নির্বাচন কমিশন আইন ‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’
২৭ জানুয়ারি ২০২২ ১৯:৫০
ঢাকা: নির্বাচন কমিশন আইন গঠন বিলটি জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাবে আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা বিলটিকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেছেন।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য (ময়মনসিংহ-৮ আসন) ফখরুল ইমাম বলেন, ‘আইনমন্ত্রী অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তা না হলে বিলটি হবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ সংবিধানকে সংশোধন না করে, ৪৮ এর ৩ ধারা বাইপাস করে কোনো আইন তৈরি করা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যদি কণ্ঠভোটে পাস করিয়ে দেন তাহলে এটি সব থেকে বাজে উদাহরণ হবে।’
কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম বিলটি গণতান্ত্রিকভাবে আসবে। দেশে কি বিচারপতি আর আমলা ছাড়া বিশ্বাস করার মতো মানুষ নেই? রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কি বিশ্বাস করেন না? স্পিকারকে বিশ্বাস করেন না? সংসদ সদস্যদের কি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়?’
তিনি সরকারি দলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনারা কেন বিচারপতি আর আমলাদের ওপর নির্ভর করবেন? এ বিলের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি রাখেন কোনো আপত্তি নেই। আপনাদের তো সেনানিবাসে জন্ম হয়নি। দেশ স্বাধীন করার জন্য নেতৃত্ব দিয়েছেন।’
চুন্নু বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি কর্তৃক যে দুইজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে সেখানে, আমরা নিশ্চিত কোনো আমলাকে দেওয়া হবে। সেই দুইজনের নিয়োগের ভার রাষ্ট্রপতির হাতে না দিয়ে স্পিকারকে দায়িত্ব দিন। আর সংসদের দুইজন সদস্যকে যেন রাখা হয়। তাতে কিছুটা হলেও আমরা বলতে পারব আমাদের অংশগ্রহণ আছে। সংসদ হচ্ছে সব কর্মকাণ্ডের মূল। আর সেই সংসদের কোনো অংশগ্রহণ থাকবে না এটি খুবই দুঃখজনক।’
গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘ওয়েস্ট মিনিস্টার ফার্ম অব গভর্নমেন্ট যেখানে প্রধানমন্ত্রী সর্বময়। তিনি সমস্ত ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেন নারীকে পুরুষ বানানো ছাড়া আর পুরুষকে নারী বানানো ছাড়া। যদি সেটি মেনে নিয়ে এই আইন করে তাহলে ঠিক আছে। তবে রাষ্ট্রপতি শব্দটা কেন আনলাম, রাষ্ট্রপতি শব্দটা কেন দিলাম? আর যদি প্রধানমন্ত্রী তার ক্ষমতার একটা অংশ রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে দেবেন যেটা সংবিধানের ৪৮ (৩) –এ দুটি ক্ষমতা দেওয়া আছে। তার সঙ্গে আর একটি ক্ষমতা দেবেন তাহলে সেটি স্পষ্ট করে বলতে হবে অর্থাৎ অনুচ্ছেদ (৪৮), (৯৫) এবং (৫৬) এর রেফান্সে আছে, তার সাথে ১১৮ যুক্ত করতে হবে। সংবিধান সংশোধন না করে আইন করা অসাংবিধানিক হবে।’
বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন) হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আইনের বিষয়ে জনগণের ধারণা একেবারে সুস্পষ্ট যে, সরকার আইন প্রণয়নের নামে জনগণের সঙ্গে প্রহসন করছে। ২০১৭ সালে ২৫ জানুয়ারি যে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছিল, তার সঙ্গে এ আইনের খুব একটা অমিল নেই।’
তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আইনটি ৪৮ (৩) এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিতর্কের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। জনগণের দাবি হচ্ছে- নির্বাচনকালীন সরকার অবশ্যই হতে হবে একটি তত্ত্বাবধায়ক এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন।’
বিএনপির সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ‘খসড়া আইনটির সঙ্গে ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুসন্ধান কমিটি গঠনের জন্য জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই বললেই চলে। এ কমিটিতে সরকারি দল সংসদের প্রধান বিরোধী দল, তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে একজন করে প্রতিনিধি যদি থাকত তাহলে স্বচ্ছতা থাকত।’
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার বহুল আলোচিত নির্বাচন কমিশন গঠন আইন সংসদে পাস হয়েছে।
এদিন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিলটি পাসের প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর আগে, বিরোধীদলীয় কয়েকজন এমপি বিলটি জনমত যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব তুললে তা নাকচ হয়ে যায়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয় এদিন সকালে।
এর আগে, সংসদে উত্থাপিত এ বিলটি অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। কমিটি উত্থাপিত বিলে দুটি সংশোধনী এনে পাসের সুপারিশ করলে ধারা দুটি সংশোধন করে।
বিলে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের শূন্যপদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতি এ আইনে বর্ণিত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নাম সুপারিশের উদ্দেশ্যে ছয় সদস্যের সমন্বয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন। কমিটিতে থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক, যিনি এর সভাপতিও হবেন। প্রধান বিচারপতি মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, বাংলাদেশের মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক।
বিলে বলা হয়, অনুসন্ধান কমিটি তাদের সভার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করবে। অন্যূন তিন সদস্যের উপস্থিতিতে অনুসন্ধান কমিটির সভার কোরাম হবে। কমিটির সভায় উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে এবং ভোটের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের দ্বিতীয় বা নির্ণায়ক ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে। অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে এর সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করবে।
বিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারের যোগ্যতায় বলা হয়েছে- তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। তার বয়স হতে হবে ন্যূনতম ৫০ বছর। কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা-সরকারি বা বেসরকারি পদে অন্যূন ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
আরও পড়ুন
যা আছে ইসি গঠন আইনে
ইসি গঠন আইন প্রত্যাহার করুন: এমপি হারুন
‘বাকশাল করে শেষ রক্ষা হয়নি, ইসি আইন করেও হবে না’
ইসি আইন প্রসঙ্গে কাদের— আমাদের হাতে কোনো ম্যাজিক নেই
ইসি গঠন আইনের খসড়ায় যে দুটি পরিবর্তনের সুপারিশ
‘ইসি গঠনে আইন আরেকটি পাতানো নির্বাচনের নীলনকশা’
ইসি গঠনে খসড়া আইন ও সার্চ কমিটির জন্য প্রজ্ঞাপন অভিন্ন: সুজন
সারাবাংলা/এএইচএইচ/একে
ইসি ইসি গঠন আইন জাতীয় সংসদ নির্বাচন কমিশন সংসদ অধিবেশন সিইসি