ঘোড়াঘাটের মতো পরিণতি হবে, আলফাডাঙ্গার ইউএনওকে হুমকি
১১ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:৪৮
ফরিদপুর: সন্ত্রাসী হামলায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের যে অবস্থা হয়েছিল, সেই একই অবস্থা হবে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার ইউএনও তৌহিদ এলাহীর— মোবাইল ফোনে এভাবে হুমকি দিয়েছেন ঢাকায় কর্মরত এক সাংবাদিক। আলফাডাঙ্গার কুচিয়াগ্রামে সরকারি খাসখতিয়ানভুক্ত জমিতে গরিব-দুঃস্থ মানুষদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্যোগ নিলে দৈনিক সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি শরিফুল ইসলাম ইউএনও তৌহিদ এলাহীকে এ হুমকি দেন।
ইউএনও তৌহিদ এলাহী জানিয়েছেন, খাসভুক্ত ওই জমির কিছু অংশ শরিফুল ইসলাম ও তার বাবা সাবেক ইউপি সদস্য মশিউর রহমান অবৈধভাবে ভোগদখলে রেখেছেন। আশ্রয়ণ প্রকল্প হলে তাদের দখলে থাকা খাসজমি হাতছাড়া হয়ে যাবে— এ আশঙ্কায় নিজের পরিচয় দিয়ে ইউএনওকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন শরিফুল ইসলাম।
হুমকিদাতা ইঙ্গিত দিয়েছেন, এ প্রকল্পের কাজ চলতে থাকলে তার (ইউএনও) অবস্থা হবে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মতো। হুমকির পাশাপাশি ইউএনও’র ক্যারিয়ার ধ্বংস, ঝাড়ু মিছিলসহ বিভাগীয় মামলা (ডিপি) চালু করার হুমকি দেওয়া হয়।
দৈনিক সমকালের সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম সচিবালয় বিটে কর্মরত। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, অনেক সিনিয়র সচিব, যুগ্ম সচিব, সহকারী সচিব তার পরিচিত। ইউএনও যে কর্মস্থলে যাবেন সেখানেই তাকে দেখে নেওয়া হবে। হুমকির বিষয়টি জানিয়ে জেলা প্রশাসক অতুল সরকার, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ কে এম জাহিদুুল ইসলাম (জাহিদ) ও দৈনিক সমকালের সম্পাদকের কাছে চিঠি দিয়েছেন তৌহিদ এলাহী।
গত মঙ্গলবার (৭ ডিসেম্বর) দুপুরে ইউএনও’র সরকারি মোবাইল ফোনে কল করে এ সব হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় বুধবার (৮ ডিসেম্বর) আলফাডাঙ্গা থানায় সাধারণ ডায়েরির (জিডি) করেছেন ইউএনও তৌহিদ। বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) জিডিটি গ্রহণ করেছেন থানার ওসি। ডিডি নম্বর- ৪৩০।
ইউএনও তৌহিদ এলাহী সারাবাংলাকে জানান, কুচিয়াগ্রাম মৌজায় ২০০- ৩০০ একর জমি খাস আছে। সেখান থেকে মাত্র ১ একর ৪০ শতাংশ জমি নিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। ওই প্রকল্পের অধীনে খাস জমিতে ৫০-৬০টি পাকা ঘর নির্মাণ করা হবে। এর মাধ্যমে অন্তত ২০০ থেকে ২৫০ জন দুঃস্থ-গরীব মানুষ ভালো পরিবেশে বসবাসের সুবিধা পাবেন।
ইউএনও জানান, দেড় মাস আগে থেকেই তিনি আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শরিফুল বাধা দেওয়ায় তিনি এখনও কাজ শুরু করতে পারেননি।
ইউএনও দাবি করেন, সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম ও তার বাবা স্থানীয়দের ভুল বোঝাচ্ছেন। এলাকাবাসীর সব জায়গা সরকার অধিগ্রহণ করে নেবে এরকম গুজবও তারা ছড়াচ্ছে।
ইউএনও সারাবাংলাকে বলেন, ‘আশ্রয়ণপ্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর একটি। এর মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী বাসস্থানের মৌলিক সুবিধা পাবেন। এর ফলে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন হবে। আশ্রয়ণপ্রকল্পে যেতে এরইমধ্যে ৩৫০ জন আবেদন করেছে। আমরা যাচাই-বাছাই করে তাদের জন্য ঘর বরাদ্দ দিতে চাই।’
কিন্তু শরিফুল ইসলাম সরকারি খাসজমিতে (জেলা প্রশাসকের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত এসএ-রেকর্ড দাগ নম্বর ১৫৭৫ ও বিএস রেকর্ড দাগ নম্বর-৪৯০) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গৃহীত আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য ঘরের কাজ বন্ধ করার হুমকি দেন। প্রকল্পভুক্ত জমি এস এ ও বিএস দু’টি রেকর্ডেই খাস জানানোর পরও তিনি ইউএনওকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন।
ইউএনও চিঠিতে উল্লেখ করেন, শরিফুল কুচিয়াগ্রামের সাড়ে ৫৪ শতাংশ সরকারি খাসজমিতে অবৈধভাবে বাসভবন নির্মাণ করেছেণ। এর বাইরে তিনি ও তার বাবা মশিউর রহমান এ এলাকার বিপুল খাসজমি অবৈধভাবে ভোগ-দখল করছেন। সরকারি নিষ্কণ্টক খাস কৃষিজমিতে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ করতে গেলে ইউএনও, এসি ল্যান্ডসহ দু’জন সরকারি লোককে হুমকি দেন শরিফুল ও তার বাবা মশিউর।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আসলাম মোল্লা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় আলফাডাঙ্গা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ কে এম জাহিদুল হাসান (জাহিদ), আলফাডাঙ্গা পৌর মেয়র সাইফুর রহমান (সাইফার), আলফাডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এ কে এম আহাদুল হাসান উপস্থিত ছিলেন।
অভিযোগ অনুযায়ী জানা যায়, ওই সাংবাদিক আলফাডাঙ্গার ইউএনওকে বলেছেন, ‘মি. ইউএনও, দিস ইজ নট ইওর লাস্ট স্টেশন। মি. ইউএনও, আপনি বড় অফিসার হয়ে গেছেন। অনেক বড় বড় অফিসার দেখেছি।… আপনি আলফাডাঙ্গায় কয়দিন থাকবেন সেটাও আমি দেখছি। আলফাডাঙ্গায় আপনার চাকরির লাস্ট স্টেশন নয়। অনেকদূর যেতে হবে মি. ইউএনও। আপনি যে স্টেশনে যাবেন, সেই স্টেশনেই দেখা হবে। কালকে ঝাড়ু মিছিল হবে আপনার বিরুদ্ধে।’
ইউএনওকে তিনি বলেন, ‘দিনাজপুরে ইউএনওর যে অবস্থা হয়েছিল, আপনি যদি এগুলো করেন, আপনার সেই অবস্থা হবে (গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে নিজ ঘরে দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছিলেন ঘোড়াঘাট ইউএনও ওয়াহিদা খানম)।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শরিফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইউএনওর সঙ্গে আমার তেমন কিছু হয়নি। তারা জিনিসটাকে কেন বড় করছে? মানুষকে হয়রানি করার জন্য এ সব করা হচ্ছে।’
ঘোড়াঘাট ইউএনও’র প্রসঙ্গ তুলে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওই সাংবাদিক বলেন, ‘না, আমি এরকম কিছু বলিনি। ইউএনও নিজের সেফটির জন্য এ সব করছে। প্রশাসনের এরকম আচরণের কারণে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। ইনটেনশনালি এ সব করা হচ্ছে।’
তিনি দাবি করে বলেন, ‘যে জমির কথা বলা হচ্ছে, তা নদীভাঙন কবলিত মানুষদের জমি। তারা ভোগদখল করে খাচ্ছে। জায়গাটি তাদের বাপদাদার। সেই জায়গায় তারা বাড়ি করছে। কিন্তু হাল রেকর্ডে ওই জমি খাস হয়ে গেছে। ইউএনও কিন্তু হাফ কিলোমিটার দূরে গেলেই হয়। সেখানে উঁচু জায়গায় জমি আছে। কিন্তু তা না করে ইউএনও সব তুলে দিতে চায়। মোবাইল কোর্টের হুমকি দিচ্ছে, রশি দিয়ে ধরে নিয়ে যাবে। এটি কোনো ইউএনওর আচরণ হতে পারে?’
শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ইউএনও’র কথাবার্তায় খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। পরে অবশ্য আমি ১০ মিনিট পর তাকে ফোন করেছিলাম। তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিলাম। ইউএনওর বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীর সচিবকে জানাই। সচিব ডিসিকে বলেছে।’ ডিসি রেভিনিউ জমিতে গিয়ে বলেছেন, ইউএনও যে কাজ করেছে তা অন্যায় করেছে— দাবি করেন শরিফুল।
এ বিষয়ে আলফাডাঙ্গা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ কে এম জাহিদুল হাসান (জাহিদ) বলেন, ‘সরকারি খাস জায়গায় আশ্রয়ণ প্রকল্প হচ্ছে সেটি প্রশংসা পাওয়ার মতো উদ্যোগ। ইউএনও এমন জায়গা চিহ্নিত করেছেন সেখানে কলাগাছ আছে, জমিগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। ইউএনও’র সিদ্ধান্ত ন্যায়সঙ্গত।’
‘ওই সাংবাদিক যেভাবে কথা বলেছেন তা কোনো ভাষা হতে পারে না। বিষয়টি খুবই বেদনার। ইউএনও তৌহিদ এলাহীর কাজের গতি-ধরণ দেখে আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। এক কথায় তার বিচার আছে। ইউএনও যে কাজ করেছে তাতে একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাদের সমর্থন আছে,’— বলেন তিনি।
উপজেলা চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘ওই খাসজমিতে এডিসি রেভিনিউ মোহাম্মদ আসলাম মোল্লা গিয়েছিলেন। সেখানে ইউএনওর অন্যায় কিছু পাওয়া যায়নি।’
আলফাডাঙ্গা পৌর মেয়র সাইফুর রহমান (সাইফার) বলেন, ‘ওই সরকারি জায়গায় গরিবদের জন্য আবাসন প্রকল্প হচ্ছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প। এটি যেহেতু গরিব মানুষদের জন্য হবে। ইউএনও ভালো জিনিস করছেন। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন আমাদের সহযোগিতা পাবে।’
এ দিকে ফরিদপুর জেলা প্রশাসক অতুল সরকার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আসলাম মোল্লার বক্তব্য জানতে তাদের মোবাইল ফোনে একাধিকার কল করা হলেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।