ভারতের প্রথম সলোগ্যামি— নিজেকেই বিয়ে করছেন ক্ষমা বিন্দু
৫ জুন ২০২২ ১২:১২
ভারতের গুজরাটের মেয়ে ক্ষমা বিন্দু। বয়স ২৪ বছর। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। ব্লগিংও করেন। আগামী ১১ জুন তার বিয়ে। গুজরাটের ভাদোদারা শহরের এক মন্দিরে হবে সেই বিয়ের অনুষ্ঠান।
বিয়ের জন্য সব প্রস্তুতিই নিয়ে রেখেছেন বিন্দু। বিয়ের আগের দিন তার গায়ে হলুদ এবং সংগীত সন্ধ্যার আয়োজনও রয়েছে। বিয়ের পর দুই সপ্তাহের জন্য গোয়া সমুদ্র সৈকতে মধুচন্দ্রিমার পরিকল্পনাও চূড়ান্ত।
বিন্দু জানাচ্ছেন, বিয়ে এবং এর আগের হলুদ-সংগীত সন্ধ্যায় পরার জন্য কিনেছেন আলাদা আলাদা পোশাক। হাতে পরবেন মেহেদি। অগ্নিসাক্ষী রেখে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারতে সাত পাক ঘুরবেন। এরপর কপালে সিঁদুর পরে হয়ে যাবেন নতুন বউ। সাধারণ একটি হিন্দু বিয়ের যত আয়োজন, তাতে কোনোই কমতি নেই।
বিয়ের সব আয়োজন স্বাভাবিকভাবে চললে বিন্দুর এই বিয়ে আর দশটি বিয়ে থেকে একেবারেই আলাদা৷ স্বাভাবিকভাবে বিয়ে মানেই নারী-পুরুষের বন্ধন। অধুনা সমকামী বিয়ে নারী-নারী কিংবা পুরুষ-পুরুষ বিয়ের নজিরও নতুন নয়। তবে বিন্দু এমন ব্যতিক্রমী বিয়েকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। কারণ, তিনি বিয়ে করতে যাচ্ছেন নিজেকে!
হ্যাঁ, বিন্দু যখন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারতে সাত পাক ঘুরবেন, তার সঙ্গে থাকবেন না আর কেউ। বিয়ের পর সিঁদুরও তিনি নিজেই পরাবেন নিজেকে! বিয়ে বললেই যে আজীবনের বন্ধনের কথা সামনে আসে, বিন্দু যে সেই বন্ধনে আবদ্ধ হবেন নিজের সত্তার সঙ্গেই!
নিজেকেই নিজে বিয়ে করার এ ঘটনাকে বলা হয়ে থাকে ‘সলোগ্যামি’। পশ্চিমা বিশ্বে গত দুই দশকে এমন বিয়ের উদাহরণ দেখা গেলেও বিন্দুই সম্ভবত ভারতে প্রথম ‘সলোগ্যামি’র নজির রাখতে যাচ্ছেন।
বিন্দু বিবিসিকে বলেন, লোকজন আমাকে বলে, তুমি তো দারুণ। যে কাউকেই পেতে পারো। আমি নিজেকেই পেয়েছি৷ নিজের প্রতি আমার যে প্রেম, বিয়ের মাধ্যমে আমি সেই আত্মপ্রেমেই নিবেদন করব নিজেকে।
প্রতিটি মানুষের মধ্যে ভালো গুণের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের দোষও থাকে। বিন্দু মনে করেন, নিজেকে বিয়ের মাধ্যমে সেই দোষগুলোকেও মেনে নেবেন তিনি। আর নিজেকে নিঃশর্ত ভালোবাসার মাধ্যমে নিজ সত্ত্বার পূর্ণ বিকাশের বিষয়টি তো রয়েছেই।
বিন্দু বলেন, নিজেকে বিয়ে করা মানে নিজের সঙ্গেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া। জীবিকা ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিজের মতো করে বেছে নেওয়ার মাধ্যমে নিজেকে সজীব ও সুন্দর রাখা এবং সুখি করার সুযোগ মিলবে। আমার মধ্যেই এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলো আমার নিজেরই পছন্দ নয়। আমার শারীরিক, মানসিক বা আবেগীয় অনেক দুর্বলতা রয়েছে যেগুলো আমি ধারণ করতে চাই না। নিজেকে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে এই বিষয়গুলোকেও আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। মোট কথা, আমার যা কিছু অসুন্দর সেগুলোকে মিলিয়ে আমার গোটা সত্তাকেই আমি নিজের বলে মেনে নিচ্ছি।
ক্ষমা বিন্দুর এই বিয়ে স্বাভাবিকতার বাইরে হলেও তার পরিবার থেকে খুব একটা আপত্তি আসেনি। বিয়ের দিন পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত হয়ে তাকে আশীর্বাদও করবেন। বিন্দু বলছেন, তার মা বিষয়টিকে বিন্দুর সবসময় নতুন কিছু করার সঙ্গেই তুলনা করেছেন। অন্যদিকে বিন্দু নিজে এই বিয়েতে খুশি হলে তার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও সমস্যা নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বিবিসির খবর বলছে, প্রায় দুই দশক আগে সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি সিরিজের চরিত্র ক্যারি ব্র্যাডশ প্রথম সলোগ্যামি বা নিজেকে বিয়ের ধারণার কথা বলেন। সেটি কমেডি শো হলেও বাস্তবে এখন পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে সলোগ্যামি নিয়মিতই আয়োজন হয়ে আসছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবশ্য নিজেকে বিয়ে করছেন তরুণীরা। শুধু তাই নয়, ব্রাজিলের ৩৩ বছর বয়সী এক মডেল নিজেকে বিয়ে করার তিন মাস পর আবার নিজেই নিজেকে তালাকও দিয়েছেন।
তবে ভারতের জন্য একেবারেই নতুন ধরনের এই বিয়ে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অনেকেই বিষয়টিকে সাধুবাদ জানালেও কেউ কেউ এটি মেনে নিতে পারছেন না। এক তরুণী তো বুঝতেই পারছেন না, অন্য কারও সংযোগ না থাকায় বিয়ে নামের এই ‘আদিখ্যেতা’র দরকার কী! অনেকেই আবার মনে করছেন, পরিবার-সংসারের দায়িত্ব এড়াতেই এই পথ বেছে নিয়েছেন বিন্দু। কেউ আবার একে ‘অদ্ভুতুড়ে’ অভিহিত করে ‘ক্রনিক নার্সিসিজম’ বা ‘তীব্র আত্মপ্রেমে’র সঙ্গে তুলনা করছেন।
চণ্ডীগড়ের পিজিআইএমইআর হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. সবিতা মালহোত্রাও সলোগ্যামির ধারণাকে বিচিত্র বলে মনে করছেন। তিনি বলেন, সবাই তো নিজেকে ভালোবাসেই। এটিই স্বাভাবিক। সেই আত্মপ্রেম সবাইকে দেখানোর জন্য আলাদা করে এরকম কিছু করে দেখানোর দরকার আছে বলে মনে করি না। আর বিয়ে মানে তো দুইটি সত্তার একীভূত হওয়া। এখানে সেটি হচ্ছে কই!
এত সব আলোচনা-সমালোচনাকে একদমই গায়ে মাখতে নারাজ ক্ষমা বিন্দু। তিনি বলছেন, কোনো পুরুষ নাকি নারী, নাকি আমার নিজেকেই আমি বিয়ে করব, সেটি একান্তই আমার সিদ্ধান্ত। নিজেকে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে আমি সলোগ্যামিকেও স্বাভাবিক করে তুলতে চাই। আমি সবাইকে বলতে চাই— আমরা পৃথিবীতে একা এসেছি। আর এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ছেড়েও যেতে হবে একা একাই, কেউ সঙ্গী হবে না। তাই নিজের চাইতে নিজেকে আর কে বেশি ভালোবাসতে পারে? দুঃসময়েও নিজের চাইতে কে আর বেশি নিজের পাশে দাঁড়াতে পারে?
সারাবাংলা/টিআর