সবকিছুই পুড়ে ছাই, বাকি ছিল শুধু সিঙ্গারা
১৭ আগস্ট ২০২২ ২১:২৭
ঢাকা: বিস্ফোরণের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে চেয়ার টেবিল, ফ্যান, হাড়ি পাতিল, তৈজসপত্র, জগ, গ্লাস, ডেকোরেশন, মাথার ওপর তৈরি করা ছাদসহ সবকিছুই। পুড়েছে জলজ্যান্ত ছয়টি প্রাণও। শুধু পোড়ানোই নয়, একে একে অঙ্গার করে দিয়েছে। তবে আগুন সবকিছু পোড়াতে পারলেও এক প্লেট সিঙ্গারাকে ছুঁতে পারেনি। ভস্মীভূত পরিবেশে শুধুমাত্র ওই সিঙ্গারাই যেন একটি হোটেলের সাক্ষী।
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের দ্বি-প্রহরে রাজধানীর চকবাজারের দেবীদাস লেনের কামালবাগের বরিশাল হোটেলে হঠাৎ এক বিস্ফোরণ ঘটে। যে বিস্ফোরণে নিভে গেছে ছয়টি প্রাণ। ধ্বংস হয়েছে হোটেলের সবকিছু। হোটেলের মেঝেতে পড়েছিল বিভিন্ন ধরনের খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ, ভাঙা কাচ, অ্যাডজাস্ট ফ্যানের চুর্ণ বিচুর্ণ টুকরো, আর ভস্মীভুত ছাই। কিন্তু সিঙ্গারা যেন অক্ষত রয়ে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী আল আমিন সারাবাংলাকে জানান, তিনি সকাল ১১টার দিকে সবজি আর পরেটা দিয়ে নাস্তা করে গেছেন বরিশাল হোটেল থেকে। আর ১২ টার দিকে তিনি বিকট আওয়াজের শব্দ শুনতে পান। এর পর দৌড়ে আসেন তিনি। দেখতে পান দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। যেন আগুনের কুণ্ডলি।
তিনি বলেন, ‘নাস্তা করার সময় চুলার কাছে দু’জন ছিলেন। ভেতরে ছিলেন দু’জন আর ক্যাশ টেবিলে একজন। ওপরে কারা ঘুমিয়েছিল তা জানি না। এই হোটেল যেহেতু সারারাত চলে তাই যারা রাতে ডিউটি করেছেন তারা ঘুমিয়ে থাকতে পারেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘চকবাজার আর পুরান ঢাকা দিনের চেয়ে রাতের বেলায় জমে ভালো। এজন্যই রাতের বেলা বেশি জমজমাট থাকতো বরিশাল হোটেল। পাশেই সোয়ারী ঘাটের পাইকারি মাছ বাজার। এছাড়া আশেপাশের কারখানা চালু থাকায় রাতে বরিশাল হোটেল জমজমাট থাকে। তাছাড়া আশেপাশে তেমন কোনো হোটেলও নেই।’
বরিশাল হোটেলের পাশের জুতার সোলের পাইকারি দোকানের মালিক কাজী ইমদাদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিস্ফোরণের শব্দ শুনেই আমরা বের হয়েছি। এরপর দেখি হোটেলে আগুন। যারা কাজ করছিলেন তারা দৌড়ে বের হয়েছে। কিছু ছেলে পেলে ভেতরে ওপরে ঘুমাচ্ছিল- তা ভবনের মালিক রানাকে জানিয়েছি। কিন্তু রানা বলেছে, হোটেল মালিক ফখরুদ্দিন তাকে জানিয়েছেন, তার ছেলেরা সব বের হয়ে গেছে। একজনকে পাওয়া যাচ্ছে না, তাকে খোঁজা হচ্ছে। এরপর তো বিকেলে দেখলাম ছয় জনের মরদেহ।’
আরও পড়ুন:
- চকবাজারে আগুনে গেল ৬ প্রাণ
- আগুন লাগা ভবনে ১ বছর আগেও লাখ টাকা জরিমানা করা হয়
- চকবাজারে আগুনে নিহতদের লাশ ডিএনএ পরীক্ষার পর হস্তান্তর
- চকবাজারে আগুন: হোটেলে ঘুমিয়ে ছিলেন ৪/৫ জন, মিলছে না খোঁজ
- চকবাজারে পলিথিন কারখানায় আগুন, ঘটনাস্থলে ফায়ারের ১০ ইউনিট
- খাবার হোটেল থেকে আগুন ছড়ায় খেলনা কারখানায়, ২ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে
শুরুতেই ফায়ার সার্ভিসকে বিষয়টি বললে হয়তো কেউ কেউ বেঁচেও যেত বলে মনে করেন তিনি। শুধুমাত্র বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল বলে অভিযোগ তার।
ঘটনার দিন সরেজমিনে দেখা গেছে, ধ্বংসস্তুপের ওপর পানির ফোটা পড়ছে এক নাগারে। রাস্তার কাছে চুলার পাশে একটি বড় প্লেটে পড়ে আছে কিছু সিঙ্গারা। পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্রের স্তুপ যেন পাহাড় সমান মনে হচ্ছে। তার ওপর ধোঁয়ার কুণ্ডলি যেন সকলের চোখ অন্ধকার করে দিচ্ছিল। এর মধ্যেও ওপরে বিশেষ কৌশলে করা ছাদে যে মৃতদেহ জ্বলছিল তা কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর একজনের স্বজন দৌড়ে উপরে উঠলেন। সেখানে গিয়ে বলতে লাগলেন, ‘এই যে আমার খালাতো ভাইয়ের শরীর। সব পুড়ে গেছে। এই যে হাত ও পা জ্বলছে। শুধু হাড্ডি বের হয়ে আছে।’ এরপরই মূলত সবাই জানতে পারে হোটেলের উপরের ঘরে নিহতদের পোড়া দেহ পড়ে আছে।
এদিকে, প্রত্যক্ষদর্শীরা অবাক চোখে সিঙ্গারার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। তারা বলেন, হোটেলে শুধু পোড়ার বাকি রয়েছে কয়েকটি সিঙ্গারা। তাছাড়া সবকিছুই পুড়ে গেছে। এছাড়া পুরো সময়টাতে দেখা গেছে, সাধারণত মানুষের মরদেহ পুড়তে থাকলে এক ধরণের পোড়া গন্ধ আসে। যা সাধারণ কোনো গন্ধ নয়। কিন্তু এতগুলো মৃতদেহ পুড়ছিল তাতে কেউ কোনো গন্ধ পায়নি। কী কারণে কোনো গন্ধ বের হয়নি তা কেউ বলতে পারছে না।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগুন লাগার শুরুতে কেউ মিসিংয়ের বিষয়ে তথ্য দিলে হয়তো তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হতো। আগুন নিয়ন্ত্রণের পর বিকেল ৪টার দিকে ডাম্পিংয়ের সময় বুঝতে পারি সেখানে মরদেহ রয়েছে। এরপর আমরা একে একে ছয়টি মৃতদেহ উদ্ধার করি।’
সাধারণত মৃতদেহ পোড়ার সময় এক ধরনের উৎকট গন্ধ বের হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে হয়নি কেন?— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগুন নিচ থেকে ওপরের দিকে গেছে। একই সঙ্গে ধোঁয়াও ওপরের দিকে গেছে। তাই নিচের দিকে বাইরের কেউ কোনো গন্ধ পায়নি। তাছাড়া আগুনটা অনেক বেশি গভীর ছিল। যার কারণে শরীরের মাংস ওই সময়েই পুড়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে গন্ধ যতটুকু ছিল তা ধোঁয়ায় ওপরের দিকে বের হয়ে গেছে।’
এদিকে বুধবার (১৭ আগস্ট) ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নুর তাপস ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছেন, ‘আমরা এসব স্থাপনা গড়ার ক্ষেত্রে পারমিশন বন্ধ রেখেছি। কিন্তু অন্যান্য সংস্থাগুলো যেমন গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইন কীভাবে হলো সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। অনুমতি ছাড়া কীভাবে একটি কারখানার মধ্যে এরকম একটি হোটেল গড়ে উঠল তা দেখার সময় এসেছে।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম