‘খুনের ৫ দিন পর মুছার দেওয়া বিকাশ নম্বরে গেছে ৩ লাখ টাকা’
২৫ মে ২০২১ ১৮:৩৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় সাক্ষী হিসেবে মোকলেসুর রহমান ইরাদ নামে একজন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। ইরাদ বাবুল আক্তারের পূর্বপরিচিত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মিতুকে খুনের ঘটনায় ‘কিলিং মিশনের প্রধান’ হিসেবে অভিযুক্ত মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুছার দেওয়া বিকাশ নম্বরে হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর ইরাদ তিন লাখ পাঠানোর কথা জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন।
মঙ্গলবার (২৫ মে) দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মো. শফী উদ্দিনের আদালতে জবানবন্দি দেন মোকলেসুর রহমান ইরাদ।
জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) চট্টগ্রাম মহানগরের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাক্ষী হিসেবে মোকলেসুর রহমান ইরাদ জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি সাইফুল হকের স্টাফ। সাইফুল হক আবার বাবুল আক্তারের ব্যবসায়িক পার্টনার। ইরাদ বিকাশে টাকা পাঠানোর কথা জানিয়েছেন।’
মিতু হত্যা নিয়ে আরও খবর-
- মিতু হত্যা মামলার আসামি সাক্কু রিমান্ডে
- মিতু হত্যা মামলার আসামি সাক্কু গ্রেফতার
- স্ত্রী হত্যায় অভিযুক্ত সাবেক এসপি বাবুল রিমান্ডে
- সেই মুসাকে এখন ‘চিনতে পেরেছেন’ বাবুল আক্তার
- মিতু হত্যায় স্বামী এসপি বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ
- মিতু হত্যায় স্বামী বাবুলকে আসামি করে ৫ বছর পর মামলা
- মিতু হত্যা: আরেক আসামিকে গ্রেফতার দেখানোর আবেদন
- মিতু হত্যা: ওয়াসিম-আনোয়ারকে গ্রেফতার দেখানোর অনুমতি
ইরাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাইফুল হকের নির্দেশে হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর মুছার দেওয়া একটি বিকাশ নম্বরে ইরাদ মোট তিন লাখ টাকা পাঠান। পাবনায় সাইফুল হকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ইরাদও পাবনার বাসিন্দা।
এর আগে, গত ১১ মে সাইফুল হক ও গাজী আল মামুন নামে দু’জন ব্যক্তি মিতু হত্যায় দায়ের হওয়া আগের মামলায় একই আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। বাবুল আক্তারের পূর্বপরিচিত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এবং ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হক জবানবন্দিতে জানিয়েছিলেন, মিতু হত্যার তিন দিন পর তিনি বাবুল আক্তারের নির্দেশে গাজী আল মামুনের মাধ্যমে মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসার কাছে তিন লাখ টাকা পাঠান। গাজী আল মামুন সেই মুসার আত্মীয়। মামুনও জবানবন্দি দিয়ে টাকা লেনদেনের বিষয়টি স্বীকার করেন।
পিবিআই জানিয়েছিল, বাবুল আক্তারের ঘনিষ্ঠজনের জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের পর টাকা লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পরই পিবিআই নিশ্চিত হয়, মিতুকে হত্যার জন্যই মূলত এই তিন লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় এটি ছিল একটি কন্ট্রাক্ট কিলিং। মূলত বাবুল আক্তারই টাকা পাঠানোর জন্য সাইফুলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
পিবিআই, চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান সেদিন বলেছিলেন, ‘সাইফুল হকের মাধ্যমে বাবুল আক্তারই তিন লাখ টাকা পাঠায়। সাইফুল মুসার আত্মীয় গাজী আল মামুনের মাধ্যমে এ বিষয়ে মুসার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিকাশের মাধ্যমে এই টাকা লেনদেন হয়েছে। বিকাশের লেনদেনের স্লিপ আমরা উদ্ধার করেছি। আমরা তদন্তে এটা নিশ্চিত হয়েছি যে হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তার তার পূর্বের কমিটমেন্ট (প্রতিশ্রুতি) অনুযায়ী টাকাগুলো মুসার কাছে পাঠিয়েছে।’
১২ মে সকালে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারও এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, সাইফুল ও মামুনের জবানবন্দির পরই মূলত বাবুল আক্তারের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ওই বছরের আগস্টে বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
হত্যাকাণ্ডের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে মিতুর বাবার মোশাররফ হোসেন প্রথম এই খুনে বাবুলের জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বাবুল যা করেছেন সবটাই ছিল তার অভিনয়।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাত ঘুরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলার তদন্তভার পড়ে পিবিআইয়ের ওপর। এরপর আস্তে আস্তে জট খুলতে থাকে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী চাঞ্চল্যকর এই মামলার। গত ১১ মে বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। তদন্তে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের লক্ষ্যে ১২ মে ওই মামলার ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয় পিবিআই।
এরপর ১২ মে দুপুরে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারসহ আট জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার বাকি সাত আসামি হলেন— মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু, মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার সাক্কু ও শাহজাহান মিয়া।
মোশাররফ হোসেনের মামলায় বাবুল আক্তারকে গ্রেফতার করে পিবিআই। তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ১৭ মে বাবুল আক্তারকে জবানবন্দি গ্রহণের জন্য আদালতে হাজির করা হয়। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরায় বসে থেকেও শেষপর্যন্ত জবানবন্দি দিতে সম্মত হননি বাবুল আক্তার। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
তবে যে মুছার কাছে বাবুল আক্তারের নির্দেশে টাকা লেনদেনের কথা পিবিআই বলছে, হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি সেই মুছাকে চেনেন না বলে জানিয়েছিলেন। তবে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে মুসার সঙ্গে পূর্বপরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি বাবুল আক্তার স্বীকার করেন বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা।
উল্লেখ্য, মুছা পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের সোর্স হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পাঁচ বছর আগে হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই পলাতক আছেন কামরুল ইসলাম সিকদার মুসা। তবে তার স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি, মুসাকে ওই বছরের ২২ জুন প্রশাসনের লোকজন তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ মিলছে না।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
এসপি বাবুল কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা মাহমুদা খানম মিতু মিতু হত্যা