শুধু পরিষ্কার পানি নয়, নালা-নর্দমায়ও মিলছে এডিসের লার্ভা
১৩ জুন ২০২৩ ২২:৪৬
ঢাকা: প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী কোনো স্থানে জমে থাকা স্বচ্ছ-পরিষ্কার পানি ডেঙ্গু রোগের জন্য দায়ী এডিস মশার প্রজনন স্থান। অন্যদিকে, নালা-নর্দমা বা অন্যান্য স্থানের নোংরা পানিতে কিউলেক্স মশা জন্মায় ও বংশবিস্তার করে। তবে সম্প্রতি রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কাজলা এলাকায় নোংরা পানিতেও পাওয়া গেছে এডিস মশার লার্ভা। বিষয়টি নিয়ে তাই বিস্তৃত গবেষণা ফলাফলের অপেক্ষায় ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ।
একইভাবে ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র পরিষ্কার পানিই নয়, বরং নালা-নর্দমার পানি থেকে শুরু করে সাগরের পানিতেও ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার জন্ম হতে পারে। ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় চার ধরনের পানিতে এডিস মশা জন্মের প্রমাণ পেয়েছেন কীটতত্ত্ববিদরা। তবে এখানেই থেমে থাকতে চান না তারা। প্রাথমিকভাবে ল্যাবরেটরি নমুনা পরীক্ষার এই ফলাফল নিয়ে তারা কাজ করতে চান মাঠ পর্যায়েও। এর পরেই গবেষণার পূর্ণাঙ্গ ফলাফল জানানো হবে।
কী বলছেন গবেষকরা?
জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার সারাবাংলা বলেন, ‘আমরা একটা গবেষণা করেছি। যেখানে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য আমরা সুয়ারেজ, ড্রেন, বৃষ্টি ও সমুদ্রের পানিতে এডিস মশার প্রজনন সক্ষমতা পরীক্ষার চেষ্টা করি। এসব ভিন্ন ভিন্ন জায়গার পানিতে আমরা মশার ডিম পাড়তে দিই। এডিস মশা এসব পানিতে ডিম পাড়ে। এর পর ডিম ফুটে লার্ভা হয়ে পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপান্তর হয়েছে। অর্থাৎ এসব পানিতে এডিস মশা শুধু ডিম পাড়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তাদের পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্র আমরা সেখানে দেখেছি।’
পরীক্ষামূলকভাবে ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা করে এমন ফলাফল পাওয়া গেছে। তবে মাঠ পর্যায়ে আরও বিস্তর জরিপ করে বিষয়টি গবেষণা করতে হবে- উল্লেখ করেন কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘ল্যাবরেটরিতে চার ধরনের পানিতেই এডিস মশার জীবনচক্র পেলেও আমরা সেটা মাঠপর্যায়ের ফলাফলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাই। তাই খুব দ্রুতই আমরা মাঠ পর্যায়ে এই নমুনা পরীক্ষা শুরু করব। তার আগ পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলা বিজ্ঞানসম্মত হবে না। আর মাঠ পর্যায়ের কাজের জন্য এখন পর্যন্ত আমরা নমুনা সংগ্রহ করিনি। তবে যেহেতু ল্যাবরেটরিতে হচ্ছে, তাই এটা মাঠপর্যায়েও বিস্তর জরিপ চালিয়ে নিশ্চিত হতে হবে।’
এডিস মশার চরিত্র খুবই বিচিত্র উল্লেখ করে কবিরুল বাশার বলেন, ‘এটি খুবই এডাপ্টিক মশা। যেকোনো পরিবর্তিত পরিবেশে সে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। নগরায়ন যেখানেই হবে সেখানেই এডিস ইজিপটাই বাড়বে। বাংলাদেশের এখন প্রায় সবখানেই নগরায়নের কাজ চলছে নানাভাবে। গ্রামেও এখন অনেক আরবানাইজেশন হচ্ছে। সুতরাং এসব স্থানে এডিস ইজিপটাই মশা বাড়াটাই স্বাভাবিক।’
সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পক্ষ থেকে এডিস মশার প্রজননস্থল শনাক্ত করে তা ধ্বংসের জন্য এক অভিযান চালানো হয়। ৪ জুন থেকে ৮ জুন পর্যন্ত রাজধানীর কাজলা এলাকার পরিচালিত এই অভিযানে বাসাবাড়ি ছাড়াও নোংরা পানিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে বলে জানায় ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ।
প্রসঙ্গত, রাজধানীর যে কয়টি এলাকায় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে তার মাঝে কাজলা অন্যতম। স্বাস্থ্য অধিদফতরের জরিপে ডেঙ্গুর জন্য ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে রয়েছে— যাত্রাবাড়ী, কেরানীগঞ্জ, কাজলা, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মুগদা ও জুরাইন।
পর্যাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষণা দরকার
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ) অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আবহাওয়ার যে ধরন তাতে এখন ডেঙ্গুর সংক্রমণ দ্রুত হারে বেড়ে যাবে। সঠিকভাবে এডিস দমন করতে না পারলে ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যু কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমরা বলতে পারি না। বিগত বছরগুলোর সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ভুল পথে মশা মারতে চাচ্ছি। আমরা বিষয়টি ভুল জেনেও এর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছি না। আমরা অনেক রোগ নির্মূল করতে পেরেছি। কিন্তু গত ২৩ বছরে ডেঙ্গু নির্মুল তো দূরের কথা, নিয়ন্ত্রণই করতে পারিনি। এজন্য আমাদের পর্যাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ দরকার এবং এর উপর গবেষণা দরকার। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।’
উল্লেখ্য, সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় (১২ জুন সকার ৮টা থেকে ১৩ জুন সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১১ জন। যা চলতি বছর এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৭৪ জন ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ৩৭ জন। এই ২৪ ঘণ্টা সময়ে ডেঙ্গুতে একজন মৃত্যুবরণ করেছেন।
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে এখন পর্যন্ত তিন হাজার ৬০১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় দুই হাজার ৭৩৬ জন এবং ঢাকার বাইরে ৮৬৫ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয় কন্ট্রোল রুমের পরিসংখ্যানে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, গত বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মোট সংখ্যা ছিল ২৮১ জন এবং মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬২ হাজার ৩৮২ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বাইরে ছিলেন ২৩ হাজার ১৬২ জন।
আরও পড়ুন: ভয়াবহ রূপ নিয়ে আসছে ডেঙ্গু!
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম