লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ‘গিলে খাচ্ছে’ প্রভাবশালীরা
১৬ এপ্রিল ২০২২ ০০:১৫
মৌলভীবাজার: প্রায় প্রতিনিয়তই পাল্লা দিয়ে বেদখল হচ্ছে দেশের অন্যতম রেইনফরেস্ট লাউয়াছড়া। সংরক্ষিত বনাঞ্চল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত প্রাণ-প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণিতে ভরপুর এই বনের জমি দিন দিন দখল হয়ে যাচ্ছে। এতে খাদ্য সংকটে পড়েছে বন্যপ্রাণিরা। প্রায়ই প্রাণিরা অংশ খাদ্যের সন্ধানে বন থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে গিয়ে আটক হচ্ছে, অনেকসময় মানুষের অসচেতনতায় মারাও যাচ্ছে বিরল ও বিলুপ্ত প্রজাতির এসব বণ্যপ্রাণী।
এছাড়া লাউয়াছড়ার মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা রেললাইনে চলন্ত ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মৃত্যু হচ্ছে অসংখ্য বিরল ও বিপন্ন বন্যপ্রাণীর। অপরদিকে লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে বয়ে চলা অন্য পিচঢালা সড়কেও প্রায়ই হরিণ, বুনো শুকর থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ মারা পড়ছে।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ভানুগাছের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১২৫০ হেক্টর আয়তন নিয়ে ১৯৯৬ সনে লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর থেকেই বনের জমি বেদখল হওয়া ঠেকানো যাচ্ছে না। বনের জমি দখল করে ব্যক্তিমালিকানায় লেবু, আনারসসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করা হচ্ছে। প্রতি বছরই দখলের পরিসর বেড়েই চলছে।
বন ও বন্যপ্রাণী দেখাশুনার জন্য বনবিভাগ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও তারা দেখেও না দেখার ভান করছে ফলে দিন দিন দখলের পরিসরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণিপ্রেমীদের অভিযোগ, বনবিভাগের অসাধু কর্মকতা কর্মচারীদের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে কোনোভাবেই এভাবে বনের জায়গা দখলের কোনো সুযোগ নেই। দখল আর গাছ উজাড় করে স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত থাকায় বন্যপ্রাণির আবাসস্থল সংকটে পড়ার পাশাপাশি উদ্যানের পরিসরও ক্রমাম্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
সরেজমিনে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের দখলকৃত এলাকা ঘুরে জানা যায়, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ডরমিটরি টিলাসংলগ্ন পূর্ব এলাকায় প্রায় ১৫ একর ভূমি দখল করে গত চার বছর ধরে লেবু বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। ডরমিটরি এলাকার পশ্চিম পাশে ‘হিড বাংলাদেশ’ অফিসসংলগ্ন জাতীয় উদ্যানের আরও একটি টিলার প্রায় ১৫ একর ভূমি দখলে নিয়ে লেবু বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। লেবু বাগানঘেষা টিলা সমুহে গাছগাছালি ও লতাগুল্মের সঙ্গে সঙ্গে টিলা কেটে নতুন করে বাণিজ্যিকভাবে আবাদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এসব টিলায় দীর্ঘদিন ধরে টিনসেড ঘর করে লোকজন বসানো হয়েছে দখলকৃত টিলা দেখভালের জন্য।
স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল এসব টিলাভূমি দখলে নিলেও বনবিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন। ফলে উদ্যানে বসবাসরত বন্যাপ্রাণির আবাসস্থল দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে এমনকি পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
স্থানীয়রা জানান, যারা এসব ভূমি দখল করছে তারা এলাকার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আছে। তারা প্রচণ্ড প্রভাবশালী, বনভূমি দখল করে অবৈধভাবে লেবু বাগান গড়ে তুলেছে। এদের কেউ কেউ ইতিপূর্বে জাতীয় উদ্যান সহব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সীমানা নির্ধারণের কাজ বেশ কয়েকবার শুরু হলেও রহস্যজনক কারণে তা মাঝপথেই থেমে যায়। ফলে লাউয়াছড়া প্রকৃত সীমানা আদৌ নির্ধারণ হবে কিনা, অথবা প্রভাবশালীদের দখল থেকে মূল্যবান এসব ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ রয়েছে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘দখলকৃত এলাকা উচ্ছেদ করে কিছু ভূমি ইতোমধ্যে আমাদের আওতায় নিয়ে আসছি। তবে হিড বাংলাদেশসংলগ্ন অফিসের পার্শ্ববর্তী টিলা দখলে নিয়ে টিনসেড ঘরে লোকজনের বসবাস বিষয়টি আমার জানা নেই। আমরা ধীরে ধীরে অবৈধ দখলকৃত ভূমি উদ্ধারের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’
তবে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার এমন মন্তব্য ‘রহস্যজনক’ মনে করছেন প্রাণ ও প্রকৃতিপ্রেমী, পরিবেশবাদীসহ স্থানীয় সচেতন মহল।
তারা বলছেন, ‘দেশের অন্যতম রেইনফরেস্টখ্যাত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান আজ অস্তিত্ব সংকটে। দ্রুতই প্রভাবশালীদের দখল থেকে ভূমি উদ্ধারে ব্যর্থ হলে খুব বেশি দিন বাকি নেই লাউয়াছড়ার মতো দেশের অন্যতম এই রেইনফরেস্টটি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। যা আমাদের তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিশাল হুমকি।’
সারাবাংলা/এমও