Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নিবন্ধন না থাকায় অধিকারবঞ্চিত রিকশা-ভ্যান শ্রমিকরা

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১ মে ২০২৪ ২২:০৭

রাজধানীতে স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য রিকশার বিকল্প নেই। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বলছে, রাজধানীতে নিবন্ধিত রিকশার তুলনায় অনিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা কয়েক গুণ। ছবি: সারাবাংলা

ঢাকা: রাজধানী ঢাকায় দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে নিবন্ধিত পায়ে চলা রিকশা প্রায় দুই লাখ। আর অনিবন্ধিত রিকশা এর কয়েক গুণ। এসব অনিবন্ধিত যানবাহনের চালকদের নিয়ে কর্মরত সংগঠনগুলো বলছে, নিবন্ধন না থাকায় এসব রিকশার চালকরা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সব সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মিলছে না সংগঠন করার সুযোগ। অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত হচ্ছে রিকশাচালক ও রাষ্ট্র উভয়পক্ষই।

বুধবার (১ মে) আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। সরকারি ছুটি থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক খাতের উচ্চ থেকে নিম্ন সব পর্যায়ের শ্রমিকরা ছুটি কাটালেও মে দিবসেও ছুটি নেই রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়িচালকদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। মাঠপর্যায়ের শ্রমিকদের অনেকে জানেই না, এমন একটা দিন আছে।

বিজ্ঞাপন

খিলগাঁওয়ের রিয়াজবাগ এলাকার থাকেন রিকশাচালক আবদুল্লাহ। বাড়ি ময়মনসিংহ। পাঁচ বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালালেও জানে না মে দিবস কী। মে দিবসের নামও তিনি কখনো শোনেননি বলে জানান এ প্রতিবেদককে। কোনো শ্রমিক সংগঠন বা সমিতির সদস্য তিনি নন। তাদের গ্যারেজের আরও শখানেক রিকশাচালকেরও অবস্থাও একই। মে দিবসের দিনও তাই রিকশা চালাবেন তারা। কিন্তু ছুটি থাকায় অন্যান্য দিনের তুলনায় কিছুটা কম আয় হবে তাদের।

ঢাকার আরও কয়েকটি এলাকায় রিকশাচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের যে শ্রমিক হিসেবে কোনো অধিকার আছে, সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। রিকশার নিবন্ধন বা রিকশাচালক হিসেবে নিবন্ধনও কেন জরুরি, সে বিষয়েও তারা অজ্ঞ। তাদের কথা একটাই— পেটের দায়ে রিকশা চালান। ঢাকায় বা গ্রামে থাকা তাদের পরিবার চলে এই শ্রমের টাকায়। তাই রিকশা চালাতে পারলেই তারা খুশি।

বিজ্ঞাপন

শ্রমিক অধিকার দিবসের প্রাক্কালে রিকশাচালকদের অধিকার সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল, নানা সমস্যায় জর্জরিত এই খাত। শ্রমিক, গবেষক আর অধিকার কর্মীরা বলছেন, সংগঠনের নিরাপত্তা না পাওয়ায় নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত তারা। আর সংগঠনের ছায়াতলে না আনতে পারার অন্যতম কারণ নিবন্ধন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই ইচ্ছামতো রিকশা চলাচল করা। এর পেছনে মধ্যস্বত্বভোগীদের পাশাপাশি সরকারি সংস্থাগুলোর উদাসীনতাকে দায়ী দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। বলছেন, মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্যই রিকশাচালক ও যাত্রী উভয়েই নানা বঞ্চনার শিকার।

শ্রমিক অধিকার কর্মীরা বলছেন, নিবন্ধনের আওতায় না থাকার কারণে নানা ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রিকশাচালকরা। ছবি: সারাবাংলা

রিকশার সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা

ঢাকায় কত রিকশা আছে, তা নিয়ে বিতর্ক পুরনো। দুই সিটি করপোরেশনের হিসাব বলছে, পায়ে চালিত নিবন্ধিত রিকশা রয়েছে লাখ দুয়েক। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতায় নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা এক লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৮টি, ব্যক্তিগত রিকশা ছয় হাজার ৪৫৬টি, ভ্যান ২৫ হাজার ৬৭১টি, ঠেলা গাড়ি ২৮৬টি, টালী গাড়ি ৪০১টি ও ঘোড়ার গাড়ি ৩০৬টি। সব মিলিয়ে নিবন্ধিত এসব যানবাহনের সংখ্যা এক লাখ ৯১ হাজার আটটি। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা পাওয়া গেছে এক লাখ ৩২ হাজারের মতো। বাকি সব রিকশার নিবন্ধন নবায়ন করা হয়নি বা নিবন্ধন করাই হয়নি।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতায় নিবন্ধিত অযান্ত্রিক যানের সংখ্যা ৩০ হাজার ১৬২টি। এর মধ্যে নিবন্ধিত রিকশা ২৮ হাজার ১৫২টি, ভ্যান এক হাজার ৯৬৯টি, প্রাইভেট ভ্যান ৩১টি, ঠেলা গাড়ি ১০টি। এই সিটিতে নিবন্ধিত কোনো ঘোড়ার গাড়ি নেই। তবে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম এই সিটিতে ৩৫ হাজার নিবন্ধিত রিকশার কথা জানান। সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, বাকি রিকশাগুলো গুলশান, বনানী, বারিধারা ও বসুন্ধরার অধীনে নিবন্ধিত।

দুই সিটি করপোরেশনের আনুষ্ঠানিক এই হিসাবের বাইরেও লাখ লাখ রিকশা চলছে রাজধানী ঢাকায়। বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগের হিসাব বলছে, ঢাকায় পায়ে চালিত রিকশাই রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ। এর বাইরে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা আরও প্রায় আড়াই লাখ।

বেসরকারি গবেষণাতেও এই রিকশার সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি বলেই উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) ২০১৭ সালের এক গবেষণার তথ্য বলছে, ওই সময় ঢাকায় চলাচল করত ১১ লাখ রিকশা। এরপর আর রিকশা নিয়ে নতুন করে কোনো গবেষণা করেনি বিলস।

ওই গবেষণার পরিচালক বিলসের কনসালট্যান্ট ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক খন্দকার আব্দুস সালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাঁচ বছরে ঢাকায় রিকশা বেড়েছে, তা খালি চোখেই দেখা যায়। ৫ শতাংশ হারে বাড়লেও এর সংখ্যা এখন ১৫ লাখের কম হবে না।’

তবে এই গবেষকের এমন অনুমানের সঙ্গে কোনোভাবেই একমত নন রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইনসুর আলী। তাদের হিসাবের চেয়ে কিছু বেশি হবে স্বীকার করে নিলেও ১০-১৫ লাখ রিকশার সংখ্যাকে তিনি কাল্পনিক বলে অভিহিত করছেন। তবে সংখ্যা যতই হোক, রিকশাচালকদের বঞ্চনার বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত নেই কারও মধ্যেই।

রিকশা নিবন্ধন কেন জরুরি

শ্রমজীবী মানুষ নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত। সংগঠন বা সমিতির মাধ্যমে তারা তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে পারে। পেতে পারে অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা, সাহায্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে রিকশা-ভ্যানের চালকরা নির্দিষ্ট কোনো সংগঠনের অধীনে না আসায় তাদের পক্ষে অধিকারের জন্য কথা বলারও কেউ নেই। ফলে তারা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।

রিকশা-ভ্যানের চালকরা কী ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চনার শিকার— জানতে চাইলে শ্রমিক নেতা ইনসুর আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার যদি রিকশাচালকদের কোনো সাহায্য করতে চায়, কীভাবে করবে? নিবন্ধন সনদ থাকলেই না সেটা দেখিয়ে সুবিধা নেওয়া যায়। তা না থাকলে কীভাবে বোঝা যাবে যে সে রিকশাচালক? ঢাকায় অধিকাংশ রিকশাচালক বাইরে থেকে আসে। তারা অন্যের রিকশা চালায়। কেউ থাকে গ্যারেজে, কেউ বস্তিতে। নিজের রিকশা আছে— এ রকম চালক সংখ্যা সামান্য। বাকি যারা অন্যের রিকশা চালায়, তাদের নানা সমস্যা।’

সরকারিভাবে রাজধানীতে চলাচলকারী সব রিকশাকে নিবন্ধনের আওতায় আনার দাবি রয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। ছবি: সারাবাংলা

ইনসুর বলেন, ‘রিকশাচালকরা দিনমজুর গোত্রের। তারা টাকা জমায় না। অসুস্থ হলে বা বিপদে পড়লে তারা যদি রিকশা না চালাতে পারে, তাহলে না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা হয়। আবার মালিকের ইচ্ছামতো চলতে হয়। ঈদে রিকশাচালকদের একটা লুঙ্গি বা কিছু টাকা দেবে, এমন মালিক হাতেগোনা। ফলে রিকশাচালকরা সবদিক থেকেই বঞ্চিত। নিবন্ধনের আওতায় থাকলে তারা সরকারি সংস্থা বা মালিকের কাছ থেকেও দাবি-দাওয়া আদায় করতে পারে।’

এই শ্রমিক নেতা মনে করেন, রিকশা ভাড়ার নামে যাত্রীদের হয়রানিও বন্ধ করা সম্ভব রিকশাচালকরা নিবন্ধিত হলে। নিবন্ধন কড়াকড়িভাবে বাস্তবায়ন করলে অপরিণত চালকের হাতে রিকশা পড়ার সুযোগ কমে, দুর্ঘটনার ঝুঁকিও কমে। আবার নিবন্ধন ছাড়া রিকশা চলায় সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার যদি ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয় আর লাইসেন্স প্রতি ১০০ টাকাও নেয়, তাতেও সরকারের লাভ। তাতে রিকশাব্যবস্থাতেও শৃঙ্খলা আসে।

কী কী বিশৃঙ্খলা আছে— জানতে চাইলে ইনসুর আলী বলেন, ‘বর্তমানে প্রধান সমস্যা ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অন্যান্য যানবাহন। এগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ। বিদ্যুৎ অপচয় করছে, দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে। আবার এসব রিকশা নামিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা বিপুল অঙ্কের টাকা পকেটে পুড়ছে। যেহেতু এগুলো অবৈধ, তাই এলাকাভেদে কোথাও কোথাও থানাভিত্তিক টোকেন বাণিজ্যের নামে রিকশাপ্রতি দেড় হাজার টাকাও পকেটে ভরেন কেউ কেউ।’

রিকশা খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারি উদ্যোগের প্রত্যাশা জানিয়ে এই শ্রমিক নেতা বলেন, ‘রিকশা ঢাকা শহরের ঐতিহ্য। অনেক মানুষের জীবনযাপনের মাধ্যম। অল্প দূরত্বের যাত্রায় রিকশার বিকল্প নেই। আবার পায়ে চলা রিকশা পরিবেশবান্ধব। তাই রিকশা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ও রিকশাচালকদের অধিকার আদায়ের স্বার্থেই অবিলম্বে এই খাতে শৃঙ্খলা প্রয়োজন। প্রয়োজন নিবন্ধনব্যবস্থা চালু। কিন্তু সেটা সরকারি উদ্যোগে হতে হবে। কারণ গুলশান-বনানীর মতো জায়গায় সোসাইটির অধীনে যেসব রিকশা নিবন্ধিত, সেগুলোতে এককালীন পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। জ্যাকেটের জন্য আলাদা টাকা দিতে হয়েছে। তাই সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে রিকশাচালকদের নিবন্ধিত করতে হবে।’

ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক খন্দকার আব্দুস সালাম বলেন, ‘ট্রেড ইউনিয়ন করা আমাদের আইনি অধিকার। অঞ্চলভিত্তিক শ্রমিকরা মিলে সংগঠন করতে পারে। কিন্তু আমাদের গবেষণায় দেখেছি, ৩০ শতাংশের মতো রিকশাশ্রমিক অস্থায়ী। তাই ইউনিয়নের তালিকা করলে তাদের পাওয়া যায় না। রাজধানীতে রিকশাচালক ও মালিকদের বেশ কিছু ট্রেড ইউনিয়ন আছে। কারওয়ান বাজার ও সদরঘাটভিত্তিক ভ্যানচালকদের ট্রেড ইউনিয়ন আছে। রিকশাচালকদের ঠিকানা গ্যারেজভিত্তিক হওয়ায় তাদের স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কারণ দেখা যায় তারা অস্থায়ী শ্রমিক। এদের অধিকাংশই ভূমিহীন কৃষি মজুর।’

‘আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, বছরে ১২০ থেকে ১৪০ দিন গ্রামীণ কর্মসংস্থান থাকে, যা মূলত কৃষিভিত্তিক। এসব শ্রমিকরা বাকি ২২০ দিনের জন্য শহরে শ্রম বিক্রি করতে আসে। এদের অনেকেই নির্মাণশ্রমিক হয় বা রিকশা চালায়। রিকশা চালানোর কাজ খুঁজে পাওয়া সহজ। কারণ দেখা যায় তার এলাকারই কেউ না কেউ রাজধানীর কোনো গ্যারেজে রিকশা চালায়। তার মাধ্যমে সে হয়তো শিফটভিত্তি রিকশা চালানোর সুযোগ পায়। রিকশা নিয়ে গলিতে বের হলেও দৈনিক আয় ৫০০-৭০০ টাকা। তবে অসুস্থ হলে বা কোনো কারণে রিকশা চালাতে না পারলে তারা সংকটে পড়ে যায়,’— বলেন আব্দুস সালাম।

রিকশাচালকদের নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক মো. রেজাউল করিমের। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগে ইনফরমাল ইকোনমির ওপর এক গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, রিকশা-ভ্যান চালকদের কোনো সংগঠন, ফোরাম নেই। কাজ করলে টাকা আছে, না করলে নেই। একদিন ছুটি কাটালে তার পরিবার হয়তো না খেয়ে থাকবে।’

অধ্যাপক রেজাউল বলেন, ‘শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন লক্ষ্যণীয় মাত্রায় কমে যাচ্ছে। ফলে শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায় করতে ব্যর্থ হচ্ছে।’ কেন ট্রেড ইউনিয়ন কমে যাচ্ছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথমত শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। আবার অস্থায়ী শ্রমিক বেশি। যারা ঢাকায় থাকে তারাও জানে না সংগঠনের গুরুত্ব। এ বিষয়গুলোতে মনোযোগী হয়ে কাজ করতে হবে।’

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

ডিএনসিসি ডিএসসিসি ড্রাইভিং লাইসেন্সম রিকশা রিকশা নিবন্ধন রিকশাচালক রিকশাচালকের অধিকার শ্রমিক অধিকার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর