রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতেই হবে: প্রধানমন্ত্রী
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০০:৩৬
ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সবাইকে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে হবে যে, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের অবশ্যই দেশে ফিরে যেতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে পরিস্থিতি। আমাদের পক্ষে আর কোনো লোক নেওয়া সম্ভব নয়। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।
মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সম্প্রচারিত ওয়াশিংটনে ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) বাংলা সার্ভিসের সঙ্গে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন। এ সফরে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে ভাষণ দেয়াসহ নানা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সময় অনুযায়ী শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকারটি নেয় ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগ। প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শতরূপা বড়ুয়া।
রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের বার বার আহ্বানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এত বিশাল জনসংখ্যার (সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা প্রায়) দায়িত্ব একা একটি দেশের পক্ষে নেওয়া অসম্ভব। শুধু আশ্রয় দেওয়াই নয়, এত বিশাল জনসংখ্যার জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করাও একটি বড় দায়িত্ব। যা কোনো দেশ একা বহন করতে পারে না।’
তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞা এবং চলমান কোভিড-১৯ এর কারণে সমগ্র বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হচ্ছে, যা বিশ্ববাসীকে চরম ভোগান্তিতে ফেলেছে। তিনি বলেন, ‘যারা (রোহিঙ্গাদের) সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল (স্থানীয় জনগণ), তারা এখন নিজেদের বেঁচে থাকায় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য কতটা আর করতে পারে। কারণ, এর বিশাল জনসংখ্যা রয়েছে এবং দেশটিকে তার জনগণের কথাও ভাবতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোররা এখন ঘিঞ্জি বস্তিতে (রোহিঙ্গা ক্যাম্প) লালিত-পালিত হয়ে বড় হচ্ছে। যেখানে মানবিক মূল্যবোধ ও সুস্থ স্বাস্থ্যের সঙ্গে বেড়ে ওঠার সুযোগ খুবই সীমিত।’ বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে আর কোনো লোক নেওয়ার অবস্থানে নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান কক্সবাজারের বন ধ্বংস করেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিনষ্টের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা স্থানীয়দের চরম দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে। এলাকার আবাদি জমি ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘অনেক রোহিঙ্গা মানবপাচারের পাশাপাশি মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছে এবং ক্যাম্পের ভেতরে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে।’
এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতার সময় হত্যা ও ধর্ষণসহ অমানবিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীকে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কাজেই আজ তারা (বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা) যখন একই ধরনের নির্যাতনের শিকার, সে কথা চিন্তা করেই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দেয়।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ১৬ কোটি বাংলাদেশির পাশাপাশি কয়েক লাখ মানুষের (রোহিঙ্গাদের) দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তার ছোট বোন শেখ রেহানার আবেদনের কথাও স্মরণ করেন। শেখ রেহানাকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘আপনি ১৬ কোটি লোককে খাওয়াতে পারেন, আর কয়েক লাখ লোকতে খাওয়াতে পারবেন না?’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি ইতিবাচক জবাবে বলেছেন, প্রয়োজনে বাংলাদেশিরা একবেলা খাবার খেয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরেক বেলার খাবার ভাগ করবে। বাংলাদেশি জনগণ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রচুর খাবার নিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।’
সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট ছাড়াও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নানা অভিযোগ, মিডিয়ার স্বাধীনতা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণের পথে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ, গৃহহীনদের জন্য নেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ তার সরকারের নানা কল্যাণমুখী নীতি ও কর্মসূচি, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে প্রতিবন্ধী, ট্রান্সজেন্ডারদের কল্যাণে নেওয়া নানা পদক্ষেপ, জিয়া-এরশাদ আমলের সামরিক শাসন, আগামী নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে তৎকালীন পাকিস্তান গোয়েন্দাদের গোপন রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত সিক্রেট ডকুমেন্টস বইটির সম্পাদনা ও প্রকাশনার প্রেক্ষাপট নিয়েও তিনি কথা বলেন। জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদির ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ কীভাবে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হয়ে উঠতে পারে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার পরিকল্পনা ও স্বপ্নের কথাও তুলে ধরেন।
আওয়ামী লীগ মানবাধিকার সংরক্ষণ করে
মানবাধিকার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তার সরকার শুধু মানবাধিকার রক্ষা করেনি, মানবাধিকার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেও তা সংরক্ষণ করেছে। বাংলাদেশে একটি মানবাধিকার কমিশন রয়েছে এবং তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্ত করে থাকে। আমরা সবসময় (অভিযোগের) তদন্ত করছি। কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এমনকি এটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য দ্বারা সংঘটিত হলেও, যা অতীতে দেখা যায়নি।’
বিএনপির ঢালাও অভিযোগের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘তারা অনেক কথা বলার পর ৭০ জনের একটি তালিকা জমা দিয়েছে (কথিতভাবে নিখোঁজ)। তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ লোককে পরবর্তী সময়ে বিএনপির মিছিলে পাওয়া গেছে এবং কেউ কেউ তাদের ব্যক্তিগত কারণে আত্মগোপন করেছে এবং সাতটি ঘটনায় দেখা গেছে তারা মারা গেছেন।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর পাশাপাশি শত শত বিমানবাহিনী-সেনা অফিসার ও সৈনিককে হত্যা করেছিলেন। নিহতদের মৃতদেহ কখনই পাওয়া যায়নি। এমনকি তাদের স্বজনরাও জানতে পারেননি তাদের কী অপরাধ ছিল।’ তিনি বলেন, ‘যারা এখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলছে, তারা ওই সময় বিচারও চাইতে পারেননি।’
গণমাধ্যম অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলে গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে এবং তারা যা খুশি বলার স্বাধীনতা ভোগ করছে। সবকিছু বলার পর কেউ যদি বলে যে তাকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না, তার উত্তর কী হবে? এটাই আমি জানতে চাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে মাত্র একটি টিভি ও একটি রেডিও স্টেশন ছিল। যেগুলো ছিল সরকারের পরিচালনাধীন। ক্ষমতায় আসার পর বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। দেশে এখন অনুমোদিত ৪৪টি টিভি চ্যানেলের মধ্যে ৩২টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল চালু রয়েছে। লোকজন টেলিভিশন টকশোতে অংশ নিচ্ছে। এবং তারা স্বাধীনভাবে কথা বলছে- সত্য বা মিথ্যা। এবং তারা সরকারের সমালোচনাও করছে।’ কিন্তু দেশে সামরিক শাসকদের আমলে মানুষের কথা বলা বা চলাফেরার স্বাধীনতাটুকুও ছিল না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে স্বাধীন ইসি
শেখ হাসিনা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন (ইসি) যাতে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করতে পারে তার জন্য সরকার সবধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এবং আইন অনুযায়ী কমিশন গঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ছিল। আমরা এটিকে কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করে দিয়েছি।’ কমিশনকে আর্থিক স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য একটি পৃথক বাজেট বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন সরকার কমিশনের বাজেট প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তারা তাদের ইচ্ছে মতো অর্থ ব্যয় করতে পারে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। ওই সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় কারসাজি করেছিলেন খালেদা জিয়া। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিজেদের লোক নিয়োগের জন্য প্রধান বিচারপতির বয়স দুই বছর বাড়িয়ে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করেছিল। বিএনপি সরকার নির্বাচনে কারচুপির লক্ষ্যে ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে ভোটার তালিকা তৈরি করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কোনো রাজনৈতিক দল ছাড়াই ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছিল। এবং খালেদা জিয়া নির্বাচনের দেড় মাসের মাথায় জনগণের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের নির্বাচনি আইন লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় এসে দুই সামরিক স্বৈরশাসক বিএনপি ও জাতীয় পার্টি গঠন করেছে।’
আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, ‘বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি দুটি দলের জন্ম অবৈধভাবে, সংবিধান লঙ্ঘন করে, ক্ষমতা দখলকারি সামরিক শাসকদের হাত ধরে।’ সরকারপ্রধান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সংগ্রামের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে বলে জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে তারা কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেবে না। জনগণ ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করবে।’ জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট না দিলে বলার কিছু নেই বলেও জানান শেখ হাসিনা।
সারাবাংলা/পিটিএম
আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী ভয়েজ অব আমেরিকা মিয়ানমার রোহিঙ্গা শেখ হাসিনা