আনুশকার বয়স বাড়িয়ে দিহানের শাস্তি কমানোর ‘অপতৎপরতা’!
৯ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:৩২
ঢাকা: ধর্ষণের পর হত্যার শিকার মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নুর আমিনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে নিজ জেলা কুষ্টিয়ায়। সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে আনুশকার বাবা-মা অভিযোগ করেছেন, মেয়ের বয়স নিয়ে পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের বিড়ম্বনায় ফেলেছে। পাসপোর্ট ও জন্মসনদ অনুযায়ী আনুশকার বয়স ১৭। মামলা দুর্বল করতে বয়স ১৯ লেখা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো- বয়স ১৯ করা গেলেই কি মুক্তি মিলবে ইফতেখার ফারদিন দিহানের? না বয়স ১৯ হলেও সর্বোচ্চ শাস্তিই ভোগ করতে হবে ধর্ষককে?
এদিকে সুরতহাল রিপোর্টে আনুশকা নুর আমিনের বয়স জানতে চেয়েছে পুলিশ। এ বিষয়ে শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ আনুশকার মৃতদেহের ময়নাতদন্ত শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ সুরতহাল রিপোর্টে বয়স জানতে চেয়েছে। সে কারণে মেয়েটির মরদেহ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এক্সরে করতে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে এক্সরে করা সম্ভব হয়নি। ওইদিন এক্সরে ছাড়াই মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। তবে তার শরীরের গঠন ও দাঁত দেখে বয়স নির্ধারণ করা হবে।’
ওইদিন ডা. সোহেল মাহমুদ আরও বলেন, ‘মাস্টারমাইন্ডের শিক্ষার্থী আনুশকা নুর আমিনের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। মেয়েটি বিকৃত ও কুরুচিপূর্ণ যৌনাচারের শিকার হয়েছিলেন। এ কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ থেকে তার মৃত্যু হয়।’
তিনি জানান, মেয়েটির শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাকে চেতনানাশক কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কিনা, তা জানতে প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। একাধিক ব্যক্তি এ ঘটনায় জড়িত কিনা, তা জানতে ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করা হয়েছে। মেয়েটির ভিসেরাও সংগ্রহ করা হয়েছে।
ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) আটক প্রধান অভিযুক্ত দিহান (১৮) আনুশকাকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করে পুলিশকে জানায়, ধর্ষণের পরিকল্পনা আগেই করা ছিল। বন্ধু হলেও দুজনের প্রেমের সম্পর্ক বেশিদিন হয়নি। মাত্র তিন মাস হলো তাদের মধ্যে সম্পর্ক বয়স। গ্রুপ স্টাডির নাম করে আনুশকাকে ফোন করে কলাবাগান লেক সার্কাসের একটি বাসায় ডেকে নেয় সে। দুপুর ১২টা থেকে একটার মধ্যে জোরপূর্বক আনুশকাকে ধর্ষণ করে দিহান। দুপুর একটার দিকে আনুশকার রক্তক্ষরণ বন্ধ না হলে অচেতন হয়ে পড়ে। এরপর তাকে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় ওইদিন চারজনকে আটক করে পুলিশ। ধর্ষণকারী একজন নাকি চারজন?— জানতে চাইলে কলাবাগান থানা পুলিশ জানায়, দিহান জানিয়েছে সে একাই ধর্ষণ করেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে খবর পেয়ে বাকিরা এসেছে। পুলিশ দিহানকে গ্রেফতার দেখিয়েছে। বাকি তিনজনকে থানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
- আনুশকাকে ধর্ষণ পূর্বপরিকল্পিত— জিজ্ঞাসাবাদে দিহান
- মাস্টারমাইন্ড শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর হত্যা, ৪ সহপাঠী আটক
- মাস্টারমাইন্ডের ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা: দিহানের দোষ স্বীকার
- ধর্ষণের পর হত্যায় দিহানের দোষ স্বীকার, পাঠানো হলো কারাগারে
- ‘আনুশকা ধর্ষণের শিকার কিনা তা ফরেনসিক পরীক্ষায় জানা যাবে’
- বিকৃত যৌনাচারের শিকার ছিলেন আনুশকা, রক্তক্ষরণে মৃত্যু: ফরেনসিক
ঘটনার দিন রাতেই রাজধানীর কলাবাগান থানায় একটি মামলা করেছেন আনুশকার বাবা আল-আমিন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ এর ২ ধারায় দায়েরকৃত মামলার একমাত্র আসামি দিহান। ৯ এর ১ ধারায় ভুক্তভোগীর বয়সের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও ২ ধারায় ভুক্তভোগীর বয়সের কোনো বিষয় উল্লেখ নেই। ২ ধারায় বলা আছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে [ধর্ষণের শিকার] নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’
এ বিষয়ে নিম্ম আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মীর আলমগীর হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসামি ইফতেখার ফারদিন দিহানের (১৮) বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধনী২০০৩) এর ধারা ৯(২) ধারায় যে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে তা প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ওই ধারাতে অভিযুক্ত আসামিকে আরও এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। আর যদি অভিযোগ প্রমাণিত না হয় তাহলে তাকে বেকসুর খালাস দেওয়ার বিধানও রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘তবে মামলাতে ধর্ষণ বিষয়টি প্রমাণিত না হলেও যেহেতু খুন হয়েছে তার বিরুদ্ধে আদালতে চাইলে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনের ৩০৪ ধারায় বিচার পরিচালনা করতে পারেন। এক্ষেত্রে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ও বাদীর বক্তব্য বিবেচনা করবেন। আদালত চাইলে ট্রাইব্যুনাল থেকে মামলাটি বদলি করে দণ্ডবিধি আইনে বিচার হতে পারেন। তখন প্রমাণ সাপেক্ষে বিচারক সিদ্ধান্ত নেবেন তার সাজা কী হবে।’
সংশ্লিষ্ট আদালতের বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর আজাদ রহমান সারাবাংলাকে জানান, ‘যদি কোনো অপ্রাপ্ত নারীকে ধর্ষণ করে প্রমাণ সাপেক্ষে ধর্ষককে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেবেন ট্রাইব্যুনাল। যেহেতু শিক্ষার্থী হত্যা হয়েছে, ধর্ষণ প্রমানিত না হলেও দণ্ডবিধি আইনের ৩০৪ ধারায় নরহত্যা অভিযোগে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
আইন যা বলছে
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধনী২০০৩) এর ৯ ধারায় ধর্ষণ বলতে আইনে যা বলছে- ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ১৬ বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ১৬ বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।’
ধর্ষণের শাস্তি
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারায় শাস্তির যেসব বিধান উল্লেখ রয়েছে-
ধারা ৯(১): কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
ধারা ৯(২): ধর্ষণের ফলে বা অন্য কোনো কাজের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষণকারীকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। এছাড়াও তাকে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
ধারা ৯(৩): একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে এবং ধর্ষণের কারণে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে তাহলে ধর্ষকরা প্রত্যেকেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এছাড়াও তাদের সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
ধারা ৯(৪): যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে
(ক) ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
(খ) যদি ধর্ষণের চেষ্টা করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধি আইনের ৩৭৫ ধারা
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনের ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা কথা বলা হয়েছে। উক্ত ধারায় ধর্ষণ বলতে বুঝানো হয়েছে-
১ম: যেকোনো মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে
২য়: মেয়ের অনুমতি ছাড়া
৩য়: মৃত্যুভয়ে বা আঘাত দেওয়ার কারণে সম্মতি নিয়ে
৪র্থ: সম্মতিতে, যখন মেয়েটিকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ছেলেটি সম্মতি আদায় করে ছেলেটি জানে ভবিষ্যতে সে মেয়েটিকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করবে না
৫ম: তার সম্মতি বা সম্মতি ছাড়া, যখন ভিক্টিমের বয়স চৌদ্দ বছরের নিচে হয়।
৩৭৬ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি
যদি কোনো নারীকে ধর্ষণ করে, আর যদি আদালতে প্রমাণিত হয় তাহলে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন, ১০ বছর সশ্রম/বিনাশ্রম কারাদ্ণ্ড এবং অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে।
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড (সংশোধিত আইন)
এদিকে ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০২০’ পাস হয়। ২০০০ সালের ৮নম্বর আইন (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন) সংশোধনে জারি করা অধ্যাদেশের আলোকে সংসদে উত্থাপিত বিলে বলা হয়, ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে।
আগের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। গতবছর বেশকয়েকটি আলোচিত ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনায় দেশজুড়ে ধর্ষণ-নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি জানান। তারই ধারাবাহিকতায় সরকার আইনটি সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আইনটি এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। ফলে মেয়ের বয়স ১৯ দেখিয়ে দিহানের সর্বোচ্চ শাস্তি কমানোর পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ আনুশকার বাবা-মায়ের।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত ৭ জানুয়ারি সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টার দিকে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা মা কর্মস্থলের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে যান। এর এক ঘণ্টা পরে তার বাবাও ব্যবসায়িক কাজে বাসা থেকে বের হন। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ওই শিক্ষার্থী তার মাকে ফোন করে কোচিং থেকে পড়ালেখার পেপার্স আনার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন।
মামলার একমাত্র আসামি ‘ও’ লেভেল পড়ুয়া শিক্ষার্থী দুপুর আনুমানিক ১টা ১৮ মিনিটে ফোন করে ওই শিক্ষার্থীর মাকে জানান, মেয়েটি তার বাসায় গিয়েছিলেন। হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ায় তাকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়েছে। অফিস থেকে বের হয়ে আনুমানিক দুপুর ১টা ৫২ মিনিটে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মা হাসপাতালে পৌঁছেন। হাসপাতালের কর্মচারীদের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, আসামি তার কলাবাগান ডলফিন গলির বাসায় ডেকে নিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে অচেতন হয়ে পড়লে বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আসামি নিজেই তাকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে যান।
‘ও’ লেভেল আনুশকা নুর আমিন ইফতেখার ফারদিন দিহান বয়স মাস্টারমাইন্ড স্কুল মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবন শাস্তি শিক্ষার্থী