ঢাবির সাবেক শিক্ষকের গাড়ির চাকায় মৃত্যুযাত্রা
২ ডিসেম্বর ২০২২ ২০:৪৬
ঢাকা: ধাক্কা দিয়ে মোটরসাইকেল থেকে ফেলে দেওয়ার পর গাড়ির নিচে চাপা পড়া নারীকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে ছুটল এক প্রাইভেটকার। এতে গুরুতর আহত ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় প্রাইভেটকার চালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক এক শিক্ষককে গণধোলাই দিয়েছে ক্ষুব্ধ জনতা।
শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) বেলা ৩টার দিকে মোটরসাইকেল আরোহী ওই নারীকে চারুকলা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন শাহবাগ এলাকায় ধাক্কা দেয় প্রাইভেটকারটি। ঘটনার সময় ওই নারী মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ছিলেন।
শাহবাগ থানা পুলিশ জানিয়েছে— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক জাফর শাহ প্রাইভেটকারটি চালাচ্ছিলেন। শাহবাগ এলাকায় ওই নারীকে চাপা দেওয়ার পর প্রাইভেটকারটি টিএসসি হয়ে নীলক্ষেতের দিকে চলে যায়। এ সময় আহত নারীটিকে টেনে-হিঁচড়ে এক কিলোমিটারের বেশি নিয়ে যায় চলন্ত প্রাইভেটকারটি।
পরে উত্তেজিত জনতা ধাওয়া দিয়ে নীলক্ষেত মোড়ে প্রাইভেটকারটি আটকায়। এ সময় গাড়ির চালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক জাফর শাহ ক্ষুব্ধ জনতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হাতে গণধোলাইয়ের শিকার হন।
দুর্ঘটনার শিকার গৃহিণী রুবিনা আক্তারকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে অল্পকিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু হয় তার।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, গণপিটুনিতে ঢাবির সাবেক শিক্ষক জাফর শাহ’র অবস্থাও গুরুতর।
ঘটনাপ্রবাহ: প্রত্যক্ষদর্শী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে জানান, বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শাহবাগ থেকে মোটরসাইকেলযোগে আসছিলেন রুবিনা আক্তার। তার দেবর নুরুল আমিন মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন আর পেছনে বসা ছিলেন ওই গৃহবধূ।
এ সময় সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দিলে রুবিনা নিচে পড়ে যান। পরে গাড়ির সামনের দিকের বাম চাকায় আটকে পড়েন তিনি। ওই নারী চাকায় আটকা পড়া অবস্থাতেই চালক গাড়ি না থামিয়েই টিএসসি থেকে নীলক্ষেতগামী রাস্তার দিকে গাড়ি চালাতে থাকেন।
আশেপাশের প্রত্যক্ষদর্শীরা চিৎকার করে প্রাইভেটকারটি থামাতে বললেও চালক গতিরোধ করেননি। পরে কয়েকটি মোটরসাইকেল নিয়ে চালকের পিছু নেন শিক্ষার্থীরা। নীলক্ষেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণ-সংলগ্ন জায়গায় ট্রাফিক জ্যাম বাধায় প্রাইভেটকারটি সেখানে আটকা পড়ে।
পরে উপস্থিত জনতা প্রাইভেটকার চালক জাফর শাহকে গণধোলাই দেন।
এদিকে, টিএসসি থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত রাস্তায় প্রায় আধা কিলোমিটার জুড়ে বিভিন্ন স্থাকে রক্ত ও রুবিনার শরীরের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন অংশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।
যা বলছেন মোটরসাইকেল চালক: ওই নারীর দেবর নুরুল আমিন জানান, তাদের বাসা হাজারীবাগের সেকশন এলাকায়। তেঁজগাও থেকে ভাবীকে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। মোটরসাইকেলটি শাহবাগ মোড়ে এলে একটি প্রাইভেটকার তাতে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে তার ভাবী মোটরসাইকেল থেকে প্রাইভেটকারের সামনে ছিটকে পড়েন। তখন তার ভাবীর কাপড়চোপড় প্রাইভেটকারের সামনের বাম্পারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এরপরও প্রাইভেটকারটি না থেমে তার ভাবীকে টিএসসি হয়ে নীলক্ষেত পর্যন্ত টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায়।
শাহবাগ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ জানান, একটি প্রাইভেটকার নারীকে টেনে-হিঁচড়ে অনেক দূরে নিয়ে যায়। হয়ত তার পরনের জামাকাপড় ওই প্রাইভেটকারের সঙ্গে আটকে গিয়েছিল।পরে উত্তেজিত জনতা গাড়টি ভাঙচুর করে। এ সময় প্রাইভেটকারের চালক জাফর শাহ গণধোলাইয়ের কবলে পড়েন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. বাচ্চু মিয়া জানান, চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে। তার মরদেহ মর্গে পাঠানো হয়েছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রব্বানী জানান, ২০০৭/২০০৮ সালের দিকে নৈতিক স্খলনের কারণে ওই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
শিক্ষার্থীদের ক্ষোভপ্রকাশ: ঘটনার একটি ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে মুখ খুলেছেন অনেক শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাতেমা কলি ফেইসবুকে লেখেন, ‘টেনে-হিঁচড়ে নেওয়া নারীটি আমিও হতে পারতাম। কিংবা আমার সহপাঠীদেরও কেউ হতে পারত। আমাদের এখনই আওয়াজ তোলা উচিত। অবশ্যই উচিত। ঢাবি কর্তৃপক্ষের উচিত নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা।’
অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন , ‘স্বাভাবিক দিনেই মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসের ভেতর ট্রাফিক জ্যাম পড়ে। প্রতিদিনই গাড়ির চাপ থাকলেও এ বিষয়ে প্রক্টরিয়াল টিমের কোনো মাথাব্যথা নেই। মাঝেমধ্যে মনে হয় এইটা বিশ্ববিদ্যালয় না, এইটা আসলেই একটা চিড়িয়াখানা।’
এদিকে চলমান ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি জায়গায় বড় পর্দায় খেলা দেখার আয়োজন করা হয়েছে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মতো দলগুলোর ম্যাচ দেখতে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয় এই এলাকায়। বিভিন্ন এলাকা থেকে শতশত মোটরসাইকেল প্রবেশ করে বলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জ্যাম বাঁধে।
নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবি: বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিত্যদিন গাড়ির চাপ থাকার বিষয়কে হুমকি মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আবু রায়হান লেখেন, ‘এই যে রাত ১ টায় ব্রাজিলের ম্যাচ পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে যাবে একখানা চিড়িয়াখানা। সঙ্গে আরও থাকবে উচ্চগতির বাইক এবং গাড়ি। হর্ন বা অন্যান্য আওয়াজের কথা বাদই দিলাম। এইটা শুধুমাত্র খেলার জন্যই না। স্বাভাবিক দিনেই মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসের ভিতরে জ্যাম পড়ে যায়। বিশেষ করে আজকে যেখানে এক্সিডেন্ট হলো সেই তোরনে প্রতিদিন জ্যাম থাকে। আজকের ভিক্টিমের জায়গায় কাল আপনি বা আমিও থাকতে পারি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে প্রক্টোরিয়াল টিমের এই ব্যাপারে কোনো মাথা ব্যথাই নাই। মাঝেমধ্যে মনে হয় এইটা একটা বিশ্ববিদ্যালয় না, এইটা আসলেই একটা চিড়িয়াখানা।’
ওই শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘শুক্রবার আর শনিবার এই ক্যাম্পাসকে গুলিস্তান থেকে আলাদ করার কোনো উপায় নেই। কিছু কিছু জায়গা (টিএসসি) তো গুলিস্তানের থেকেও বেশি জনবহুল। উচ্চগতির যানবাহন যারা চালাচ্ছে তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউই না।’
সারাবাংলা/আরআইআর/একে