রাজশাহীতে বাড়ছে মাছ চাষ, কমছে কৃষিজমি
২৪ ডিসেম্বর ২০২১ ১০:১৫
রাজশাহী: গত কয়েক বছরে রাজশাহীতে মাছ চাষ কয়েকগুণ বেড়েছে। তবে কৃষিজমি কমেছে ১৫ হাজার হেক্টরও বেশি। কৃষিজমির একটি বড় অংশ চলে গেছে বাণিজ্যিক পুকুর খননে। মাছ চাষে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষিজমিতে পুকুরখনন করছেন মালিকরা।
মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিকে সাফল্য হিসেবে দেখছে মৎস্য দফতর। তবে কৃষি দফতর বলছে, বাণিজ্যিক এসব পুকুর খনন হয়েছে আবাদি জমিতেই। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননে জলাবদ্ধতায় প্রতি বছরই ব্যাপক ফসলহানি হচ্ছে। চাপও বাড়ছে পরিবেশের ওপর।
রাজশাহী মৎস্য অধিদফতর জানিয়েছে, ২০১৭ সালে জেলায় পুকুরের পরিমাণ ছিল সাত হাজার ২৯৪ হেক্টর। এর মধ্যে বাণিজ্যিক মাছের খামার ছিল তিন হাজার ৪৬২ হেক্টর জমিতে। ২০১৮ সালে বাণিজ্যিক খামার গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৩০৯ হেক্টরে। ২০২১ সালে ১৩ হাজার ১৫০ একর জমিতে বাণিজ্যিক মাছের খামার হয়েছে ৪৩ হাজার ১৯৬টি। এ বছরে ৮৪ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হচ্ছে।
অন্যদিকে, রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে জেলায় মোট জমির পরিমাণ দুই লাখ ৪২ হাজার ৯৩১ হেক্টর। আবাদযোগ্য জমি রয়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৮ হেক্টর। গত আট বছরে নতুন পাঁচ হাজার পুকুর কাটা হয়েছে। ফলে কয়েক বছরে পুকুরসহ অন্যান্য কারণে শুধুমাত্র জেলায় ফসলি জমি কমেছে ১৫ হাজার হেক্টর।
কয়েক বছর ধরেই গোদাগাড়ী, পবা, তানোর, বাগমারা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া, মোহনপুর, বাঘা ও চারঘাট এলাকায় ফসলি জমিতে পুকুর খননের মহোৎসব চলছে। শীত মৌসুমের শুরুতেই অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন হচ্ছে। অভিযোগ আছে, এ কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে প্রশাসন, ক্ষমতাশীল দলের নেতা ও পুলিশ। পুকুর খনন বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। এতে একে অপরের ওপর দোষারোপ করে আখের গোছাচ্ছে অনেকে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কিছু অসাধু ব্যক্তি আবাদি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় দেদারসে চলছে খননযজ্ঞ। যেন পুকুর খননের মহোৎসব চলছে। কমছে কৃষিজমি, বাড়ছে কৃষিশ্রমিকের বেকারত্ব। ভেঙে পড়ছে গ্রামীণ নিরাপত্তা বেষ্টনী। আবাদের ফাঁকে ফাঁকে গরু-ছাগল পালনের তৃণভূমি থাকছে না। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে আবাদযোগ্য জমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই আইনে। তারপরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি নানান কৌশলে পুকুর খনন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিল ও নিচু এলাকাগুলোকে অনাবাদি কিংবা এক ফসলি দেখিয়ে পুকুর খনন করছেন তারা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক এবিএম মহসিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোন এলাকায় কতগুলো পুকুরের প্রয়োজন আছে এবং পরিবেশের ওপর সেগুলোর কী প্রভাব পড়তে পারে, সেসব বিবেচনা না করেই যথেচ্ছভাবে পুকুর খনন করা হচ্ছে। এসব অপরিকল্পিত পুকুর কৃষকদের জীবন ও জীবিকায় হুমকি তৈরি করছে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) রাজশাহী আঞ্চলিক সমন্বয়কারী তন্ময় সান্যাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভূমি ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনগুলোতে ভূমির ধরণ রূপান্তর করা নিষিদ্ধ। তাছাড়াও, ২০১৩ সালের বাংলাদেশ পানি আইনে প্রাকৃতিক জলাশয়ের প্রবাহকে বাধা দেওয়া কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে। কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের খসড়া, যেখানে পরিষ্কারভাবে কৃষি জমি রূপান্তরে নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ আছে, সেটি এখনো পূর্ণতা পায়নি।’
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কে জে এম আব্দুল আওয়াল সারাবাংলাকে বলেন, ‘জেলায় গত কয়েক বছরে পুকুর খননের কারণে অনেক ধানি জমি কমেছে। তবে সরকারি নির্দেশনা থাকার পরেও পুকুরগুলো কীভাবে গড়ে উঠেছে, সেটি বলতে পারব না।’ জেলায় গত কয়েক বছরে মোট কী পরিমাণ ফসলি জমি পুকুরের কারণে নষ্ট হয়েছে- তা জানাতে পারেননি তিনি।
রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলোক কুমার সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত কয়েক বছরে রাজশাহীতে প্রায় দ্বিগুণ মাছ উৎপাদন বেড়েছে। গত ১০ বছরের মধ্যে পুকুরও বেড়েছে কয়েক গুণ। মাছ চাষ করে অনেক বেকার যুবক স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মাছ চাষের জন্য চাষিদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফলে জেলায় মাছ এখন উদ্বৃত্ত থাকছে। যা দেশের বিভিন্ন জেলা এবং দেশের বাইরে রফতানি করে বিপুল অর্থ আয় হচ্ছে।’
এদিকে, রাজশাহী অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে আবাদি জমিতে পুকুর খননকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননে জলাবদ্ধতায় প্রতি বছর ব্যাপক ফসল নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া পরিবেশের ওপর চাপও বাড়ছে।
সারাবাংলা/পিটিএম