স্থলভাগে ‘সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী’ রেমাল, মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত প্রভাব
২৭ মে ২০২৪ ২৩:১৫
ঢাকা: গ্রীষ্মের এই সময়ে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় তৈরি এবং বাংলাদেশের উপকূলে আছড়ে পড়ার ঘটনা নতুন নয়। ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে ১৩টি ঘূর্ণিঝড়। এর মধ্যে সাতটিই তৈরি হয়েছে মে মাসে। এ বছরও মে মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে জানানো হয়েছিল ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কার কথা। সে আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। উপকূলে আঘাত হেনেছে ‘রেমাল’।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে উপকূলের ১৯ জেলার তছনছ অবস্থা। উপকূলের ছয় জেলায় প্রাণ হারিয়েছেন ১০ জন। তীব্র ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে দেড় লাখের বেশি ঘরবাড়ি। দেশের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলে ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা। আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে। এসব অঞ্চলে নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট। অতি ভারী বর্ষণ আর তীব্র জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ১৯ জেলার নিম্নাঞ্চলের কয়েক শ গ্রাম প্লাবিত। ক্ষতিগ্রস্ত কয়েক কোটি মানুষ।
এ তো গেল সরাসরি ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের ক্ষয়ক্ষতির কথা। ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভাগ অতিক্রম করে দুর্বল হয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হলেও এর প্রভাব কমেনি এতটুকুও। রাজধানী ঢাকাসহ এখন ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ ঝরিয়ে যাচ্ছে রেমালের স্থল নিম্নচাপ। একইসঙ্গে রয়েছে তীব্র ঝড়ো হাওয়া। এরই মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তীব্র ঝড়-বৃষ্টি বয়ে যাচ্ছে দেশজুড়েই।
আরও পড়ুন-
- ১৮ ঘণ্টা পর খুলল বঙ্গবন্ধু টানেল
- রেমাল: ১৯ উপজেলায় নির্বাচন স্থগিত
- জলাবদ্ধতায় আটকে পড়েছেন চসিক মেয়র
- বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ৫ লাখ মানুষ, পানিবন্দি ১০ হাজার
- ঘূর্ণিঝড় রেমালে ভোলায় শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু
- রাজশাহীতে রেমালের প্রভাবে বৃষ্টি, বইছে ঝড়ো বাতাস
- গভীর নিম্নচাপে রূপ নিয়েছে রেমাল, নামল মহাবিপৎসংকেত
- খুলনায় বাঁধ ভেঙে প্লাবিত লোকালয়, পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ
- রেমালের প্রভাবে নামছে বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রস্তুত ২ সিটি
- স্থলভাগে ১৬ ঘণ্টা কাটিয়ে শক্তি হারাল রেমাল, সারাদেশে ঝড়-বৃষ্টি
প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ যেভাবে দেশজুড়ে দুর্ভোগ ছড়িয়েই চলেছে, তা অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়ের তুলনায় কিছুটা অন্যরকম। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, অত্যন্ত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ও সাধারণত উপকূলে আঘাত করার পর পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে স্থলভাগ অতিক্রম শেষ করে। রেমালের ক্ষেত্রে সেই সময়ের সীমা কাজ করেনি। রেমাল উপকূলে আঘাত হানার পর স্থলভাগ পুরোপুরি অতিক্রম করতে সময় নিয়েছে প্রায় ১৬ ঘণ্টা! পূর্ণ শক্তি নিয়ে আঘাত করার পর স্থল নিম্নচাপ হয়ে স্থলভাগে প্রভাব রাখার সময়ের ক্ষেত্রেও রেমাল অন্যসব ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য বলছে, রোববার (২৬ মে) সন্ধ্যা ৬টার দিকে মোংলাকে পাশে রেখে খেপুপাড়া ও সাগর দ্বীপের মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে উপকূলে আঘাত শুরু করে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র রাত ৮টা নাগাদ উপকূলে উঠে পড়ে। সেই কেন্দ্র অতিক্রম করতে করতে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। এরপর পুরো ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল অতিক্রম শেষ করে ভোর নাগাদ। তখনো এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবেই স্থলভাগে অবস্থান করছিল।
রেমাল শেষ পর্যন্ত দুর্বল হয়ে ঘূর্ণিঝড় থেকে গভীর স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয় সোমবার (২৭ মে) সকাল ১০টায়। সে হিসাবে উপকূলে আঘাত হানার পর স্থলভাগ অতিক্রম করতে রেমাল সময় নিয়েছে প্রায় ১৬ ঘণ্টা! এই ১৬ ঘণ্টার প্রায় পুরোটা সময়ই রেমাল পূর্ণ শক্তিমত্তা নিয়ে স্থলভাগে অবস্থান করেছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এত দীর্ঘ সময় নিয়ে কোনো ঘূর্ণিঝড়ের স্থলভাগ অতিক্রমের ঘটনা তাদের অভিজ্ঞতায় নেই!
খুলনা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ ও সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. জুলফিকার আলী রিপন সোমবার সকালে সারাবাংলাকে বলেন, একটি ঘূর্ণিঝড় এত দীর্ঘ সময় ধরে স্থলভাগে পূর্ণ শক্তি নিয়ে অবস্থান করছে, এমন খুব একটা দেখা যায় না। এদিক থেকে রেমাল আগের ঘূর্ণিঝড়গুলোর তুলনায় আলাদা। এই শতকেই বেশকিছু বড় বড় ঘূর্ণিঝড় এসেছে। সেগুলোও এত দীর্ঘ সময় নিয়ে শক্তি ধরে রেখে স্থলভাগে তাণ্ডব চালায়নি।
সোমবার রাতে আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুকও জানালেন একই কথা। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কোনো ঘূর্ণিঝড়ই সাধারণত এত বেশি সময় ধরে স্থলভাগে আঘাত করে না। রেমালের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, এটি খেপুপাড়া উপকূলে আঘাত শুরু করে। এরপর আরও উত্তরে অগ্রসর হতে হতে সাতক্ষীরা হয়ে খুলনার কয়রা পর্যন্ত এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আকারে আঘাত করতে থাকে।’
‘সেখান থেকে এটি সোমবার সকাল ১০টার দিকে যখন দুর্বল হয়ে স্থল গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়, তখন এর অবস্থান যশোর এলাকায়। ২০০৭ সালে সিডর ও ২০০৯ সালে আইলা সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় ছিল। সেগুলোও স্থলভাগ অতিক্রম করতে সময় নেয় প্রায় ১০ ঘণ্টা করে। রেমাল তার চেয়েও অনেক বেশি সময় নিয়েছে। বলা যায়, এটি সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি সময় স্থলভাগে পূর্ণ শক্তি নিয়ে আঘাত করা ঘূর্ণিঝড়,’— বলেন আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক।
এখানেই শেষ নয়, সাধারণত কোনো ঘূর্ণিঝড় স্থলভাগ অতিক্রম শেষে দুর্বল হয়ে গভীর স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তিমত্তার ওপর ভিত্তি করে ওই নিম্নচাপের অবস্থান ও আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ঝড়-বৃষ্টি ঝরতে থাকে। রেমালের ক্ষেত্রে ঝড়-বৃষ্টির ব্যপ্তি ছড়িয়েছে সারা দেশে। অন্যদিকে স্থল নিম্নচাপের প্রভাবেও সাধারণত ১০-১২ ঘণ্টা বা কখনো কখনো তার চেয়ে কিছু বেশি সময় ধরে চলতে থাকে।
কিন্তু সোমবার সকাল ১০টায় ঘূর্ণিঝড়টি স্থল নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার পর সোমবার প্রায় মধ্যরাত পর্যন্তও দেশের কোথাও-ই রেমালের প্রভাব কমেনি। বরং কক্সবাজার থেকে শুরু করে ঢাকা হয়ে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতেও টানা ঝড়বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে রাত সাড়ে ১০টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত। আবহাওয়া অফিসের তথ্য বলছে, আগামীকাল মঙ্গলবার (২৮ মে) রাত পর্যন্ত এই প্রভাব থাকবে। সব মিলিয়ে রেমালের প্রভাব থাকবে ৪৫ ঘণ্টা বা প্রায় দুই দিন!
আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘(সোমবার) ভোরের দিকে খুলনার কয়রা ছাড়িয়ে যশোরের দিকে যেতে থাকে রেমাল। এরপর সকাল ১০টার দিকে যশোরে থাকা অবস্থাতেই এটি স্থল গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়। সন্ধ্যা পর্যন্তও সেটি ওই এলাকাতেই অবস্থান করছিল। এটি ধীরে ধীরে আরও উত্তরে অগ্রসর হচ্ছে এবং এই গতিটি অত্যন্ত ধীর। ফলে এর প্রভাবও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।’
এই আবহাওয়াবিদ আরও বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সাধারণত স্থলভাগে ওঠার পর এর ব্যপ্তি দ্রুত বাড়তে থাকে। আর সে কারণেই এটি ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে। কিন্তু রেমাল একই জায়গায় দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করছে। ফলে এর প্রভাবও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। এর আগে ৩৪ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থলভাগে আইলার প্রভাব ছিল। এবার রেমালের প্রভাব তাকেও অনেকটা বড় পরিমাণে ছাড়িয়ে যাবে।’
আবহাওয়া অফিসের তথ্য বলছে, রেমালের নিম্নচাপের প্রভাব মঙ্গলবার দিনভরই থাকবে সারা দেশে। এর মধ্যে মঙ্গলবার দুপুর নাগাদ দেশের পশ্চিমাঞ্চলে রেমালের নিম্নচাপের প্রভাব কমে আসবে। মঙ্গলবার রাত নাগাদ সারা দেশেই রেমালের প্রভাব অনেকটা কমে যাবে। এমনকি মঙ্গলবার দুপুর নাগাদও যদি রেমালের নিম্নচাপের প্রভাব শেষ হয়ে যায়, তবু এটি স্থলভাগে প্রভাব বিস্তারের সময়ের হিসাবেও ‘সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী’ ঘূর্ণিঝড় হয়েই থাকবে।
আবহাওয়া অধিদফতরের নিয়মিত পূর্বাভাসেও মঙ্গলবার দিনভর সারা দেশেই ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টির আভাস দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও ভারী বর্ষণও হতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশজুড়েই রেমালের প্রভাবে বাড়বে জনদুর্ভোগ।
এরই মধ্যে উপকূলের ১৯ জেলার কোটি কোটি মানুষ রয়েছেন চরম দুর্ভোগের মধ্যে। বিশেষ করে ভোলা, বরগুনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরিশাল, নোয়াখালী, চাঁদপুর, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চল সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় পানিবন্দি মানুষ বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। রয়েছে সুপেয় পানির সংকট। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও অল্প জায়গায় সবাইকে থাকতে হচ্ছে গাদাগাদি করে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় জেলা-উপজেলা প্রশাসনগুলো অবশ্য বলছে, ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত মানুষদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার ও পানি বিশুদ্ধ করার ট্যাবলেটের মজুত তাদের কাছে রয়েছে।
আরও পড়ুন-
- রেমালের প্রভাবে বৃষ্টি, ডুবল রাজধানী
- ঘূর্ণিঝড় রেমাল: বৃষ্টি থাকবে আরও ২ দিন
- মোংলা বন্দরে অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু
- রাজধানীতে ভেঙে পড়েছে দেড় শতাধিক গাছ
- চট্টগ্রাম বন্দর আংশিক চালু, জাহাজ ভেড়েনি এখনো
- ইবিতে ঝড়ে উপড়ে গেছে গাছ, বিদ্যুৎ-পানি নেই হলগুলোতে
- ঘূর্ণিঝড় রেমালে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন উপকূলীয় এলাকা
- ঘূর্ণিঝড় রেমাল: ১০ জনের প্রাণহানি, লক্ষাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত
- ১ কোটি ২৬ লাখ মানুষ বিদ্যুৎহীন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৮৫ কোটি টাকা
সারাবাংলা/টিআর
ঘূর্ণিঝড় ঘূর্ণিঝড় রেমাল ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় রেমাল রেমালের ক্ষয়ক্ষতি রেমালের প্রভাব