পুলিশবক্সে বোমা হামলা: ‘মাস্টারমাইন্ড’র পেছনে নির্দেশদাতা কে?
৩ জানুয়ারি ২০২২ ২১:৫৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বছর দুয়েক আগের এক রাত। বোমা হামলায় কেঁপে উঠেছিল চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার ষোলশহর দুই নম্বর গেট এলাকার ট্রাফিক পুলিশ বক্স। দুই পুলিশ সদস্যসহ অন্তত পাঁচ জন আহত হন। বিশ্বব্যাপী জঙ্গিগোষ্ঠীর অনলাইন তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’ ওই সময় জানিয়েছিল, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। তবে ওই হামলায় জড়িত ১৩ জনকে গ্রেফতারের পর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট বলছে, হামলার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো যোগসূত্রই নেই। বরং পুলিশকে টার্গেট করে হামলার পরিকল্পনা হয়েছে স্থানীয়ভাবে। আর এর পেছনে ছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত নব্য জেএমবির সদস্যরা। এরা বোমা তৈরির কৌশল শিখেছে ইউটিউব থেকে। যে ১৩ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, তাদের মধ্যেই রয়েছে এই হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’।
স্থানীয়ভাবে পরিকল্পনা ও সংঘটিত হওয়ার তথ্য জানালেও কাউন্টার টেরোরিজমের তদন্তসংশ্লিষ্টরা ‘মাস্টারমাইন্ডে’র সঙ্গে এক ‘রহস্যময় ব্যক্তি’র কথোপকথন পেয়েছেন। কম প্রচলিত মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সেই কথোপকথনে ওই ব্যক্তি ইউটিউবের ভিডিও পাঠিয়ে বোমা বানানোর কৌশল শেখা, বোমা তৈরি ও হামলায় তাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেফতার ১৩ জনের কেউই এই ব্যক্তি সম্পর্কে কোনো তথ্য তাদের দিতে পারেনি। ‘মাস্টারমাইন্ড’কে গ্রেফতারের পর এখন রহস্যময় ওই ব্যক্তিকেই হামলার নির্দেশদাতা ধরে নিয়ে তার সন্ধান পেতে মরিয়া হয়ে নেমেছে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।
আরও পড়ুন-
- চট্টগ্রামে পুলিশ বক্সে বিস্ফোরণ, সন্দেহ নাশকতার
- পুলিশ বক্সে বোমা হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ গ্রেফতার
- পুলিশ বক্সে বিস্ফোরণ: ‘নব্য জেএমবি’র ৬ সদস্য গ্রেফতার
- পুলিশ বক্সে বিস্ফোরণ: বিকল ক্যামেরায় ‘হতাশ’ তদন্ত সংস্থা
- পুলিশ বক্সে বোমা বিস্ফোরণ: ‘নব্য জেএমবি’ সদস্য গ্রেফতার
- পুলিশ হত্যার টার্গেট নিয়ে এগুচ্ছে নব্য জেএমবি, গ্রেফতার ৩
- পুলিশ বক্সে বিস্ফোরণ: আইএসে’র দাবিকে পাত্তা দিচ্ছে না পুলিশ
- পুলিশের স্থাপনায় বিস্ফোরণ: দু’জনের দায় স্বীকার, রিমান্ডে ৩ জন
- নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি বোমা বিস্ফোরণ, কীভাবে— জানে না পুলিশ!
২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে ষোলশহর দুই নম্বর গেট এলাকায় ওই ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর গত প্রায় দুই বছরে তদন্তকারী সংস্থা নগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে। সবশেষ গত ২৯ ডিসেম্বর গ্রেফতার করা হয় মো. সেলিম (৩৩) নামে একজনকে, যাকে নব্য জেএমবির স্থানীয় গ্রুপের সামরিক কমান্ডার এবং পুলিশ বক্সে বোমা হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলছে পুলিশ।
গ্রেফতার বাকি ১২ জন হলেন— নব্য জেএমবির স্থানীয় গ্রুপের আমীর মো. নোমান খান, দাওয়াতী শাখার প্রধান জহির উদ্দিন এবং সদস্য মহিদুল আলম, মঈনউদ্দিন, আবু সাদেক, রহমতউল্লাহ আকিব, মো. আলাউদ্দিন, মো. সাইফুল্লাহ, মো. এমরান, আবু ছালেহ, মো. শাহেদ ও মো. কাইয়ূম।
নগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপকমিশনার ফারুকুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা হামলার মাস্টারমাইন্ডসহ ১৩ জনকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করেছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন তথ্য আমরা পেয়েছি, যেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তবে এটি নিশ্চিত হয়েছি, তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো সংযোগ ছিল না। বিভিন্ন পর্যায় থেকে যেসব দাবি করা হয়েছে, সেগুলো মিথ্যা। গ্রেফতার ১৩ জনসহ আরও কয়েকজন স্থানীয়ভাবে সংঘটিত হয়ে নব্য জেএমবির একটি গ্রুপ গড়ে তোলে। গ্রুপ গড়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে দাওয়াতি শাখার প্রধান জহির। এরপর তারা ইউটিউবে ভিডিও দেখে বোমা বানানোর কৌশল শেখে। নিজেরাই বোমা বানিয়ে নিজেরাই হামলা করে।’
অজ্ঞাত ব্যক্তির নির্দেশ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফারুকুল হক বলেন, ‘টেলিগ্রাম অ্যাপে তারা যোগাযোগ করতেন। আমরা বিষয়টি মাত্র জেনেছি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।’
বোমা হামলার ঘটনার তিন মাস পরেই ২০২০ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী এমরান, পলিটেকনিকের ছাত্র আবু ছালেহ ও দোকানকর্মী সাইফুল্লাহকে গ্রেফতারের পরই কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট হামলার সঙ্গে নব্য জেএমবির সম্পৃক্ততার তথ্য পায়। এরপর ওই বছরের অক্টোবরে নব্য জেএমবির ওই গ্রুপের দাওয়াতি শাখার প্রধান জহিরসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়। সবশেষ গ্রুপের সামরিক কমান্ডার সেলিমকে গ্রেফতারের পর পুলিশ বক্সে বোমার হামলার পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নের পুরো ছকই এখন উদঘাটন করেছে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।
তদন্তসংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্রেফতার ১৩ জনের মধ্যে ৯ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে— চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া বাজারের হকার্স মার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী ছিলেন জহির। ২০১৭ সালে ইউটিউবে তামিম আদনানি ও জসিম উদ্দিন রাহমানির ওয়াজ শুনে জহির জঙ্গিবাদি কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়। গ্রেফতার সেলিম সম্পর্কে তার মামা। সেলিমকে সে ওয়াজগুলো সরবরাহ করে একই কাজে দাওয়াত দেয়।
২০১৮ সালে জহির তার বন্ধু শাহজাহান, নোমান, মোর্শেদ ও মামা সেলিমকে নিয়ে পদুয়া বাজারের পূর্ব দিকে ফরিয়াদিরকূলে বেড়াতে যায়। সেখানে সেলিম প্রতি সপ্তাহে কোরআন হাদিসের আলোকে গ্রুপ মিটিংয়ের প্রস্তাব দেয়। এরপর থেকে তারা সবাই একসঙ্গে ফজরের নামাজে পড়তে শুরু করে। নামাজ পড়তে গিয়ে আলাউদ্দিন, আকিব ও হাবিবকে নিজেদের গ্রুপে টেনে নেয়। কিছুদিন পর শাহজাহান দুবাই চলে যান।
জবানবন্দিতে জহিরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে একদিন জহির ফরিয়াদিরকূলে গিয়ে দেখতে পায়— নোমান, আলাউদ্দিন, হাবিব, শহিদ, সাহেদ, কাইছার, সাদেক ও কামাল পাহাড়ের মধ্যে গাছে আরবি লেখা কালো পতাকা বেঁধে সেলিম তাদের বায়াত (শপথ) করাচ্ছে। জহির বায়াতে ছিল না। তবে সবাই মিলে একসঙ্গে ছবি তোলে। জহিরের মোবাইল থেকে সব ছবি সেলিম নিয়ে নেয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২ নভেম্বর সাইট ইন্টেলিজেন্সের ওয়েবসাইটে জঙ্গলঘেরা একটি এলাকায় বায়াত নেওয়ার সময় মুখে ও মাথায় কাপড়বাঁধা ৯ যুবকের একটি ছবি প্রকাশ করে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২০ সালে জহির দাওয়াত দিয়ে মহিদুল আলম ও মঈন উদ্দিনকে গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করে। সেলিম টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে ‘বড় ভাই’দের সঙ্গে যোগাযোগের পর নোমান খানকে আমির, নিজেকে সামরিক শাখার প্রধান এবং জহিরকে দাওয়াতি শাখার প্রধান ঘোষণা করে। টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে ‘বড় ভাই’দের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি মূলত সেলিম একাই করত। তাদের নির্দেশের কথা জানিয়ে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে জহির, নোমান ও মোর্শেদকে ডেকে সেলিম নির্দেশ দেয়— পুলিশ বক্সে হামলা করতে হবে। এরপর সেলিম নিজেই হাবিব, শাহেদ, কাইছার, আবু সাদেক, সাইফুল ও এমরানকে নিয়ে দল তৈরি করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘টেলিগ্রামসহ কম প্রচলিত অ্যাপে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি সেলিমকে ইউটিউবে বোমা বানানোর ভিডিওর লিংক পাঠায়। সেটা দেখে বোমা বানানো শেখার, বানানোর এবং বিস্ফোরণ ঘটানোর নির্দেশ দেয়। সেই কথোপকথনের সব তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি। সেলিম নিজেও লোহাগাড়ার পদুয়া বাজারে একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী ছিল। সেই দোকানের গুদামে বসে সেলিম পলাতক থাকা হাবিব ও কাইছার এবং গ্রেফতার সাদেক-শাহেদের সহযোগিতায় একটি ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি, এক ধরনের বোমা) তৈরি করে। তবে ওই ব্যক্তি তাকে শুধু বিস্ফোরণ ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছিল। পুলিশ বক্সে বোমা হামলার পরিকল্পনা সেলিমের নিজস্ব ছিল।’
সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঘটনার দিন অর্থাৎ ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে একটি আইইডি নিয়ে সেলিম, সাদেক, কাইছার, হাবিব ও শাহেদ লোহাগাড়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসে। নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেট এলাকায় সাইফুল্লাহর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়। সাইফুল্লাহ সেলিমকে নাসিরাবাদের আপন নিবাসের গিরি ভবনে এমরানের বাসায় নিয়ে যায়। চবি শিক্ষার্থী এমরান সেখানে ব্যাচেলর বাসায় ভাড়া থাকত। কীভাবে আইইডি’র বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে, সেলিম সেটি শিখিয়ে দেয় এমরানকে। সেলিম সেখানে আইইডি রেখে সাইফুল্লাহকে নিয়ে বের হয়। জুমার নামাজের পর সেলিম ও সাইফুল্লাহ মিলে নগরীর বিভিন্ন এলাকা রেকি করে দুই নম্বর গেইটে ট্রাফিক বক্স হামলার জন্য নির্ধারণ করে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সময় আবু সাদেক ট্রাফিক বক্সের ভেতরে টেবিলের নিচে আইইডি রেখে আসে। সেলিমের নির্দেশ অনুযায়ী এমরান ও সাইফুল্লাহ বিস্ফোরণ ঘটানোর দায়িত্বে ছিল। এমরানের হাতে ছিল রিমোট কন্ট্রোলার। কিন্তু সাইফুল্লাহ ট্রাফিক বক্সের দক্ষিণে যাত্রী ছাউনির পাশে দাঁড়িয়ে রিমোট কন্ট্রোলারের মাধ্যমে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর সেলিমকে ফোন করে সাইফুল্লাহ বলে, ‘আমরা সফলভাবে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি।’ এরপর এমরানকে শহরে রেখে বাকি সবাই লোহাগাড়ার পদুয়ায় চলে যায়।
বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারী সেলিম হলেও পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত অন্তত ১৫ জন জড়িত ছিল বলে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
গ্রেফতার জহির উদ্দিনসহ বিভিন্নজনের জবানবন্দিতে আসা ‘বড় ভাই’, যার সঙ্গে সেলিমের যোগাযোগ ছিল তার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে সংস্থাটি।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেলিমকে যে বড় ভাই বিভিন্ন নির্দেশনা দিতেন, তিনি কখনো মোবাইলে কথা বলেননি। শুধু বাংলায় লেখা এসএমএস মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে আদান-প্রদান করতেন। সেলিম নিজেও কখনো ওই ব্যক্তির সঙ্গে ওভার টেলিফোনে কথা বলেননি। সে তাকে সরাসরি কখনো দেখেনি বলে আমাদের জানিয়েছে। সেলিম ছাড়া আর কারও সঙ্গে ওই ব্যক্তির যোগাযোগের তথ্যও আমরা পাইনি।’
‘আমাদের ধারণা, জহির নিজে থেকে জঙ্গিবাদি কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে দাওয়াতের মাধ্যমে গ্রুপ তৈরি করলেও সেলিমের মাধ্যমে কথিত ওই বড় ভাই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। গ্রুপের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে সেলিমের কমান্ডে। শুধু বয়স বেশি হওয়ায় নোমান খানকে আমিরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আর সেলিমের সব কর্মকাণ্ড ছিল অজ্ঞাত ওই ব্যক্তির নির্দেশে। সেলিমের সঙ্গে কথোপকথন দেখে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, তিনি বাংলাদেশি কেউ। আমরা তার সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করছি,’— বলেন তদন্তসংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
আইএসের দায় স্বীকার কাউন্টার টেরোরিজম নব্য জেএমবি পুলিশ বক্সে হামলা বোমা হামলা