‘জুড়ে বসা’ লতিফের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে বিদ্রোহ
২৮ নভেম্বর ২০২৩ ২২:৩৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ সংসদ সদস্য হিসেবে আলোচিত এম এ লতিফের চতুর্থ দফা মনোনয়ন নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ। লতিফের মনোনয়ন পরিবর্তনের অনুরোধ জানিয়ে সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি পাঠানোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছে নগর আওয়ামী লীগ।
মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) সন্ধ্যায় নগরীর দারুল ফজল মার্কেটের দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এম এ লতিফ চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য। তিনি চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে প্রথমে এ আসনে নগর আওয়ামী লীগ নেতা খোরশেদ আলম সুজনকে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু পরে রাতারাতি সেই মনোনয়ন পাল্টে লতিফকে দেয়া হয়।
কোনোদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করেও হঠাৎ লতিফের হাতে নৌকা দেখে নেতাকর্মীরা হতবাক হয়েছিলেন। নেতাকর্মীদের অভিযোগ ছিল, লতিফ জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০০৮ সালে জিতে আসার পর ২০১৪ এবং ২০১৮ সালেও মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এবার এ আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের গুঞ্জন থাকলেও শেষপর্যন্ত লতিফের ওপরই আস্থা রেখেছে দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড।
লতিফের আবারও মনোনয়ন পাওয়া মানতে পারেননি নগর আওয়ামী লীগের সিংহভাগ নেতাকর্মী। মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য মাঠে নেমেছেন। এ পর্যন্ত ২৯ জন এ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করেছেন বলে জানা গেছে।
মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে ইতোমধ্যে বৈঠক-সভা শুরু করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন। তিনি এম এ লতিফের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি, দলের নেতাকর্মীদের মামলা-হয়রানিসহ বিগত ১৫ বছরের নানা খতিয়ান তুলে ধরে নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে একটি চিঠি দেন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সেই চিঠি পড়ে শোনান নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, যিনি নিজেও চট্টগ্রাম-১১ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। এরপর তিনি চিঠিতে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে নেতাদের মতামত জানতে চান। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, সহ সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, সদস্য মোহাম্মদ ইলিয়াছসহ কয়েকজন নেতা সাংসদ এম এ লতিফের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন।
খোরশেদ আলম সুজন সভায় বলেন, ‘আমি তাজমহল বানাতে পারবো, কিন্তু সেই তাজমহলে আমি ঢুকতে পারবো না, এটা কিভাবে হয় ? বাইরের একজন মানুষ এসে সেই তাজমহলের মালিক হয়ে যায়। আমরা যারা জীবন বাজি রেখে রাজনীতি করে আজ এ পর্যায়ে এসেছি, আমাদেরও কষ্ট আছে, দুঃখ-ব্যাথা আছে।’
মোহাম্মদ ইলিয়াছ সভায় বলেন, ‘আমার নামে চট্টগ্রাম বন্দরের একটা লাইসেন্স ছিল। উনি (এম এ লতিফ) একটি টেন্ডারে অবৈধ হস্তক্ষেপ করায় আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। তিনি আমাকে মারার জন্য তেড়ে এসেছিলেন। এরপর তিনি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করিয়ে জেলে পাঠিয়ে আমাকে পত্রপত্রিকায় যেভাবে কালার করেছে, মনে হয়েছে আমি বোধহয় এদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করে আমাকে কালো তালিকাভু্ক্ত করতে। পরে বন্দর কর্তৃপক্ষ সেটা তুলে নেয়ার পরও এমপি সাহেব আমার লাইসেন্স নবায়ন করতে দিচ্ছেন না।’
‘সম্প্রতি আমার ভাইয়ের জায়গা দখলের চেষ্টা করেছে প্রতিবেশি একটি পরিবার। হামলাও করেছে। আমার ভাই মামলা করতে গেলে পুলিশ জানিয়েছে, এমপি সাহেব মামলা নিতে মানা করেছেন। এভাবে উনি আমাকে শুধু নয়, আমার পরিবারকেও প্রতিপক্ষ বানিয়ে হয়রানি করছেন। আমার স্ত্রী আজ আমাকে বললেন, সুজন (খোরশেদ আলম সুজন) ভাইয়ের মতো লোককে যে দল নমিনেশন দেয় না, সেখানে আপনি কিভাবে নমিনেশন পাবেন, শুধু শুধু আমাদের রিজিক মারবেন না।’
মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমি দলের পদে আছি। দলের শৃঙ্খলার স্বার্থে অনেক কথা বলতে পারি না। কিন্তু বারবার একজন বাইরের লোক এসে মনোনয়ন নিয়ে চলে যাবে আর আমরা সহ্য করবো, এতে কষ্ট হয়, দুঃখ লাগে। আমি যদি পদে না থাকতাম, এর জোরালো প্রতিবাদ করতাম।’
জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনে যেসব প্রার্থী দিয়েছে, কারও বিরুদ্ধে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু এই ব্যক্তির (এম এ লতিফ) বিগতদিনের কর্মকাণ্ডে ওয়ার্ড-ইউনিট, থানা, মহানগরের নেতাকর্মী আমরা সবাই অতিষ্ঠ। ২০০৮ সালে তিনি নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে এসে জামায়াতের সংগঠন চাষী কল্যাণ সমিতির সংবর্ধনা নিয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করেছেন। আমাদের নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন। আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে।’
‘গত ১৫ বছরে তিনি কোনোদিন দলের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে আসেননি। বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াওয়ের বিরুদ্ধে আমরা মিছিল-সভা, সমাবেশ করি। কিন্তু তিনি কোনোদিন কোনো পয়েন্টে আসেননি। তিন গত ১৫ বছরে কি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছেন, সেটা এ আসনের নেতাকর্মীরাও জানেন না। এ অবস্থায় নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি সর্বসম্মতভাবে উনাকে পরিবর্তন করার অনুরোধ করেছে। চিঠি সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের কাছে কাল (বুধবার) পাঠানো হবে।’
এ বিষয়ে এম এ লতিফের বক্তব্য জানার জন্য কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি গ্রহণ করেননি।
সারাবাংলা/আরডি/এনইউ