Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আন্দোলন উপেক্ষা করেই চলছে হাসপাতাল নির্মাণের প্রথম ধাপের কাজ

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৯ জুলাই ২০২১ ২৩:১৫

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের আন্দোলন উপেক্ষা করেই চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমণ্ডিত ঐতিহাসিক সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের প্রথম ধাপের কাজ শুরু করেছে ইউনাইটেড গ্রুপ। প্রথম ধাপের কাজের মধ্যে আছে— পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন ও মাটি পরীক্ষা। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে ঈদুল আজহার তিনদিন ছুটি বাদে গত দশদিন ধরে প্রথম ধাপের কাজ চলছে বলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে হাসপাতালের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে নাগরিক আন্দোলন চলমান থাকায় বিষয়টি ‘যথাসম্ভব গোপন’ রাখছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ।

বিজ্ঞাপন

যে কোনো স্থাপনার নির্মাণকাজ শুরুর আগে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন দাখিল করতে হয় পরিবেশ অধিদফতরে। সেখান থেকে পরিবেশ ছাড়পত্র নিয়ে নির্মাণকাজ শুরুর বাধ্যবাধকতা আছে। এছাড়া মাটির গুণগত মান পরীক্ষা করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন স্থাপনার নকশার সঙ্গে দাখিল করতে হবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কাছে। সয়েল টেস্ট রিপোর্ট ও নকশা মূল্যায়ন করে সিডিএ অনুমতি দিলে তবেই স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারবে ইউনাইটেড গ্রুপ।

বিজ্ঞাপন

ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) কায়েস খলিল খান সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, প্রথম ধাপে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের কাজ শুরু হয়েছে। ঈদুল আজহার এক সপ্তাহ আগে থেকে সিআরবি সংলগ্ন গোয়ালপাড়া এলাকায় এ কাজ শুরু হয়েছে। ঈদের জন্য তিনদিন বন্ধ ছিল। এরপর গত এক সপ্তাহ ধরে আবারও কাজ চলছে।

গত ২৭ জুলাই বিকেলে নগরীর এনায়েতবাজার ওয়ার্ডের গোয়ালপাড়া এলাকায় রেলওয়ের শহীদ আব্দুর রব কলোনি সংলগ্ন হাসপাতালের প্রস্তাবিত এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজের তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সেখানে জড়ো হন আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিসহ স্থানীয় শ’খানেক মানুষ।

জানতে চাইলে কায়েস খলিল খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা আমরাই করছি। গবে গভীর নলকূপ নয়। ভূর্গভস্থ পানির স্তরের কি অবস্থা সেটা আমরা যাচাই করছি। একইসঙ্গে আমরা সংশ্লিষ্ট এলাকায় বায়ূ, শব্দ- এসব পরিবেশগত বিষয়ের সার্বিক অবস্থা মূল্যায়ন করছি। সার্বিক বিষয়ে প্রতিবেদনসহ পরিবেশ অধিদফতরে সনদের জন্য আবেদন করা হবে। এরপর আমরা সয়েল টেস্টের কাজ শুরু করব। সয়েল টেস্টের প্রতিবেদন নিয়ে আমরা সিডিএতে নকশা জমা দেব। এটা আমাদের প্রথম ধাপের কাজ। এই কাজ শেষ হলে আমরা দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু করব।’

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই প্রথম ধাপের কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মোট ছয় একর জমি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আমাদের। এর মধ্যে ২ দশমিক ৪২ একর জমি আমাদের প্রথম ধাপের কাজের জন্য বুঝিয়ে দিয়েছে রেলওয়ে। সেই জমিতেই আমরা কাজ শুরু করেছি।’

জানতে চাইলে হাসপাতাল প্রকল্পের পরিচালক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) আহসান জাবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘মূল নির্মাণকাজ শুরুর আগে প্রাক প্রস্তুতিমূলক কিছু কাজ করতে হয়। সেই কাজ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ শুরু করেছে। এনভায়রনমেন্টাল এফেক্ট অ্যাসাসমেন্ট করা হচ্ছে। এটা প্রথম ধাপের কাজ। তারা পরিবেশ অধিদফতরে আবেদন করবে। অনুমতি পেলে সেটা আমাদের কাছে জমা দেবে। আনুষাঙ্গিক আরও কিছু কার্যক্রম আছে। সেগুলো শেষ হলে আমরা নির্মাণকাজের অনুমতি দিতে পারব।’

মাটির গুণগত মান পরীক্ষা ও ভবনের নকশার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সয়েল টেস্ট তো আগেই হয়েছে। সেটার রিপোর্টসহ নকশা তারা আমাদের কাছে জমা দিয়েছে। এখন সিডিএ’র কাছে যদি তারা আবার সয়েল টেস্ট করে নকশা জমা দেয় সেটা তাদের বিষয়।’

২০১২ সালে রেলওয়ে তাদের নিজস্ব ভূমি ব্যবহার করে হাসপাতালসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা করে। জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) সভায় প্রকল্পটি পিপিপি’র আওতায় বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। প্রকল্পের অধীনে ২০১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে এক ধাপ পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করে। নির্ধারিত সময়ে ৩২টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করে।

তবে দরপত্র দাখিলের শেষ সময়সীমার মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। সানজি ম্যাক্স ও ওয়েল জেবি এবং ডেনিম মিলস লিমিটেড দরপত্র দলিলের শর্ত পরিপালন করতে না পারায় নন-রেসপনসিভ হয়। অপর প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড রেসপনসিভ হয়। ২০১৮ সালের ১৭ জুলাই দরপত্রের ফিন্যান্সিয়াল বিড উন্মুক্ত করা হয়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির অনুমোদন পায় একই বছরের ১৪ আগস্ট। এরপর ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর খসড়া চুক্তিপত্র অনুমোদন করে আইন মন্ত্রণালয়।

২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি সিসিইএ কমিটির বৈঠকের পর ১৩ ফেব্রুয়ারি পিপিপি প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদন দেন।

কায়েস খলিল খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার পর করোনা সংক্রমণ শুরু হয়ে যায়। একবছর ধরে আমরা কোনো কাজই করতে পারিনি। না হলে, এতদিনে কাজ অনেকদূর এগিয়ে যেত।’

জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ের তিন বছরে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ কমপক্ষে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো ২৫০ শয্যার হাসপাতাল কার্যক্রম চালুর করবে পরবর্তী ২৪ মাসের মধ্যে। বাস্তবাায়নের ১০ বছরের মধ্যে বেসরকারি অংশীদার ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ ৫০ আসনের মেডিকেল কলেজ এবং চুক্তির নির্ধারিত ১২ বছরের মধ্যে আরো ৫০ আসনের মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম শুরু করতে হবে।

প্রকল্পের ছয় একর জমির মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ২ দশমিক ৪২ একর এবং দ্বিতীয় ধাপে ৩ দশমিক ৫৮ একর জমি ব্যবহার করবে ইউনাইটেড। প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ১২ বছর। চুক্তির সময়কাল ধরা হয়েছে ৫০ বছর (নির্মাণসহ)। চুক্তি অনুযায়ী, বেসরকারি অংশীদার বা ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ চুক্তির সময়কালে অবকাঠামোর ডিজাইন, নির্মাণ, অর্থায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। চুক্তির মেয়াদ শেষে পূর্ণাঙ্গ চালু ও ভালো অবস্থায় সামগ্রিক অবকাঠামো সরকারি অংশীদার বা বাংলাদেশ রেলওয়েকে হস্তান্তর করবে।

এদিকে হাসপাতাল হলে সিআরবির শতবর্ষী গাছ, ঐতিহাসিক স্থাপনা, শহীদদের কবর নিশ্চিহ্নসহ প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের আশঙ্কায় সরব হয়ে ওঠেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকরাসহ বিভিন্ন সংগঠন। প্রায় একমাস ধরে সিআরবিতে ধারাবাহিক বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে আসছেন নাগরিকরা। এর ধারাবাহিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী ড. অনুপম সেনকে আহবায়ক ও আওয়ামী লীগ নেতা ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুলকে সদস্য সচিব করে ‘সহস্র নাগরিক কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি দিয়ে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিলের আহ্বান জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কায়েস খলিল খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাসপাতাল পিপিপির আওতায় সরকারি প্রকল্প। সরকারি সংস্থা রেলওয়ে এটা করছে। আমরা শুধুমাত্র অর্থায়ন এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছি। রেলওয়ের পক্ষে আমরা এই দায়িত্ব পালন করছি। হাসপাতাল নিয়ে দ্বিমত কিংবা প্রতিবাদের বিষয় আমরা জানি। তবে দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। সুতরাং আমাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটা আমাদের পালন করতে হবে।’

আরও পড়ুন
সিআরবি রক্ষায় ঢোল-বাঁশি আর স্লোগানে ‘জাগরণ যাত্রা’
সিআরবিতে হাসপাতাল: গান-কবিতায় সংস্কৃতিকর্মীদের প্রতিবাদ
সিআরবির শতবর্ষী গাছে নামফলক লাগিয়ে বীর শহিদদের স্মরণ
সিআরবি রক্ষার আকুতি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি
সিআরবিতে হাসপাতালের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি ১০১ বিশিষ্টজনের
সরকার জনগণের বিপক্ষে কাজ করবে না, সিআরবি প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী
হাসপাতাল প্রকল্প বাতিল করে সিআরবি সংরক্ষণের আদেশ চেয়ে মামলা

 

সারাবাংলা/আরডি/একে

করোনা কোভিড-১৯ চট্টগ্রাম নভেল করোনাভাইরাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর