প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে আ.লীগের আরেং, বিএনপির প্রিন্স এগিয়ে
২৫ অক্টোবর ২০২৩ ২২:২০
ময়মনসিংহ: আওয়ামী রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভাষাসৈনিক রফিক উদ্দিন ভুইয়া, পাঁচ বারের এমপি এম শামসুল হক (একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক), সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা এ কে এম মোশাররফ হোসেন, সাবেক ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান (একুশে পদকপ্রাপ্ত) এবং সাবেক ফার্স্টলেডি বেগম রওশন এরশাদ’র জন্মভূমি ও রাজনীতির চারণক্ষেত্র ময়মনসিংহ। এই সকল রাজনীতিক কালে কালে বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাসকে উচ্চকিত করে গেছেন। এই অঞ্চলের রাজনীতি আবর্তিত হতো উল্লিখিত সব নেতাদের ঘিরে। মূলত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো তাদের জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেই নির্বাচন এখন কড়া নাড়ছে।
আর মাত্র কয়েক মাস পরেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। যদিও রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সরাসরি নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলছে না। তাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই দাবিতে তারা রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আন্দোলনের পাশাপাশি তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় থেমে নেই সবচেয়ে বেশি সংসদীয় আসনের জেলা ময়মনসিংহের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও। মিছিল-মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নিজেকে যোগ্য প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছেন তারা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহের ১১টি আসনে আওয়মী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদসহ অন্যান্য দলের প্রায় পৌনে দুই’শ মনোনয়ন প্রত্যাশী মাঠে রয়েছেন। ময়মনসিংহকে বলা হয়ে থাকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। স্বাধীনতার পর থেকে এখানকার বেশিরভাগ সংসদীয় আসন আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভ করেছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে বিএনপি এবং তার পর জাতীয় পার্টি। কয়েকবছর ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে রয়েছে জাতীয় পার্টি। সেজন্য তাদের দুয়েকটি আসন ছেড়ে দিতে হয়। এবারও জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট বাঁধলে অন্তত দু’টি আসন ছেড়ে দিতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে নয়টি আসনে জয়ের জন্য আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাঠে নামতে হবে। আর রাজপথের প্রধান বিরোধীদল নির্বাচনে এলে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও পাল্টে যাবে। কারণ, তারাও কয়েকটি আসন পুনরুদ্ধারে ভোটের মাঠে নামবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া) আসনের চিত্র।
ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া নিয়ে ময়মনসিংহ-১ আসন। এ আসনে মনোনয়ন দৌড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে রয়েছে। বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগ চাইছে আগামী নির্বাচনেও নৌকার জয় অব্যাহত থাকুক। আর বিএনপি এক দফার আন্দোলন চালালেও আসনটি পুনরুদ্ধারে মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে রয়েছেন একাধিক প্রাথী। পাশাপাশি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেতেও মাঠে রয়েছেন দলটির একাধিক প্রার্থী।
বিগত ১১টি সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগ সাতবার, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি দুই বার করে বিজয়ী হয়েছে। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে হালুয়াঘাট আসনে আওয়ামী লীগের সীমান্তবন্ধু হিসেবে পরিচিত কুদরত উল্লাহ মন্ডল, ১৯৭৯ সালে সাবেক বিচারপতি বিএনপি’র অ্যাডভোকেট টিএইচ খান, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির এমদাদুল হক মুকুল, আওয়ামী লীগ ১৯৮৮ সালে নির্বাচন বর্জন করলে পুনরায় এমপি হন জাতীয় পার্টির এমদাদুল হক মুকুল। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রতিমন্ত্রী ও আদিবাসী নেতা প্রমোদ মানকিন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে এই আসনে বিএনপি’র সাংবাদিক আফজল এইচ খান নির্বাচিত হয়। ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে ফের আওয়ামী লীগের প্রমোদ মানকিন এমপি নির্বাচিত হন। প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০১৬ সালে প্রমোদ মানকিন’র মৃত্যু হলে উপনির্বাচনে তারই ছেলে জুয়েল আরেং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে জুয়েল আরেং নির্বাচিত হন।
জানা যায়, টানা তিন মেয়াদে সরকারের ক্ষমতায় থাকলেও আসনটিতে আওয়ামী লীগের অবস্থান কিছুটা নাজুক। গোটা দেশের উন্নয়নের ধারায় সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া পিছিয়ে পড়াকেই এই অবস্থার জন্য মূলত দায়ী করা হচ্ছে। অনেকেরই আশঙ্কা, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়নে ভুল করলে হারাতে হতে পারে এ আসন। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়েও আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতেও রয়েছে রাজনৈতিক গ্রুপিং ও কোন্দল। তাই প্রার্থী বাছাইয়ের ওপরই নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনে এই আসনে দলগুলোর জয়-পরাজয়।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হচ্ছেন- প্রয়াত সাবেক সমাজ কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ও আদিবাসী নেতা প্রমোদ মানকিনের ছেলে বর্তমান সংসদ জুয়েল আরেং, আনন্দ মোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ খান, উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক সায়েম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী প্রতিকা চিছামের স্বামী ব্যাংক কর্মকর্তা নিঃশেষ দ্রং ও অ্যাডভোকেট পীযুষ কান্তি সরকার।
উন্নয়ন ও পরিবর্তনের নতুন বার্তা নিয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নিঃশেষ দ্রং এলাকায় উঠান বৈঠক ও কর্মী সভা করছেন। এতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মাঝে আলাদা ইমেজ তৈরি হয়েছে তার। তবে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থকসহ নানা শ্রেণি-পেশার ভোটারদের কাছে আলাদা অবস্থানে রয়েছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ খান। আর যোগাযোগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে এলাকায় নিজেকে গ্রহণযোগ্য অবস্থানে রেখেছেন বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক সায়েম। বাবা সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের মৃত্যুতে আসন শূন্য হলে তারই ছেলে জুয়েল আরেং এমপি নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে আবার নির্বাচনে জিতে এমপি হন তিনি।
নৌকার বিজয় অব্যাহত রাখতে প্রধানমন্ত্রী হাতকে শক্তিশালী করতে চান জুয়েল আরেং। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সীমান্তবর্তী উপজেলায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। সীমান্ত সড়ক, হালুয়াঘাট-নালিতাবাড়ি, ফুলপুর-হালুয়াঘাটসহ সড়ক যোগাযোগ ও অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকেই ফের এই আসনের যোগ্য প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেবেন বলে আশাবাদী।’
এদিকে, এই আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হচ্ছেন- কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, দানবীর ব্যবসায়ী সালমান ওমর রুবেল ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি আফজল এইচ খান। সরকারের পদত্যাগের এক দফার আন্দোলন চলমান থাকলেও এ উপজেলার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ও সালমান ওমর রুবেল সক্রিয় রয়েছেন। সেদিক থেকে আফজাল এইচ খান খুবই নীরব।
ব্যবসায়ী সালমান ওমর রুবেল সাড়া বছর জুড়েই চক্ষু শিবির, স্বাস্থ্য সেবা, শীতবস্ত্র বিতরণ, করোনাকালীন সময়ে এলাকাবাসীর পাশে থেকেছেন। আর দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদারসহ তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছে আস্থার প্রতীক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। তিনি আওয়ামী লীগের কাছেও শক্ত প্রার্থী হিসেবে নিজের অবস্থানের জানান দিয়েছেন ইতোমধ্যে। তবে দলের হাইকমান্ড যাকেই মনোনয়ন দেবেন তার জন্যই লড়বেন তিনি।
এ ছাড়া জাতীয় পার্টির রয়েছে দু’টি। একটি গ্রুপ রওশন এরশাদের, আরেকটি জিএম কাদেরের। এ আসেন দুই গ্রুপের দু’জন মনোনয়ন প্রত্যাশায় রয়েছেন বেশ জোড়েশোরেই। তারা দু’জন হলেন- রওশন এরশাদ গ্রুপের জাতীয় পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক সোহরাব উদ্দিন খান এবং জিএম কাদের গ্রুপের জাহিদুল ইসলাম পাপ্পু। মনোনয়ন দিলে তারাও এ আসন জাতীয় পার্টিকে উপহার দেবেন বলে জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ময়মনসিংহে ভারত সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার আলাদা দু’টি থানার ১৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট- ধোবাউড়া) আসন। এই আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৭৯০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৪৮ হাজার ২৮৮ এবং নারী ভোটার ২ লাখ ৪০ হাজার ৪৯৯ জন। এই আসনে আদিবাসী ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৮১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রমোদ মানকিন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপি আফজাল এইচ খান। তিনি পান ৯১ হাজার ৩৪৫ ভোট। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন প্রমোদ মানকিন। কিন্তু ২০১৬ সালে তিনি হঠাৎ মৃত্যুবরণ করলে তার ছেলে জুয়েল আরেং উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে যান। আর একাদশ জাতীয় সংদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জুয়েল আরেং ২ লাখ ৫৮ হাজার ৯২৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিটকতম আফজাল এইচ খান ধানের শীষ প্রতীকে পান ২৮ হাজার ৬৩৮ ভোট।
সারাবাংলা/কেএমএম/পিটিএম
আফজল এইচ খান এমরান সালেহ প্রিন্স জুয়েল আরেং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পীযুষ কান্তি সরকার প্রমোদ মানকিন ফারুক আহমেদ খান ময়মনসিংহ-১ আসন মাহমুদুল হক সায়েম সালমান ওমর রুবেল