Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সেদিন যা ঘটেছিল বোট ক্লাবে

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৭ জুন ২০২১ ০০:৩০

ঢাকা: ক’দিন ধরেই দেশজুড়ে আলোচনার শীর্ষে ঢালিউডের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনাটি। ভেরিফায়েড পেজ থেকে ফেসবুক পোস্ট ও পরে সংবাদ সম্মেলন করে জনপ্রিয় এই নায়িকা জানিয়েছিলেন, আবাসন খাতের ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের কাছে তিনি আশুলিয়া এলাকার ঢাকা বোট ক্লাবে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন। এরই মধ্যে এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। প্রধান অভিযুক্ত নাসিরসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। আসামিরা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় আদালতের আদেশে রিমান্ডে রয়েছেন। কিন্তু এখনো যে প্রশ্নটি সবার মনে সেটি হলো— ঢাকা বোট ক্লাবে সেদিন কী ঘটেছিল?

বিজ্ঞাপন

সংবাদ সম্মেলনে পরীমনির বক্তব্য ও তার দায়ের করা মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, কস্টিউম ডিজাইনার জিমির ঘনিষ্ঠ একজন ব্যক্তি তুহিন সিদ্দিকী অমি। ঘটনার দিন, অর্থাৎ ৮ জুন রাতে বনানীর বাসা থেকে ছোট বোন বনি এবং জিমি ও অমির সঙ্গে গাড়ি নিয়ে উত্তরার দিকে রওনা দেন। পরীমনির অভিযোগ, অমি কৌশলে তাদের সাভারের বিরুলিয়ার এলাকায় ঢাকা বোট ক্লাবে নিয়ে যান। অমি বোট ক্লাবে প্রবেশ করার সময় বাকিরা গাড়িতেই ছিলেন। তবে অমি তাদের বোট ক্লাবে ঢোকার জন্য জোরাজুরি করেন, পরীমনির বোনেরও ওয়াশরুম ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। এসময় তারা বোট ক্লাবে প্রবেশ করলে সেখানে অমির সহায়তায় নাসির উদ্দিন মাহমুদ পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা চালান।

বিজ্ঞাপন

পরীমনির অভিযোগ, ঘটনার পর তিনি বনানী থানায় অভিযোগ করতে গেলেও তার অভিযোগ নেওয়া হয়নি। পরে থানা থেকে যোগাযোগ করার কথা বা হলেও তা করা হয়নি। পরে পরীমনির ফেসবুক স্ট্যাটাস ও সংবাদ সম্মেলনের পর পুলিশ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে লিখিত অভিযোগ নিয়েছে। সে অভিযোগ সাভার থানায় গেলে মামলাও দায়ের হয়েছে। তার জের ধরেই গ্রেফতার হয়েছেন নাসির ও অমিসহ পাঁচ জন।

আরও পড়ুন-

বোট ক্লাবে সেদিনের ঘটনার সময়কার সিসিটিভি ফুটেজ এরই মধ্যে পেয়েছে পুলিশ। এছাড়া পরীমনি যখন বনানী থানায় গিয়েছিলেন, তখনকার থানার ফুটেজও সংগ্রহ করা হয়েছে। সারাবাংলাও সংগ্রহ করেছে সেই ফুটেজ। এরই মধ্যে সে ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে।

ঢাকা বোট ক্লাবের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১২টার দিকে ক্লাবের মূল ফটকের সামনে প্রথমে একটি কালো গাড়ি এসে দাঁড়ায়। সেই গাড়ি থেকে অমি (সাদা গেঞ্জি পরিহিত), পরীমনি (নীল শার্ট-প্যান্ট), ছোট বোন বনি (লাল জামা) ও কসটিউম ডিজাইনার জিমি (জিন্স পরিহিত) নামেন। পেছনের আরেকটি সাদা গাড়ি থেকে নামেন দু’জন। তাদের মধ্যে সাদা শার্ট পরিহিত ব্যক্তিটি পরীমনির গাড়ির পেছনের দিকে গিয়ে বসেন। কালো শার্ট পরা আরেকজন বসেন ওই গাড়ির সামনে। এরপর দু’টি গাড়ি সেখান থেকে সামনের দিকে চলে যায়। অমিসহ চার জন কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই ক্লাবে ঢুকে যান।

সেখানকার আরেক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বোট ক্লাবের রিসিপশনে দু’জন এবং সামনে একজনসহ মোট তিন জন ছিলেন। তাদের সামনে দিয়েই পরীমনি, বনি, অমি ও জিমি ভেতরে প্রবেশ করেন। এর কয়েক সেকেন্ড পর পেছনে আরেকজন কোট টাই পরা ব্যক্তি ভেতরে চলে যান।

মঙ্গলবার ডিবি কার্যালয়ে  গিয়েছিলেন পরীমনি

তাদের বের হওয়ার সময়কার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, রিসিপশন এলাকায় কেউ নেই। দু’জন পরীমনিকে কোলে করে নিয়ে বের হচ্ছেন। পেছনে পেছনে বেরিয়ে আসেন লাল জামা পরা বনি। এর কয়েক সেকেন্ড পরই অমি ও একজন আনসার সদস্য বের হন ভেতর থেকে।

এরপর বাইরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, পরীমনিকে কোলে করে নিয়ে সেই কালো গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। অমি বাদে বাকিরাও গাড়িতে ওঠেন। এরপর কালো গাড়িটি চলে যায়। তার পেছনে পেছনে চলে যায় সাদা গাড়িটিও।

এই ফুটেজ দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে, পরীমনি ও তার সঙ্গীরা অমির অনুরোধে হলেও নিজেদের সম্মতিতেই বোট ক্লাবের ভেতরে প্রবেশ করেছেন। তবে সেখান থেকে তাদের বের হওয়ার সময়ে পরীমনিকে অচেতন অবস্থায় বের হতে দেখা গেছে। বাকি কাউকেও তেমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখা যায়নি। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, ভেতরে যদি পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা করা হয়ে থাকে, তাহলে তার সঙ্গীরা বাধা দিয়েছিলেন কি না। কেননা, বের হওয়ার সময়ও তাদের স্বাভাবিকই দেখা গেছে। পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার সময় তারা বাধা দিতে গেলে তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হওয়ার কথা কিংবা পরীমনিকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে দ্রুত স্থানত্যাগ করার কথা।

এদিকে, বনানী থানায় যখন পরীমনি অভিযোগ করতে যান, সেই সময়ের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, তিনি অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় ছিলেন। তার একজন সঙ্গীকেও দেখা গেছে অপ্রকৃতস্থ অবস্থায়। সে কারণেই তার অভিযোগ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।

গ্রেফতারের পর মঙ্গলবার নাসির উদ্দিন মাহমুদকে আদালতে হাজির করে পুলিশ

পরীমনি অবশ্য সংবাদ সম্মেলনেই বলেছেন, বোট ক্লাবের বারে তাকে জোর করে মদ খাওয়ানো হয়েছে। নাসির উদ্দিন মাহমুদ তার মুখে জোর করে মদের বোতল ঢুকিয়ে দিয়েছেন। সে কারণে তার ঠোঁটও কেটে যায়। আর জোর করে মদ খাওয়ানোর ফলেই তিনি অপ্রকৃতস্থ ছিলেন।

একই কথা বলেছে পুলিশও। তাদের ভাষ্য, পুলিশ পরীমনিকে অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় দেখেই তাকে সেদিন হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। সে সময় এভারকেয়ার হাসপাতালে পাঠানো হয় পরীমনিকে।

এদিকে, পরীমনির মামলার প্রধান যে আসামি, সেই নাসির উদ্দিন মাহমুদের নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার তথ্য জানিয়েছে পুলিশ। তারা বলছে, নাসির উদ্দিন মাহমুদ বিভিন্ন ক্লাবে মদ সরবরাহ করতেন। এছাড়া তরুণীদের প্রলুব্ধ করে ক্লাবগুলোতে পাঠাতেন, সেখানে তাদের দিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য করতেন। তিনি নিজেও তরুণীদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে শয্যাসঙ্গী করতেন।

তবে পরীমনি যে অভিযোগ এনেছেন নাসির উদ্দিন মাহমুদের বিরুদ্ধে, তিনি নিজে তা অস্বীকার করেছেন। উত্তরার বাসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ নাসির ও অমি ছাড়াও তিন নারীকে গ্রেফতার করে। তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে আসার সময় সাংবাদিকদের নাসির বলছিলেন, পরীমনি ও তার সঙ্গীরা মাতাল অবস্থাতেই বোট ক্লাবে প্রবেশ করেছিলেন। সেখানেও তারা মদপান করতে চাইলে তাদের মদ দেওয়া হয়নি। সেখান থেকে মদের বোতল নিয়ে তারা বের হতে চাইলে বাধাও দেন নাসির। এসময় ক্ষিপ্ত হয়ে পরীমনিই তাদের সঙ্গে বাজে আচরণ করেন, হুমকি-ধমকি দেন।

আরও পড়ুন-

এরই মধ্যে নাসিরসহ পাঁচ জন মাদক মামলায় রয়েছেন রিমান্ডে। পরীমনির মামলাতেও তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাভার থানা পুলিশ রিমান্ড আবেদন করে রেখেছে। চলমান রিমান্ড শেষ হলে ওই মামলার রিমান্ড শুনানি হবে। রিমান্ডের অনুমোদন পেলে পরীমনির মামলা নিয়ে সাভার থানা পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করবে নাসির ও অন্য আসামিদের। আপাতত মামলাটি বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ, যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করছে গোয়েন্দা পুলিশ।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, বোট ক্লাবে ওই রাতে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনেছেন পরীমনি। আমরা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছি। কী ঘটেছিল, সে চিত্রটি এখনো স্পষ্ট নয়। বিস্তারিত জানতে আরও তদন্ত প্রয়োজন। তবে সেখানে ধস্তাধস্তি ও অশ্রাব্য গালিগালাজ হয়েছে— এমনটি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ নানা ধরনের তথ্য আমাদের হাতে রয়েছে। আমরা বিশ্লেষণ করে দেখছি।

তিনি বলেন, বনানী থানাতে তারা অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় এসেছিলেন— এ তথ্য নিয়ে বাদীপক্ষেরও আপত্তি নেই। সেখান থেকে পুলিশের সহযোগিতাতেই পরীমনিকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।

গোয়েন্দা পুলিশের এই উপকমিশনার বলেন, অত্যন্ত আলোচিত মামলা এটি। আমরা তদন্ত করছি। কোনো ধরনের মিডিয়া ট্রায়ালের সুযোগ নেই, তদন্তের মাধ্যমে সঠিক ঘটনা তুলে আনা হবে।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা নাসির ইউ মাহমুদ নাসির উদ্দিন মাহমুদ পরীমনি বোট ক্লাব

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর