বিজ্ঞাপন

পদ্মাসেতুর আদ্যোপান্ত

December 10, 2020 | 8:54 pm

সাব্বির আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতুর মাধ্যমে দেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ও পূর্বাঞ্চলের সরাসরি সড়কপথে সংযুক্ত হয়। তখন যমুনা সেতু ছিল বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ সেতু। ঠিক এরপরই পদ্মা নদীতেও সেতু নির্মাণের দাবি ওঠে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলা তখনো রাজধানী ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বলতে গেলে ছিল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সেই দাবিটি তাই ছিল যৌক্তিক। কিন্তু তাহলেও কি বললেই পদ্মায় সেতু করা যায়? প্রমত্ত পদ্মাকে বাগে এনে তার বুকে প্রায় ছয় কিলোমিটারের একটি সেতু অবকাঠামো নির্মাণ তো সোজা কথা নয়!

বিজ্ঞাপন

সঙ্গত কারণেই একদিকে যখন দেশের একটি বড় অংশের জনপদের মানুষের স্বপ্নের কল্পনায় ছিল পদ্মাসেতু, তেমনি এটি বাস্তবায়ন নিয়েও ছিল দীর্ঘ জল্পনা-কল্পনা। এরপর সেতুটি নির্মাণের উদ্যোগ নিলে তাতেও বাধা-বিপত্তি কম আসেনি। বিশ্বব্যাংক থেকে উঠেছিল দুর্নীতির অভিযোগ। পদ্মাসেতুর অর্থায়ন নিয়ে তৈরি হয়েছিল অনিশ্চয়তা।

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে একের পর এক পিলার। তারপর সেসব পিলারের ওপর একে একে বসেছে একেকটি করে স্প্যান। স্বপ্নের সেতুর বাস্তবায়নও এগিয়েছে একটু একটু করে। সবশেষ ৪১তম স্প্যানটি বসে যাওয়ার পর কোটি মানুষের সেই স্বপ্নের সেতুটি আজ (বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর) পেল পূর্ণাঙ্গ সেতুর রূপ। পদ্মার এপার-ওপারের মধ্যেকার সেই সংযোগটি দুই পারকে এনে দিয়েছে মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্বে। ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পূর্ণাঙ্গ পদ্মাসেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, এক নিরেট বাস্তবতা।

আরও পড়ুন-

বিজ্ঞাপন

শুরু থেকে আজকের দিন পর্যন্ত পদ্মাসেতু নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুটি উদ্বোধন হলো ১৯৯৮ সালে। তখন ক্ষমতায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। ওই সরকারের আমলেই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় সেতুটির। পরবর্তী সময়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে সেতুটির সমীক্ষা কাজ শেষ হয়। ওই সময়ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়, এপারের মাওয়া আর ওপারের জাজিরাকে সংযুক্ত করবে পদ্মাসেতু।

বিএনপির বিদায়ের পর ওয়ান-ইলেভেনখ্যাত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে ক্ষমতায়। তাদের সময়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এই সেতু নির্মাণের প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। সেতু নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণের কাজও হয় ওই সময়। পরবর্তী সময়ে সেতু নির্মাণের মূল চ্যালেঞ্জটি মূলত গ্রহণ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ছয় বছরের কর্মযজ্ঞে সেতুটি এখন বাস্তব রূপ নিয়েছে। মূল অবকাঠামো নির্মাণ শেষে এখন সেতুর বুকে সড়ক ও রেলপথ নির্মাণের কাজ বাকি থাকছে। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি বলছে, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা আওয়ামী লীগ সরকারই সেতুটির উদ্বোধনও করবে।

বিজ্ঞাপন

সময়ের হিসাব বলছে, আগে থেকেই দাবি থাকলেও ১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু উদ্বোধন হওয়ার পর পদ্মাসেতুর দাবি প্রবল হয়ে ওঠে। পরের বছর ১৯৯৯ সালে একটি প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মধ্যদিয়ে পদ্মাসেতুর পরিকল্পনা প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিস্তারিত সমীক্ষা পরিচালনার অর্থ সংগ্রহের জন্য সেতু বিভাগ থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সম্ভাব্যতা সমীক্ষার অর্থায়নের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান দূতাবাসে চিঠি দেয়। ২০০১ সালের জুন মাসে জাপান সরকার ইআরডি’র প্রস্তাবে রাজি হয়। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে তারিখে বাংলাদেশ ও জাপান সরকারের মধ্যে পদ্মাসেতুর জন্য সমীক্ষার চুক্তি সই হয়। সমীক্ষা প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৫২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে ২০০১ সালের জুলাই মাসে মাওয়া প্রান্তে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে জয় পেয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। তাদের সময়ে এগিয়ে যায় পদ্মাসেতুর সমীক্ষার কাজ। এরপর ২০০৩ থেকে ২০০৫ সালে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্ট এবং দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে শরিয়তপুর জেলার জাজিরা পয়েন্টকে সেতুর দুই প্রান্ত নির্বাচন করে। ২০০৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেতুর অ্যালাইনমেন্ট সামান্য পরিবর্তন করে পদ্মাসেতুর মাওয়া-জাজিরা সাইট অনুমোদন করেন। এরপর ২০০৫ সালের মার্চ মাসে সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হলে প্রকল্পটি কারিগরি ও অর্থনৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়।

বিজ্ঞাপন

২০০৬ সালে এক-এগারো পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। তাদের দুই বছরের মেয়াদে পদ্মাসেতুর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প (ভূমি অধিগ্রহণ) অধ্যাদেশ, ২০০৭ জারি হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহম্মদ পদ্মাসেতু প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন করেন।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। এ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের ১৩ দিনের মাথায় ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি সেতুর নকশা প্রণয়ণে পরামর্শক  নিয়াগ প্রস্তাব অনুমোদন পায়। যুক্তরাষ্ট্র-নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান MAUNSEL-AECOM-এর সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কাজ শুরু করে। তারা ১৮ মাসের মধ্যে সেতুর বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন, প্রি-কোয়ালিফিকেশন ডক্যুমেন্ট ও মূল টেন্ডার ডক্যুমেন্ট প্রণয়ন ও পরিচালনা করে।

ওই সময় পদ্মাসেতুতে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। সেতু বিভাগের নিজস্ব প্রকৌশলী এবং সড়ক ও জনপথ অধিদফতর থেকে অভিজ্ঞ কিছু প্রকৌশলী পদ্মাসেতু প্রকল্পে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেতুর গুরুত্ব ও ব্যাপকতার কারণে কাজ তদারকি ও পরামর্শের জন্য দেশি-বিদেশী ১১ জন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠন করা হয় এক্সপার্ট প্যানেল। ওই প্যানেলের প্রধান ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও বিশেষজ্ঞ প্রয়াত অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী।

ওই সময় পদ্মাসেতুর চার লেনের সড়কপথের নকশা ডেনমার্কের একটি সেতুর আদলে ডাবল-ডেক করার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। এই নকশায় ওপরে রয়েছে চার লেন সড়ক পথম নিচে সিংগেল লাইন রেলপথ। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পদ্মাসেতুর সংশোধিত ডিপিপি একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। নতুন নকশা অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।

ওই বছরই বিশ্বব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ যায়। অভিযোগের তীর তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। এসময় বিশ্বব্যাংকে ফেরাতে সরকার প্রায় দেড় বছর বছর চেষ্টা চালায়। এজন্য বিশ্বব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী তখনকার সেতু সচিব ও একজন প্রকৌশলীকে দুনীতি দমন কমিশনের (দুদক) নালিশে কারাগারেও নেওয়া হয়। মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় সৈয়দ আবুল হোসেনকে।

বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে তোলা দুর্নীতির অভিযোগের সুরাহা সহজে হয়নি। উল্টো এই অভিযোগের কারণে আটকে যায় পদ্মাসেতু নির্মাণ প্রকল্প। ২০১২ সালের জুনে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে দেয়। তারপরও বিশ্বব্যাংকে ফেরাতে সরকার তাদের সব শর্ত মেনে যেতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন না করার বিষয়ে একেবারেই অনড় থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নেন, নিজস্ব অর্থায়নেই হবে পদ্মাসেতু। তবে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের সেই মামলাটিও কানাডার আদালতে প্রমাণ না হওয়ায় খারিজ করে দেওয়া হয়। পদ্মাসেতুকে ঘিরে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ থেকেও মুক্তি পায় বাংলাদেশ।

সেটা ২০১৩ সালের শুরুর দিকের কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা তখন গোটা বাংলাদেশকে এক নতুন পথ দেখায়। এরকম একটি মেগা প্রকল্প বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করবে— এ কথা তখনো দেশের মানুষের কল্পনাতেও আসেনি। প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদ তো বটেই, অর্থনীতিবিদদের অনেকেও তখন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে পাত্তা দিতে চাননি। তবে সবার সব সমালোচনা উপেক্ষা করেই অনড় ছিলেন শেখ হাসিনা। নিজের অবস্থান থেকে একচুলও সরে আসেননি। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ পরে মিথ্যা প্রমাণিত হলেও শেষ পর্যন্ত দেশের জনগণের টাকাতেই জনগণের এই প্রকল্প নির্মাণের মহাযজ্ঞ শুরু করেন তিনি।

২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন হয়। প্রমত্ত পদ্মাকে বাগে এনে একে একে নদীর বুকের বসতে থাকে পিলার। পিলারগুলো বসতে থাকার পাশাপাশি চলছিল স্প্যান তৈরির কাজ। শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর প্রথম স্প্যানটি বসলে পদ্মার বুকে সড়কপথের প্রথম দেড়শ মিটার দৃশ্যমান হয়। এরপর দেখতে দেখতে তিনটি বছর ধরে মোট ৪২টি পিলার বসেছে, তাতে এখন বসেছে ৪১টি স্প্যান। সব সমালোচককে উচিত জবাব দিয়ে পদ্মাসেতুর পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো আজ দৃশ্যমান।

আরও আগেই পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। কিন্তু এত বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অবকাঠামোগত নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে। তাতে করে পাঁচ দফায় ব্যয় বেড়ে পদ্মাসেতু নির্মাণের খরচ গিয়ে ঠেকেছে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকায়। এর মধ্যে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে গিয়েও সময় বেড়েছে। এখন সরকারের পরিকল্পনা, আজ শেষ স্প্যান বসার পর একবছরের মধ্যে, তথা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সেতুটি উন্মুক্ত হবে জনগণের জন্য। অর্থাৎ আর একবছরের মধ্যেই দেশের বৃহত্তম অবকাঠামোটি জনগণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়বে।

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন