‘গাড়ি পুড়িয়ে, মানুষ মেরে গণতন্ত্র চর্চার দাবি করা অপরাধ’
১৭ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:১৬
ঢাকা: গাড়ি পুড়িয়ে, মানুষ মেরে, পুলিশ হত্যা করে গণতন্ত্র চর্চার দাবি করা অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ।
এডুকেশন রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ (ইআরডিএফবি) আয়োজিত ‘উন্নয়ন ও গণতন্ত্র’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ হলে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্যে দেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইআরডিএফবির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ।
ইআরডিএফবির সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ।
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছিল এবং আজকেও তাদের সাথে যারা তাল মিলিয়ে চলে, ওইসব অপশক্তির কারণেই আজ গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যারা প্রগতিশীল তারা কখনই গণতন্ত্রের জন্য হুমকি না। বরং গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রগতিশীলতাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। প্রগতিশীল সংগঠনগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে। আর এ জন্য প্রগতিশীল সংগঠনগুলোকেও কাজ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গণতন্ত্রের নামে হরতাল-অবরোধ ডেকে আগের দিনের সন্ধ্যায় অথবা ভোরবেলায় বাস বা বিভিন্ন ধরনের গাড়ি পুড়িয়ে, মানুষ মেরে, পুলিশ হত্যা করে যদি গণতন্ত্র চর্চার দাবি করা হয় তাহলে সেটি অপরাধ। এ থেকে বের হওয়ার জন্য আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে হবে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আলোচনায় যেতে হবে।’
অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ‘রাজনীতিতে যখনই ধর্মের নেতিবাচক প্রভাব বৃদ্ধি পাবে তখনই গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মাঝে ধর্মের নেতিবাচক প্রভাব দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।’
তিনি বলেন, ‘প্রগতিশীলতা যারা ধারণ করেন, যাদের চিন্তা চেতনায় প্রগতিশীলতা ও কর্মেও প্রগতিশীলতা কাজ করে। তারা সবসময় উন্নয়নের পক্ষেই থাকেন। কিন্তু যাদের চিন্তা চেতনায় প্রগতিশীলতা নাই, তাদের মধ্যে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকা কাজ করে। তাদের রাজনীতি কখনও গণতন্ত্রের পক্ষে না। এখন বাংলাদেশের ভেতরে যারা পাকিস্তানি চিন্তা চেতনায় বিশ্বাস করে, সেসব বিশ্বাস ধারণ করে, লালন করে, তারা গণতন্ত্রের পক্ষে না, উন্নয়নেরও পক্ষে না।’
‘আমরা দেখি প্রগতিশীলেরা যখন ক্ষমতায় থাকে তখন আমাদের শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, আমাদের সামাজিক উন্নয়ন হয় এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকে। আর যখন প্রগতিশীলতার বিপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আসে তখন সামাজিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। যা আমাদের কারও জন্যই শুভকর না।’
এই সব কিছু বিবেচনাই নিয়ে যদি বলি- প্রগতিশীলতার সঙ্গে গণতন্ত্র সম্পৃক্ত। আর প্রগতিশীল সংগঠন এবং প্রগতিশীল নেতা যদি ক্ষমতায় থাকেন তাহলে দেশের উন্নয়নের ধারাও অব্যাহত থাকে।
সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল কবীর।
‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পর কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ: অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত’ শিরোনামের প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর, মাথাপিছু আয়, রফতানি আয়, সাক্ষরতার হার, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু মৃত্যুর হার এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বচ্ছলতার মতো কিছু অর্থনৈতিক সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো পারফরম্যান্স প্রদর্শন করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে, যেমন পদ্মা সেতু, কর্ণফুলি টানেল, মেট্রোরেল। আরও কিছু মেগা প্রকল্প রয়েছে যা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং এগুলোর বেশিরভাগই দেশীয় উৎস দ্বারা অর্থায়ন করা হয়েছে।’
অধ্যাপক আনোয়ারুল কবীর বলেন, সিডর, আইলা, মহাসেনের মতো জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলায় বাংলাদেশের জনগণ ব্যাপক স্থিতিস্থাপক শক্তি দেখিয়েছে। এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) ২০২০ অর্জনের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও প্রদর্শন করেছে। আগামী বছরগুলিতে যদি এই উন্নয়নগুলি একই গতিতে ঘটে তবে আশা করা যায় যে, বাংলাদেশ ২০৪১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে একটি উন্নত দেশে নিজেকে উন্নীত করতে সক্ষম হবে।
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পরপরই একাধিক কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই দুর্বল ছিল। সেই পটভূমিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সেক্রেটারি অফ স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই দেশের টেকসইওতা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করেছিলেন। কিন্তু সুখের বিষয় হলো, বাংলাদেশের উদ্যোমী নাগরিকেরা হেনরি কিসিঞ্জারের এই ঈর্ষান্বিত চিন্তাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। এখন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে যে কেউ গর্ব করে বলতে পারে- এদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়।’
সভাপতির বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন শিক্ষকসমাজ ও ছাত্রসমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষা এবং গবেষণার মাধ্যমে উন্নয়ন হবে। আমরা শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে এদেশকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র গড়ে তুলব। গণতান্ত্রিক ধারায় আগামী ৭ জানুয়ারি উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হবে। নির্বাচনে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ভোট দিতে যেতে হবে এবং নির্বাচনের পর বিজয় উৎসব হবে। আর তরুণ সমাজ সেই উৎসবে নেতৃত্ব দেবে। আমি আশা করব তরুণ-যুবকসহ সকলেই দলে দলে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের ভোট প্রদান করে এ দেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখায় শামিল হবে। এবং অবাধ, শান্তিপূর্ণ ভোটের মাধ্যমে সংবিধান সম্মত উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে। সংবিধানসম্মত উপায়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হবে। আর এ জন্য আমরা শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করি, আমরা শেখ হাসিনাতেই আস্থা রেখেছি, আমরা উন্নয়নে আস্থা রেখেছি, আমরা গণতন্ত্রে আস্থা রেখেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তরুণ সমাজকে বলছি এখন ঘরে বসে থাকলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না, নির্বাচনে, ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত না থাকলে গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হবে। পাশাপাশি সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও চরমপন্থার মূল উৎপাটন করতে হবে।’
অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস আছে হাজার বছরের, আমাদের ইতিহাস আছে উয়ারী বটেশ্বরের, আমাদের ইতিহাস আছে পন্ডিত বিহারের, আমাদের ভাষার জন্য ইতিহাস আছে, সংস্কৃতির, শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার জন্য ইতিহাস আছে। আমরা একটি অদম্য জাতি, মানবিক জাতি, আমরা শিক্ষা-গবেষণা ও উন্নয়নে এগিয়ে যাব এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা সুখী, সমৃদ্ধ, আধুনিক ও স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমাণে এগিয়ে যাব। এই হোক আজকের দিনে আমাদের প্রত্যাশা।’
ইআরডিএফবির সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মো. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ইআরডিএফবির সহসভাপতি অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার; বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. কামরুল আলম খান এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন প্রমুখ।
আলোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসেফিক ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ শিক্ষক-শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
২০২২ সালের ১ অক্টোবর এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ (ইআরডিএফবি) প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়ন নিয়ে সংগঠনটি কাজ করছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি শিক্ষা, গবেষণা এবং উন্নয়ন বিষয়ে বহু সভা সেমিনার সফলভাবে আয়োজন করেছে।
সারাবাংলা/কেআইএফ/একে