মাদকচক্রে যশোরের শিক্ষার্থীরা, ডোপ টেস্টের প্রস্তাব
১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৩৩
যশোর: যশোরের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকাণ্ডে হতাশ সুধীজনরা। মাদক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শহর কী গ্রাম, মাদকের বিস্তার এতই বেশি যে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও জড়িয়ে পড়ছে মাদক সেবন চক্রে। এ নিয়ে জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটিতে প্রস্তাব উঠেছে শিক্ষার্থীদের ডোপ টেস্ট করানোর। গেল ডিসেম্বরে জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মিটিং এই ডোপ টেস্টের প্রস্তাব দেন সভায় উপস্থিত কয়েকজন সদস্য।
২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর একটি আভিযানিক হাজির হয় যশোর সদর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম খিতিবদিয়ায়। ওই গ্রামের বাসিন্দা মিন্টু বিশ্বাসের বসত বাড়ির উঠোন থেকে জব্দ করা হয় গাঁজার গাছ। আটক হন মিন্টু বিশ্বাস। মামলাও হয় তার নামে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর যখন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরছে তখন শহরের অলি গলি পাড়া মহল্লায় চলছে মাদকের রমরমা কারবার। হরেক নামে, নানা কৌশলে চলছে মাদকের বিকিকিনি। সচেতন অভিভাবকরা বলছেন, প্রশাসনের উচিত কলেজ ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের ডোপ টেস্ট করানো।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর যশোরের ২০২২ সালের পরিসংখ্যান বলছে, বছরে অভিযান চলেছে ২ হাজার ২৬৭টি। এ সব অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ৪৮টি গাঁজা গাছ, ৬৬ কেজি ৬২ গ্রাম গাঁজা, ১০ হাজার ১৯৬ পিস ইয়াবা, ৪২৪ বোতল ফেনসিডিল, ২ হাজার ৯২৪ পিস ট্যাপেন্টডল ট্যাবলেট, ৬ হাজার লাল বর্ণের ট্যাবলেট, ১৫ লিটার চোলাই মদ, ৪০ লিটার তাড়ি, আরএস ২৮৮ বোতল, ভারতীয় মদ ১২০০ গ্রাম ও ৮ গ্রাম হেরোইন। উদ্ধার করা হয় ৪ লাখ ৯২ হাজার নগদ টাকা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রসিকিউটর রাসেল আহমেদ বলছেন, ‘আমাদের জনবল খুবই কম। জেলায় তাদের লোকবল মাত্র ৩০ জন, নেই কোনো অস্ত্রও। তাই ইচ্ছে করলেও আমরা অনেক কিছু করতে পারি না।’
যশোরে মাদকসেবকরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে শুধু সচেতন মানুষ নয় উদ্বিগ্ন প্রশাসনও। যশোর জেলা প্রশাসনের সভাকক্ষে মাসিক আইন শৃঙ্খলা সভাতেও বারবার মাদকের বিস্তার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা কমিটির সর্বশেষ সভায় আলোচকরা জানান, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাই কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় ডোপ টেস্ট করার প্রস্তাব করেন কেউ কেউ। কিন্তু দেশের প্রচলিত ব্যবস্থায় এটি গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তা নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদকের কুফল নিয়ে সভা সেমিনার করবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। সেখানে এমএম কলেজ, সিটি কলেজ, দাউদ পাবলিক কলেজসহ শহরের বেশ কয়েকটি কলেজের কথাও উঠে আসে।
জেলা মাদক নিয়ন্ত্রণ ও প্রচারণা কমিটির সদস্য মসিউল আযম বলেন, ‘মাদকের বিস্তার কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। প্রতিটি মিটিংয়ে এর বিরুদ্ধে কথা হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে না। তারা তৎপর হলে চিত্র এতটা ভয়াবহ হতো না।’
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) সভাপতি মিজানুর রহমান মিজান জানান, জাতি শেষ হওয়ার পথে, এখান থেকে বের হতে হলে প্রথমেই মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে, বেশি করে দৃষ্টি দিতে হবে। যশোর মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাজ সন্তোষজনক নয়। তাদের কাজ উপযুক্ত হলে মাদকের বিস্তার এতটা হতো না।
সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘যার যা কাজ তা তো হচ্ছে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাজ হলো মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করা কিন্তু সেই কাজটিই তারা করছে না।’
তার অভিমত— এ জাতীয় একটি দফতর থাকা সত্ত্বেও যেহেতু নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না তা হলে ধরেই নিতে হবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যারা এই দায়িত্বে রয়েছে। তারা এর সঙ্গে জড়িত অথবা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। তিনি এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যে মাদকের উৎস এবং মাদক ব্যবসা বন্ধ করার আহ্বান জানান।
তবে মাদকদ্রব্য অধিদফতরের উপপরিচালক হুমায়ূন কবীর জানান, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিস বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাদক নির্মূল ও নিয়ন্ত্রণ করা পুরোপুরি সম্ভব না। পরিবারকেন্দ্রিক মাদক বিরোধী অবস্থান ও শিক্ষা দরকার। পাশাপাশি নজরদারিও রাখতে হবে।
তিনি জানান, অতীতেও মাদকের বিস্তার ছিল এখনও রয়েছে। জেলার বিস্তীর্ণ সীমান্ত এই মাদক ব্যবসার জন্যে উৎকৃষ্ট স্থান। আমাদের যশোর কিন্তু মাদক উৎপাদনকারী অঞ্চল নয়। ইয়াবা, ফেন্সিডিল, ট্যাপেন্টডল, হেরোইন এর কোনোটাই স্থানীয় পণ্য নয়। এর সঙ্গে জড়িতরা অনেক বেশি জাল বিস্তার করে আছে।
শিক্ষার্থীদের মাদকে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘সমাজে অসঙ্গতি থাকলে মাদকের ভয়াবহতা বাড়ে। সামাজিক বিভিন্ন অসঙ্গতি, বেকারত্ব, হতাশা, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, কর্ম ও অর্থহীনতা বা অতিরিক্ত অর্থের প্রবাহ, দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতা, পারিবারিক শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ অনেক কারণে মাদকের চাহিদা বাড়ছে। যোগান সহজ থাকায় সহজলভ্যও হচ্ছে।’
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলার বিভিন্ন বাহিনী ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযানে মাসে অন্তত চারশ জনকে আটক করা হয়েছে। এটি একটি জেলার জন্য অনেক বড় অগ্রগতি। তবে মাদক সিন্ডিকেটের পুরো নেটওয়ার্ক আমাদের একার পক্ষে ভাঙা সম্ভব নয়। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টাতে মাদক থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হতে পারে।’
সারাবাংলা/একে