়া ঘাটে জড়ো হওয়া জনতার চোখেমুখে উচ্ছ্বাস ও হর্ষধ্বনি। পদ্মার বুকে নৌকায় চড়ে এসেছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। তাদের হাতে হাতে ছিল জাতীয় পতাকা। বাঘের সাজে সারাবছর জাতীয় পতাকা হাতে গ্যালারি মাতিয়ে যান যে শোয়েব আলী, চিরচেনা রূপেই তিনিও হাজির পদ্মার বুকে। শেষ স্প্যানটি বসার সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সবার মুখের তখন আকণ্ঠবিস্তৃত হাসি। পূর্ণাঙ্গ পদ্মাসেতু চোখের সামনে বাস্তব রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় পদ্মাপাড়ের মানুষের মুখে তখন একটাই কথা— প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

নদীর মাঝে যেখানে সব শেষ স্প্যানটি বসানোর কাজটি চলছিল, নিরাপত্তার কারণে সেই জায়গা থেকে ন্যূনতম ৭০০ মিটার দূরে থাকার জন্যে সবাইকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর কাজটি ঠিক নদীর মাঝে হওয়ায় পদ্মাপাড়ের খুব কমসংখ্যক মানুষই সেখানে যেতে পেরেছেন। সংবাদকর্মীরাও যেন খুব কাছে না ভিড়তে পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে কড়া টহল দিচ্ছিল সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী। ইঞ্জিনচালিত নৌকা-ট্রলারে চড়ে গণমাধ্যমকর্মীরা শেষ স্প্যানটি বসানোর দৃশ্য ধারণ করে যাচ্ছিলেন। তাদের নৌকা-ট্রলারগুলো সেতুর কাছাকাছি যেতেই এগিয়ে আসছিলেন নিরাপত্তায় নিয়োজিতরা, সরিয়ে দিচ্ছিলেন সেতু থেকে আরও দূরে।

দুপুর ১২টার দিকে স্প্যানটি বসানোর পর নদীতে ভাসমান নৌকাগুলো থেকে হর্ষধ্বনি যেন থামছিলই না। এই প্রতিবেদক নিজেও ছিলেন একটি নৌকায়। পাশের একটি স্পিডবোটে দেখা গেল এক হাস্যোজ্জ্বল তরুণকে। পরিচয় জানতে চাইলে বললেন নাম রায়হান। বাড়ি শরীয়তপুর। তিনি একজন প্রবাসী। ছুটিতে দেশে এসেছিলেন, এর মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে আর ফিরতে পারেননি কর্মস্থলে। দেশেই যখন আছেন, পরিবার ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে পদ্মাসেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানোর স্মরণীয় মুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করতে এসেছিলেন।

রায়হান সারাবাংলাকে বলেন, আমরা অনেক আনন্দিত, আমরা অনেক খুশি। এই সেতুর ফলে পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের মেলবন্ধন ঘটেবে। যোগাযোগে আমাদের যে প্রতিবন্ধকতা, সবশেষ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করার পথের আরও একটি চ্যালেঞ্জ পূরণ হলো। আমরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ।

একই স্পিড বোটে ছিলেন গৃহিণী হোছনে আরা বেগম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমরা ব্রিজ দেখতে এসেছি। দেখে অনেক ভালো লেগেছে। কাজ দ্রুত শেষ হলে আমরা ব্রিজ দিয়েই চলাচল করতে পারব। তখন এই এলাকায় কাজকর্মও বাড়বে।

পাশের আরেক নৌকার যাত্রী আনিছুর রহমান নামের এক তরুণ বলেন, মনে হচ্ছে দ্রুতই আমাদের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। সব শেষ স্প্যানটিও সফলভাবে বসে গেছে। এ এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এ এক গৌরবের ক্ষণ। পদ্মাপাড়ের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ।

মাওয়া ঘাটে কথা হচ্ছিল চা-পানের দোকানি ষাটোর্ধ্ব হাসমতের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, এখানে একটি সেতু হবে— তা আমাদের অনেক দিনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। মাপজোখ, পিলারের পর স্প্যানের কাজ শেষ হলো। হয়তো দ্রুতই শেষ হবে অন্য কাজগুলোও। আমাদেরকে এই সেতু উপহার দেওয়ার জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।

পদ্মাসেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানোর কার্যক্রম পরিদর্শনে এসেছিলেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। সঙ্গে ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তাদের তিন জনই বলেছেন, এ এক আনন্দের ক্ষণ। এ এক উচ্ছ্বাসের ক্ষণ।

এমন মুহূর্তের সাক্ষী হওয়া প্রতিমন্ত্রীর কাছে অনুভূতি জানতে চান সাংবাদিকরা। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এই অনুভূতি কেউ ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। শুধু একটি কথায় বলা যায়— আমরা সমগ্র দেশবাসী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি আমাদের এই উচ্চতায় নিয়ে গেলেন সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে।’

একই স্থানে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, আমরা দক্ষিণবঙ্গের লোকজন এতদিন ভোগান্তির শিকার হয়েছি। নেত্রী দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে যে সুযোগ করে দিয়েছেন, এজন্য আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা চাই এভাবে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাবে। বিজয়ের মাসে আরেকটি বিজয়ের পথে আমরা এগিয়ে গেলাম।

আর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘পদ্মাসেতু আর স্বপ্ন নয়। দেশরত্ন শেখ হাসিনার চোখেই আমরা আমাদের স্বপ্ন দেখেছি এবং আজকে সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ আজকে লাভ করলো। পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে যে সেতুবন্ধন, সেটা আজকে তৈরি হলো।’

ধীরে ধীরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে থাকে। গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তখন সারাদেশের মানুষ জেনে গেছে— পদ্মাসেতুর মূল যে অবকাঠামো, সেটি পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়েছে। পদ্মার বুকে তখনো নৌকা-ট্রলার-স্পিড বোটে চড়ে সেতুটি প্রাণভরে দেখছেন অনেকেই। বাকিরা ধীরে ধীরে নদীর বুক ছেড়ে উঠে গেছেন মাওয়া ঘাটে। ধীরে ধীরে ফেরার পথ ধরতে হবে। কেউ কেউ ততক্ষণে রওনাও হয়ে গেছেন নিজ নিজ গন্তব্যে। সকালের কোলাহল কমতে শুরু করেছে তখন ঘাটে। ফিরতি পথের পথিক যারা, সবার চোখেমুখেই তখন এক প্রশান্তি। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ, প্রমত্তা পদ্মার গড়নের কারণে প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জসহ হাজারও প্রতিবন্ধকতাকে দলে-মথে স্বনির্ভর বাংলাদেশের প্রতীক হয়ে ওঠা পদ্মার পূর্ণাঙ্গতা লাভের এক গৌরবজ্জ্বল মুহূর্তের সাক্ষী যে হয়েছেন তারা!

৪১তম স্প্যান টপ নিউজ পদ্মাসেতু মাওয়া ঘাট শেষ স্প্যান স্প্যান বসানোর মুহূর্ত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর