ঈদের ছুটিতেও সবুজ নয় ঢাকার বাতাস
১২ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:৫৯
ঢাকা: চলছে ঈদুল ফিতরের ছুটি। রাজধানী ঢাকা ছেড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে গেছেন এক কোটিরও বেশি মানুষ। ঈদের আবহে ঢাকা তাই অনেকটাই ফাঁকা। তাতে কমেছে যানবাহনের চলাচল। ঈদের ছুটিতে বন্ধ আছে নির্মাণকাজ, কলকারখানা আর ইটভাটাও। এত কিছুর পরও রাজধানীর বায়ুমান স্বাস্থ্যকর নয়!
শুক্রবার (১২ এপ্রিল) আইকিউএয়ার অনুযায়ী ঢাকার বায়ুদূষণের স্কোর ১৪৩, যা শারীরিকভাবে সংবেদনশীল মানুষদের জন্য অস্বাস্থ্যকর। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক এই বায়ুমান পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী, শুক্রবার বিশ্বের ১২১টি শহরের মধ্যে বায়ুমানে ঢাকার অবস্থান অষ্টম।
আইকিউএয়ারের মানদণ্ড অনুযায়ী, বায়ুমানের স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে ‘মাঝারি’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’ মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ুর শ্রেণিভুক্ত। অন্যদিকে স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তাকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ এবং স্কোর ৩০১-এর বেশি হলে তাকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বিবেচনা করা হয়।
এই মানদণ্ড অনুযায়ী ঢাকার বায়ুমান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকার কেন্দ্রস্থল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের আশপাশে বায়ুমান স্কোর ৮৬, যা তুলনামূলক ভালো। আইকিউএয়ার অনুযায়ী এটি ‘মডারেট’ পর্যায়ের দূষণ। কিন্তু ঢাকার আরেক লেক গুলশান লেকের ধারে দূষণ মাত্রা ১৪৯, যা সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর। অন্যদিকে স্কোর সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে সাভারের হেমায়েতপুরে— ১৫৮, যা অস্বাস্থ্যকর। বারিধারা এলাকাতেও এর মাত্রা পাওয়া গেছে ১৫৩, যেটিও অস্বাস্থ্যকর শ্রেণির মধ্যেই পড়েছে।
আইকিউএয়ারের তালিকা অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি। শুক্রবার ঢাকার বাতাসে পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে ৫২ দশমিক ৬ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি।
আইকিএয়ারের তথ্য বলছে, এখন বায়ুমানে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজধানী দিল্লি। শহরটির বায়ুমান স্কোর ১৮৪। ১৬৫ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চীনের রাজধানী বেইজিং। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে কলকাতা, যার স্কোর ১৫৭। আর চতুর্থ অবস্থানে দক্ষিণ এশিয়ার আরেক প্রতিবেশী দেশ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু, যার স্কোর ১৫৫।
এদিকে আগের কয়েক দিনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই সময় ঢাকার বায়ুমানের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ৬ এপ্রিল বায়ুমানের স্কোর ছিল ১৫৫ একিউআই, ৭ ও ৮ এপ্রিল ১৫৯ একিউআই, ৯ এপ্রিল ১৭৮ একিউআই, ১০ এপ্রিল ১৮১ একিউআই এবং ১১ এপ্রিল ১৬৪ একিউআই। অর্থাৎ এ সপ্তাহের পুরোটা সময়ই ঢাকার বায়ুমান ছিল অস্বাস্থ্যকর। এর আগে গত শুক্রবার (৫ এপ্রিল) ১৬০ একিউআই স্কোর নিয়ে দূষণের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে ছিল ঢাকা। আর তার আগের শুক্রবার ১৭৪ স্কোর নিয়ে ছিল প্রথম অবস্থানে।
গতকাল ১১ এপ্রিল দেশব্যাপী পালিত হয়েছে ঈদুল ফিতর। তার আগের দুদিন ব্যাপকসংখ্যক মানুষ বাস, ট্রাক, ট্রেন, প্রাইভেট কার ও অন্যান্য যানবাহনে করে ঢাকা ছেড়েছে। ওই দুই দিনেই ঢাকার বায়ুমান ছিল এ কয়েক দিনের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। আর ঈদের দ্বিতীয় দিনে এসে বায়ুমান অস্বাস্থ্যকর থেকে কিছুটা উত্তরণ ঘটিয়ে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকরে উন্নীত হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুদূষণ গবেষক ড. আবদুস সালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে মানুষ কমলেও কর্মকাণ্ড (অ্যাকটিভিটিজ) কমেনি। ঈদের আগের রাতেও ঢাকার কোথাও কোথাও যানজট ছিল। এর প্রভাব তো আছেই। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে রান্নাবান্নাও বেড়েছে। গ্যাসের চুলায় রান্না হলেও এর মাধ্যমে অর্গানিক কিছু উপাদান বাতাসে পৌঁছে দূষণ সৃষ্টি করে।’
ঢাকার বায়ুদূষণে প্রতিবেশী দেশের প্রভাব আছে কি না— জানতে চাইলে এই গবেষক বলেন, প্রতিবেশী দেশের দূষণের প্রভাব এই মুহূর্তে নেই। সেটি থাকে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আর আজ (শুক্রবার) এই মুহূর্তে ঢাকায় বাতাস ঢুকছে ভারতের সেভেন সিস্টার্স অঞ্চল থেকে। ওই এলাকা কিন্তু পাহাড়ি, তাই দূষণ তুলনামূলক কম। কয়লা পোড়ানোর ফলে ওদিকেও কিছু দূষণ থাকে। তবে আজ বাংলাদেশের দিকে প্রবাহিত বাতাস সবুজ।’
‘মূলত আমাদের দেশের সার্বিক দূষণই বেশি। আমাদের তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি এলাকায় দুটি রোবট বসানো আছে বায়ুদূষণ মাপার জন্য। এগুলোর হিসাবেও দেখা যাচ্ছে, ঢাকায় ১-এর কাছাকাছি আর অন্যটিতে ০.৮ মাত্রার দূষণ। অর্থাৎ সারাদেশের সার্বিক দূষণই বেশি,’— বলেন ড. আবদুস সালাম।
শুক্রবার ছুটির দিনের কারণে দূষণ তুলনামূলক কম হতে পারে ঢাবির এই অধ্যাপক আরও বলেন, আজ ঢাকায় ৪০ থেকে ৫৫ মাইক্রোগ্রাম দূষণ উপাদান দেখাচ্ছে। সারাবছর এটি ৮০ থেকে ১০০-এর বেশি থাকে। কখনো কখনো এটি ৩০০ ছাড়িয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকায় ৪০টি স্থানে ও সারাদেশে ৭০টি স্থানে দূষণ পরিমাপক যন্ত্রের সাহায্যে বায়ুদূষণ পরিমাপ করা হয়। এসব যন্ত্র অনুযায়ীও দূষণ আইকিউএয়ারের কাছাকাছিই বলে উল্লেখ করেন এই অধ্যাপক। তবে ঢাকার চারপাশের তুলনায় ঢাকার ভেতরে দূষণ কিছুটা কম বলেও জানান তিনি।
ঢাকার বায়ুদূষণের এ পরিস্থিতিতে বাসিন্দাদের ঘরের বাইরে মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছে আইকিউএয়ার। এ ছাড়াও বাইরে গিয়ে ব্যায়াম না করা এবং ঘরের জানালা বন্ধ রাখারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন সংবেদনশীল গোষ্ঠী, যাদের মধ্যে আছেন বয়স্ক, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। সংবেদনশীল গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়ার পরামর্শও দিয়েছে আইকিউএয়ার।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বাংলাদেশে অকালমৃত্যুর ২০ শতাংশের কারণ বায়ুদূষণ। পরিবেশ দূষণের মধ্যে অকাল মৃত্যুর ক্ষেত্রে ঘরে ও বাইরে বায়ুদূষণই সবচেয়ে প্রাণঘাতী উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, অকালমৃত্যুর প্রায় ৫৫ শতাংশের কারণই বায়ুদূষণ। এ কারণে ২০১৯ সালে জিডিপির ক্ষতি হয়েছিল ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ।
এ ছাড়া আইকিউএয়ারের ২০২৩ সালের বায়ুদূষণ বিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বায়ুদূষণে গত বছর শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ, দ্বিতীয় স্থানে ছিল পাকিস্তান। আর রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকার স্থান ছিল বিশ্বে দ্বিতীয়। শীর্ষে ছিল ভারতের নয়াদিল্লি।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর