Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘বোমা নিয়ে বাস করছি, যেকোনো সময় উড়ে যেতে পারি’

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৮ মার্চ ২০২৩ ১৬:০১

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ‘আমরা তো মানুষের তৈরি পারমাণবিক বোমা নিয়ে বসে আছি। এই যে কারখানা, এখানে আগে বসতবাড়ি ছিল। সেই বসতির ওপর কারখানা হয়েছে। ভেবেছিলাম কারখানা হয়েছে, লাভ হবে, মানুষের চাকরি হবে, দেশের উন্নতি হবে। এখন দেখছি বোমার সঙ্গেই আমাদের বসবাস, যেকোনো সময় বিস্ফোরণে উড়ে যেতে পারি।’

সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের পর সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে এভাবেই বলছিলেন ওই এলাকার বাসিন্দা আলী নেওয়াজ রিমন। বিস্ফোরণের রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি এসেছিলেন হতাহতদের সঙ্গে।

বিজ্ঞাপন

রিমনের মামা শামসুল বিস্ফোরণস্থল থেকে আধা কিলোমিটার দূরে উড়ে আসা লোহার পাতের আঘাতে মারা যান। সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার মামা ঘটনাস্থল থেকে আধা কিলোমিটার দূরে দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। বিস্ফোরণে লোহার পাত উড়ে এসে দোকানের টিন ভেঙে মামার মাথায় পড়ে। এতে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। সালাউদ্দিন নামে একজন এক কিলোমিটার দূরে বসেছিলেন। তার মাথায়ও সিলিন্ডারের লোহার পাত পড়লে তিনিও ঘটনাস্থলে মারা যান।’

রিমন বলতে থাকেন, ‘ছাদ ফুটো হয়ে সিলিন্ডারের অংশ গায়ে পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে, কতটা মর্মান্তিক! আমরা তো এখন বাড়িঘরেও নিরাপদ না। কিছুদিন পর পর বিস্ফোরণ। আমাদের মনে হয়, এবার বাড়ি-ঘর ছেড়ে যেতে হবে।’

শাহরুখ হাসান চাকরি করেন ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরের বিএম ডিপোতে। যে ডিপোতে গত বছরের জুনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছিল। অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের সময় তিনি ডিপোতেই ছিলেন। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণ যখন হয়, তখন মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে। বিকট আওয়াজ শুনে আমরা বাইরে এসে দূরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখতে পাই। আমার বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে তিন কিলোমিটার দূরে, সলিমপুরে। সেখানেও নাকি বাড়িঘর কেঁপে উঠেছে।’

বিজ্ঞাপন

পরিকল্পিতভাবে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার দাবি তার, যাতে মানুষের প্রাণ এবং বসতি হুমকির মুখে না পড়ে।

এদিকে, ফায়ার সার্ভিস কতৃপক্ষ জানিয়েছে, সীতাকুণ্ডের অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় আশপাশের বেশকিছু ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অনেক ভবনের দেয়াল দেখা দিয়েছে ফাটল। বিস্ফোরণের ঘটনায় ভেঙে পড়েছে অনেক বাড়ির কাচের জানালা।

জানতে চাইলে কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার সুলতান মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনাস্থলের আধা কিলোমিটারের মধ্যে যেসব ভবন রয়েছে প্রায়ই সবগুলোই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে ঘটনাস্থলের আশেপাশে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে বেশি। মাত্র দু’টি বসতবাড়ি ছিল। ভবনগুলোর দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেখান থেকে ভবন মালিকরা নিজে থেকেই সরে গেছেন।’

ঘটনাস্থলের আধা কিলোমিটার দূরেই নজির মিয়ার চায়ের দোকান। ঘটনার সময় তিনি দোকানেই ছিলেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রথমে একটা বিকট শব্দ হয়। এরপর আশেপাশের এলাকা ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। চোখে কিছু দেখা যায় না। কিছু দেখার আগেই দোকানের সব কিছু ‘লণ্ডভণ্ড’ হয়ে যায়। দোকানের ভেতরের লোহার এঙ্গেল ভেঙে পড়ে ফ্রিজ, টিভি, কাচের মালামাল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। টিনশেডের টিনগুলো আমার ওপর পড়েছে।’

সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা শ্রমিক নেতা নুরুচ্ছাফা ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘বার বার বিস্ফোরণ, অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ ঘটনায় আমরা সীতাকুণ্ডবাসী আতঙ্কিত। মাত্র ৮/৯ মাস আগে বিএম ডিপোতে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল। এরপর অক্সিজেন কারখানায়। প্রতিটি ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কিছু তোড়জোড় আর আশ্বাসের বাণী শুনি। বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখি না। সীতাকুণ্ডের লাখ লাখ বাসিন্দার জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলার জন্য শিল্প মালিকদের সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলোও দায়ী।’

শ্রমিক নেতা ফজলুল কবির মিন্টু সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে ৫০ জনের বেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল সরকারি হিসাব অনুযায়ী। এবার অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে সাতটি তাজা প্রাণ চলে গেল। প্রতিটি দুর্ঘটনার পরে দুয়েক দিন। এরপর যথারীতি চাপা পড়ে যায়। দুর্ঘটনার জন্য প্রকৃত দায়ীদের কখনোই চিহ্নিত করা হয় না। এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।’

উল্লেখ্য, শনিবার (৪ মার্চ) বিকেলে সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারি ইউনিয়নের ছোট কুমিরা এলাকায় সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেডে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আগুন লেগে পুরো কারখানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এ ঘটনায় সাত জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা ২২।

এর আগে, গত বছরের ৪ জুন দিবাগত রাতে সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। এরপর সেখানে কয়েক দফা বিস্ফোরণ ঘটে। ডিপোতে থাকা রাসায়নিকের কারণে ছড়িয়ে পড়া ওই আগুন বিভিন্ন বাহিনীর চেষ্টায় ৮৬ ঘণ্টা পর নেভানো হয়। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে প্রথমে ৪১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

পরে বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া এবং ডিপো পরিষ্কারের সময় বেশকিছু মানবদেহের খণ্ডিত অংশ উদ্ধারের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫১ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। ওই সময় আহত হন প্রায় দুই শতাধিক।

সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম

উড়ে যেতে পারি বোমা যেকোনো সময়

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর