ইউক্রেনকে কি এবার বাঁচিয়ে দেবে রাসপুতিৎসা?
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৯:১৫
গত বছর থেকে ইউক্রেন সীমান্তে লক্ষাধিক সেনা ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করে রেখেছে রাশিয়া। এর বাইরেও সম্প্রতি কৃষ্ণ সাগর ও প্রতিবেশী বেলারুশে রুশ তৎপরতা বেড়েছে। ইউক্রেনের তিন দিকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করে অভিযানের সব রকম ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে ক্রেমলিন। যদিও রুশ কর্তৃপক্ষ বরাবরই ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের সম্ভাবনা অস্বীকার করে আসছে। তবে ইউক্রেনসহ পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো মনে করছে, ২০১৪ সালে যেমন ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছিল রাশিয়া, এবারও অভিযানের কথা অস্বীকার করে একসময় হামলার নির্দেশ দিতে পারেন পুতিন। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সদস্যরাও বসে নেই। পূর্ব ইউরোপে দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি করছে তারা।
তবে পুতিন যদি ইউক্রেনে অভিযান চালাতে চান তাহলে সেটা কবে? এমন প্রশ্নের উত্তর জানা পশ্চিমা শক্তির জন্য সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা রুশ সেনারা কবে সামনে এগুবে বা আদৌ এগুবে কি না তার উপর নির্ভর করছে পশ্চিমা বাহিনীর সমর কৌশল। সমর বিশারদ ও পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা বাহিনীর বহু প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতেই ইউক্রেনে পূর্ণ হামলার নির্দেশ দিতে পারেন পুতিন। কেননা এসময় ওই অঞ্চলের আবহাওয়া রুশ সেনাদের জন্য যুদ্ধোপযোগী জয়ে উঠবে।
ঠিক এ জায়গায় কিছুটা আশার আলো দেখছেন যুদ্ধবিরোধীরা। সিএনএন’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংঘাতপূর্ণ পূর্ব ইউরোপে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার শীত কম পড়েছে। এছাড়া যথেষ্ট তুষারপাতও নেই। হচ্ছে বৃষ্টি। বরফও গলে যাচ্ছে। জল ও কাদা রুশ স্থলসেনাদের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা। ভারী অস্ত্র পরিবহনেও মারাত্মক বিঘ্ন ঘটে এতে।
সিএনএন’র খবরে বলা হয়, ইউক্রেনীয়দের মুখে মুখে একটি প্রশ্ন— ‘এবার কি রাসপুতিৎসা বড্ড তাড়াতাড়ি এলো?’
‘রাসপুতিৎসা“ হলো একটি রুশ শব্দ। এর অর্থ বসন্তের কাদা। রাসপুতিৎসা বলতে বুঝায়, বছরের এমন একটি মওসুম যখন বরফ গলে জল হয়ে যায় এবং রাস্তাঘাটে কাদা জমে থাকে। বসন্তের শুরু থেকেই এমনটা হয়ে থাকে। এ সময় রাশিয়া ও ইউক্রেনে সড়ক পথে ভ্রমণ কঠিন হয়ে পড়ে। সাধারণত রাশিয়া ও ইউক্রেনে মার্চ মাস থেকে রাসপুতিৎসা শুরু হয়।
সিএনএন’র খবরে বলা হয়, ইউক্রেনে এ বছরের শীতকাল নজিরবিহীন উষ্ণ। শীতকালে এবার অন্যান্যবারের মতো ঠাণ্ডা পড়েনি। সিএনএন’র প্রতিবেদক গত ১ ফেব্রুয়ারি পূর্বাঞ্চলের বন্দর নগর মারিয়াপোল থেকে মধ্যাঞ্চলের জাপোরিজাজিয়াতে ভ্রমণ করেন। এসময় তিনি অনেক জায়গায় বৃষ্টি দেখেন। বৃষ্টি দেখে গাড়ির ইউক্রেনীয় চালক অবিশ্বাস্য স্বরে বলে উঠেন, ‘এখন বৃষ্টি নয়, তুষারপাত হওয়ার কথা।’
আরও পড়ুন
- ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা বাল্টিক দেশগুলোর
- আমেরিকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার নিন্দা করলেন শি-পুতিন
- রুশ আগ্রাসন মোকাবিলায় ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠিয়েছে আমেরিকা
- চীন-তাইওয়ান, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত— ২ ফ্রন্টে যুদ্ধ করবে আমেরিকা?
সিএনএন’র প্রতিবেদক বলেন, জাপোরিজিয়াতে দেখা যায়, বরফের চাইগুলো বাদামী জল হয়ে গলে যাচ্ছে। এমনকি মাঝরাতে, ডিনিপার নদীর উপরে কুয়াশার আবরণ গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে উবে গেছে।
ইউক্রেন সীমান্তে মোতায়েন করা রুশ সেনারা ওই অঞ্চলের কিছু ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেছেন। এতে দেখা গেছে, বরফ গলে গিয়ে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। সেনারা কাদায় দাঁড়িয়ে আছেন।
সমর বিশারদরা ইউক্রেনের আবহাওয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছেন। তাদের মধ্যে অবশ্য নানা মত রয়েছে। বহু বিশেষজ্ঞ বলছেন, আবহাওয়ার এ অবস্থা যদি চলতে থাকে, অর্থাৎ যদি শীত কমতে থাকে তাহলে হামলার পথে নাও হাঁটতে পারেন পুতিন।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভূ-পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি কোপারনিকাসের তথ্য বলছে, পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ অঞ্চলে গত জানুয়ারিতে গড়ের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা ছিল। ইউক্রেনে গত ৩০ বছরের গড়ের চেয়ে এবার ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই এমনটা হচ্ছে। কোপারনিকাসের তথ্য আরও বলছে, জানুয়ারিতে পূর্ব ইউরোপ অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় বেশি আর্দ্র ছিল। ইউক্রেনের মাটিও ছিল স্বাভাবিক শীতকালের চেয়ে কিছুটা বেশি ভেজা। বায়ু ও মাটির এ আর্দ্রতার কারণে কুয়াশা ছিল হালকা আর কাদা ছিল বেশি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জার্মানদের বিপাকে ফেলে রাসপুতিৎসা
এমন আবহাওয়া অবশ্য ইউক্রেনের হাইড্রোমেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের ফলিত জলবায়ুবিদ্যা গবেষণাগারের প্রধান স্বিতলানা ক্রাকভস্কাকে অবাক করেনি। সিএনএন’কে তিনি বলেন, জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদী গতিপথ থেকে আমরা যা দেখছি তা হলো, ইউক্রেনে এবার তুষারপাত কম হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উষ্ণতা বাড়ছে। ইউক্রেনে এ বৃদ্ধির হার আরও বেশি।
উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়ন হলো, ইউক্রেনে তাপমাত্রা যত বাড়বে, রুশ হামলার সম্ভাবনা ততো কমবে। গত মাসে জো বাইডেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন মাটি হিম বরফ হওয়ার জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করছেন। মাটিতে বরফ জমলে তিনি হামলা চালাতে পারেন।
এছাড়া পেন্টাগনের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল মার্ক মিলে অপর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইউক্রেনে পানির আধারগুলো বরফে পরিণত হলে রুশ সেনাবাহিনী সীমান্ত পার হতে পারে। বরফ জমা পথ ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য সর্বোত্তম পরিবেশ। বরফ জমলে রুশ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ইউক্রেনে প্রবেশ করার পথ সুগম হবে।
তবে কিছু বিশ্লেষক অবশ্য আবহাওয়াকে প্রধান প্রভাবক হিসেবে মানতে নারাজ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক আরএএনডি করপোরেশনের জ্যেষ্ঠ গবেষক ডারা ম্যাসিকট সতর্ক করে দিয়ে বলেন, রুশ স্থলসেনার জন্য আবহাওয়া অবশ্যই বড় প্রভাবক। তবে এটি কোনো নির্ধারণকারী প্রভাবক নয়। মনে রাখা দরকার যে, রাশিয়া গাইডেড মিসাইল ও যুদ্ধবিমান দিয়ে হামলা চালাতে পারে যা আবহাওয়া দ্বারা প্রভাবিত হয় না।
গত এক বছর ধরে রুশ সেনারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা সব ধরনের আবহাওয়ায় বহু মহড়া চালিয়েছে। এছাড়া অসংখ্য রুশ সেনা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ায় সরাসরি যুদ্ধ করেছে। ফলে উষ্ণ আবহাওয়ায় যুদ্ধ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাদের আছে।
তিনি জানান, ইউক্রেন সীমান্ত শত শত রুশ ট্যাঙ্ক রয়েছে যেগুলো যেকোনো সময় ইউক্রেনে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত। এগুলো ইউক্রেন সীমান্তের খুব কাছে মোতায়েন করা হয়েছে। যদিও জমে যাওয়া আবহাওয়ায় এসব ট্যাঙ্কার ভালো চলাচল করতে পারে তবে কাদাযুক্ত পথেও সেগুলো ইউক্রেনে প্রবেশ করতে পারবে।
আরও পড়ুন-
- ন্যাটো কী এবং কখন কাজ করে
- ইউরোপের যেসব জায়গায় ন্যাটো বাহিনী মোতায়েন
- রুশ আগ্রাসন মোকাবিলায় পূর্ব ইউরোপে শক্তি বাড়াচ্ছে ন্যাটো
- রুশ হামলার সম্ভাব্য তারিখ জানালেন ইউক্রেনের শীর্ষ জেনারেল
সারাবাংলা/আইই