‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়েই জাতির পিতার রক্তের ঋণ শোধ করব’
১০ জানুয়ারি ২০২৩ ২৩:০১
ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি বলেছিলাম এদেশ স্বাধীন করে ছাড়ব, আজ দেশ স্বাধীন।’ তিনি বলেছিলেন, ‘রক্ত দিয়ে হলেও এ রক্তের ঋণ আমি শোধ করে যাব। লাখো শহিদ রক্ত দিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছে, একজন বাঙালি বেঁচে থাকতেও এদেশের স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশ পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে বেঁচে থাকবে, বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ তিনি তার রক্ত দিয়ে ঋণ শোধ করে গেছেন। এখন আমাদের পালা। আমাদের কর্তব্য তার রক্তের ঋণ শোধ করা। যেদিন গৃহহীন গৃহ পাবে, দেশের মানুষকে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দিতে পারব। সেটাই হবে রক্তের ঋণ শোধ করা। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়েই জাতির পিতার রক্তের ঋণ শোধ করব।
মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) একাদশ জাতীয় সংসদের ২১তম অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে সংসদে কার্যপ্রণালী বিধি-১৪৭ অনুযায়ী এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে সংসদের সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন, প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান আমির হোসেন আমু, বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সরকারি দলের অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, নূরুল ইসলাম নাহিদ, মোস্তাফিজুর রহমান, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও রওশন আরা মান্নান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি শপথ করছি, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ব। সেটাই হবে জাতির পিতার রক্তের ঋণ শোধ করা। দেশের অগ্রযাত্রা কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে জাতির পিতা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে রেখে গেছেন। জিডিপি ৯ শতাংশে নিয়ে গিয়েছিলেন। কেউ এখনও তা স্পর্শ করতে পারেনি। আমরা ক্ষমতায় এসে ৮ শতাংশ পর্যন্ত নিতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে অনেক আগেই বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হতো।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র তিন বছর পর ১৯৭৩ সালে নির্বাচন দিয়ে জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন জাতীয় ঐক্য, মানুষের উন্নয়ন। তিনি চেয়েছিলেন দারিদ্রমুক্ত, উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ। এদেশের মানুষ যাতে দু’বেলা দু’মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকে।’
শেখ হাসিনা বলেন, “অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন এরশাদ, জিয়া, মোস্তাক। কই তারা তো মানুষের উন্নয়ন দেশের উন্নয়ন করে যেতে পারেনি। অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশের মানুষ খেতে পায়, দেশের উন্নয়ন হয়।’ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যার্বনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘ভুট্টো তার নিজের স্বার্থে টিকে থাকার জন্য এবং ভারতীয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রধানদের পাকিস্তানকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টির কথা বলেন। এর পর ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান। তিনি প্রথমেই লন্ডন যান। আমার মা শুধুমাত্র বলতে পেরেছিলেন, ‘তুমি কি বেঁচে আছো?’ আর কোনো কথা মা বলতে পারেননি। ১০ জানুয়ারি তিনি ভারত ঘুরে দেশে ফিরে এসে প্রথমে পরিবারের কাছে না গিয়ে জনগণের কাছে যান।”
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ৯ মাস বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি ছিলেন। তাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য কারাগারে কবরও খোঁড়া হয়। আমাদের এ যুদ্ধ কিন্তু জনযুদ্ধ ছিল। সেইসঙ্গে ভারতের মিত্রবাহিনীও আমাদের সাথে সাথে যুদ্ধ করেছে। হাজার হাজার ভারতীয় সেনাও মারা যান।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা দেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা, দেশের মানুষের মুক্তি চেয়েছিলেন, শোষিত বঞ্চিত মানুষের রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। এই বঞ্চিত মানুষগুলোর মুখে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে চেয়েছিলেন।’
আমির হোসেন আমু বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে বলেছিলেন, আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে যদি অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে না পারি। তিনি শূন্য হাতে শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে কী পেয়েছিলেন? রাস্তা নেই, ব্রিজ নেই, রেল নেই, খাদ্যগুদামে খাদ্য নেই, রিজার্ভ নেই, ব্যাংকে টাকা নেই- এমন একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম শুরু করেন।’
তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু না জন্মালে আমরা এ দেশ পেতাম না, স্বাধীন পতাকা পেতাম না। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন এদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) বাঙালিদের না। সেজন্য তিনি বার বার বাঙালি জাতিকে সবদিক থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি দেশের মানুষের মুক্তির জন্য যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারই নির্দেশে বাঙালি জাতি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।’
শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার জেলখানায় বন্দি করে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু ভারতসহ বিশ্ব জনমতের চাপে তারা সেটা করতে পারিনি। তার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে বাঙালিরাই হত্যা করে। এর পরে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করে দেশকে পিছিয়ে নেওয়া হয়।’
রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মানুষকে খুব বিশ্বাস করতেন। আর সেই বিশ্বাসের মূল্য দিতে হয় তাকে জীবন দিয়ে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে স্বাধীনতা পূর্ণতা পেয়েছিল। যারা ভেবেছিল, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারতের উপনিবেশ হবে। সে ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।’
হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কোনো মিটমাট নয়। ওদের সঙ্গে কোনো আপস নয়। ওদের ধ্বংস করেই সামনে এগুতে হবে। আরেক ধাপ সামনে এগুতে হলে ওদের ধ্বংস করতেই হবে।’
সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি-১৪৭-এর প্রস্তাবনায় বলা হয়, সংসদের অভিমত এই যে, ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালির জাতীয় জীবনে এক বিশেষ মহিমান্বিত দিবস। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ২৪ দিন পর পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব। বাঙালি জাতির জীবনে ১০ জানুয়ারি একটি বিশেষ তাৎপর্যবহ দিন। এই দিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে, তার আদর্শকে বুকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করা হোক।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম