Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘নির্বাচনমুখী’ যাত্রায় সরকার, কারা থাকছেন সার্চ কমিটিতে

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩০ অক্টোবর ২০২৪ ১৪:৪৯

ঢাকা: নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন অনুযায়ী সার্চ কমিটি বা অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া ‘চূড়ান্ত’ হয়েছে হলে জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। আইন অনুযায়ী, এই সার্চ কমিটি হতে হবে ছয় সদস্যের। এরই মধ্যে কমিটির চার সদস্যের নাম জানাও গেছে। বাকি দুজনের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, দুয়েক দিনের মধ্যেই এই সার্চ কমিটির প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

স্বাধীনতার পর থেকে পাঁচ দশক পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন গঠনের কোনো বিধিবদ্ধ বিধান ছিল না দেশে। ২০২২ সালে তখনকার নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে আসতে থাকলে প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়। ওই আইন অনুযায়ীই সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত হয় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন, যাদের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

বিজ্ঞাপন

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ঠিক এক মাসের মাথায় গত ৫ সেপ্টেম্বর সেই কমিশন পদত্যাগ করে। এরপর থেকে দেশে কোনো নির্বাচন কমিশন নেই। এরও প্রায় দুই মাস পেরিয়ে এসে এবার নির্বাচন কমিশন গঠন হতে যাচ্ছে ২০২২ সালের সেই আইন মেনেই।

কী আছে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইনে

২০২২ সালের ১ নম্বর আইন হিসেবে পাস হয়েছিল ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’। আইন অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য প্রথমে ছয় সদস্যের একটি সার্চ কমিটি বা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন। কমিটির সদস্য কারা হবেন, সেটিও আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন- ইসি কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির প্রধান হচ্ছেন জুবায়ের রহমান

বিজ্ঞাপন

আইন অনুযায়ী, সার্চ কমিটির প্রধান হবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, যাকে মনোনীত করবেন প্রধান বিচারপতি। কমিটির সদস্যদের মধ্যেও থাকবেন একজন বিচারপতি। হাইকোর্ট বিভাগের এই বিচারপতিকেও মনোনীত করবেন প্রধান বিচারপতি।

কমিটির বাকি চার সদস্যের মধ্যে দুজন সাংবিধানিক পদের অধিকারী। তাদের একজন বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, আরেকজন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান। আর বাকি দুজনকে মনোনয়ন দেবেন রাষ্ট্রপতি। তাদের মধ্যে আবার একজন হবেন নারী।

নতুন সার্চ কমিটিতে থাকছেন কারা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) জানান, সার্চ কমিটি গঠন হয়ে গেছে। দুয়েকদিনের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হবে।

উপদেষ্টার এ ঘোষণার পর বিকেলেই সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়, সার্চ কমিটির প্রধান ও সদস্য হিসেবে যে দুজন বিচারপতি থাকবেন, এরই মধ্যে তাদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এ ক্ষেত্রে তিনি আপিল বিভাগ থেকে মনোনয়ন দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীকে। আর হাইকোর্ট বিভাগ থেকে প্রধান বিচারপতি মনোনীত করেছেন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামানকে।

সুপ্রিম কোর্ট সূত্রের এ তথ্য অনুযায়ী, নতুন সার্চ কমিটিতে প্রধান হিসেবে থাকছেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী। আর সদস্য হিসেবে থাকছেন হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান।

আরও পড়ুন- নির্বাচনের যাত্রা শুরু, সার্চ কমিটি নিয়ে শিগগিরই প্রজ্ঞাপন: আইন উপদেষ্টা

এদিকে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন অনুযায়ী, সার্চ কমিটিতে পদাধিকারবলে সদস্য হিসেবে থাকছেন বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. নুরুক ইসলাম। সদস্য হিসেবে আরও থাকছেন সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম।

সার্চ কমিটিতে একজন নারীসহ রাষ্ট্রপতি মনোনীত সদস্য থাকবেন দুজন। সে দুজনের নাম এখনো জানা যায়নি। সরকারের বিভিন্ন সূত্র জানা যাচ্ছে, প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমেই ওই দুজনের নামসহ পূর্ণাঙ্গ সার্চ কমিটি প্রকাশ করা হবে। তবে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এই দুজন হতে পারেন পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিন্নাতুননেসা তাহমিদা বেগম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক সি আর আবরার।

সার্চ কমিটি যেভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন করবে

ছয় সদস্যের এই সার্চ কমিটি নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য আইনে বর্ণিত যোগ্যতা অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুটি করে নাম প্রস্তাব করবে। সে হিসেবে নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য এই কমিটি ১০ জনের নামের একটি তালিকা পেশ করবে রাষ্ট্রপতির কাছে।

রাষ্ট্রপতি ওই তালিকা থেকে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও চারজন নির্বাচন কমিশনারের নাম চূড়ান্ত করে নির্বাচন কমিশন গঠন করে দেবেন। আর রাষ্ট্রপতির কাছে তালিকা দেওয়ার জন্য সার্চ কমিটি সময় পাবে ১৫ কার্যদিবস।

২০২২ সালে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন প্রণয়নের পর প্রথম সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছিল আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ও পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়া ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে। ওই কমিটি নিজেরা বৈঠক করার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে। শিক্ষক-সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এবং বিশিষ্টজনদের সঙ্গেও বৈঠক করে ওই কমিটি।

এ ছাড়া সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে আইনে উল্লেখ করা যোগ্যতা অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারর পদে যোগ্য ব্যক্তিদের নামও আহ্বান করে সার্চ কমিটি। দফায় দফায় বৈঠক করে ওইসব নাম থেকে শুরুতে ২০ জনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা যায়। এরপর সার্চ কমিটি সবশেষ একটি বৈঠকের মাধ্যমে সেখান থেকে ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেই তালিকা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সার্চ কমিটির কার্যক্রম।

নির্বাচন কবে

সার্চ কমিটি গঠন হলে আইন অনুযায়ী তাদের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য নাম প্রস্তাব করতে হবে৷ আইন উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী, দুয়েকদিনের মধ্যে এই কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি হলে সেক্ষেত্রে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেই কমিশনের অধীনে জাতীয় নির্বাচন কবে হবে?

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত প্রশ্ন সম্ভবত এটিই। এই প্রশ্নেই উত্তর তথা জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নিয়ে এখন পর্যন্ত সরকার বা কোনো দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য না এলেও জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে প্রক্রিয়ায় বড় একটি অগ্রগতি হিসেবে আইন উপদেষ্টার কাছ থেকে এলো সার্চ কমিটি ‘চূড়ান্ত’ হওয়ার খবর। উপদেষ্টা বলেছেন, এর মাধ্যে সরকার নির্বাচনের অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে।

শপথ নেওয়ার পর থেকেই নতুন সরকারের ভাষ্য ছিল, রাষ্ট্রকাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে তারপর আয়োজন করা হবে নির্বাচন৷ রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচিত সরকারের হাতে যত দ্রুতসম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তরকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সর্বোত্তম সমাধান অভিহিত করলেও তারাও সরকারকে সংস্কারের জন্য ‘যৌক্তিক’ সময় দেওয়ার কথাই জানিয়েছে। তবে এমন অভিমতও শুরু থেকেই কেউ কেউ দিয়ে এসেছেন যে সংস্কার প্রক্রিয়া ও নির্বাচনের প্রস্তুতি সমান্তরালভাবেই চলতে পারে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নিজে জাতির উদ্দেশে দেওয়া একাধিক ভাষণে বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর তথা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব সমাপনের মেয়াদ ঠিক করবে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ও জনসাধারণ। এর আগে সরকার কেবল ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন থেকে উৎসরিত রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা পূরণে কাজ করে।যেতে চায়।

জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, এ নিয়ে অবশ্য এর মধ্যে নানা ধরনের অভিমত এসেছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সরকার সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে করতে দেড় বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও এক টিভি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে।

আসিফ নজরুল অবশ্য পরে এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, নানা ধরনের শর্ত উল্লেখ করে তিনি ওই সম্ভাব্য সময়ের কথা উল্লেখ করেছিলেন। ওইসব শর্ত পূরণ হলেই কেবল ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে— এমনটিই ব্যাখ্যায় বলেন তিনি। আরও জানান, নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ ও ঘোষণার এখতিয়ার কেবল প্রধান উপদেষ্টার।

এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে একাধিক দফায় রাজনৈতিক সংলাপে অংশ নিয়েছে। ওইসব বৈঠকে দলগুলো রাষ্ট্র সংস্কারের কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতির তাগিদ দিয়েছে।

স্বস্তি আনবে ‘নির্বাচনমুখী’ যাত্রা

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে আসার সূত্রে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের জনসমর্থন নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে যেকোনো বিচারেই এটি অনির্বাচিত সরকার, যা সংবিধানের একটি ধারা ব্যবহার করে অনুমোদিত হলেও জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়।

তারা বলছেন, গণঅভ্যুত্থান থেকে পাওয়া ম্যান্ডেট নিয়ে এই সরকার সংবিধান উপেক্ষা করে বিপ্লবী সরকার হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করলে সেটি এক ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করত। কিন্তু এই সরকার গণঅভ্যুত্থান থেকে উৎসরিত চেতনা ধারণ করলেও কার্যক্রমের দিক থেকে সংবিধান অনুসরণ করেই দেশ পরিচালনার চেষ্টা করছে। এমনকি অন্যান্য খাতের মতো নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারের কথা বললেও নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্যও সেই পুরনো আইনের অধীনেই সার্চ কমিটি পর্যন্ত গঠন করছে। ফলে কোথাও কোনো সংকট থেকে থাকলে সেটি এখানেই। ফলে সংস্কার চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচনমুখিতা সরকারের কার্যক্রম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বস্তি দেবে।

নির্বাচনের তারিখ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার গঠনের পর দেড় বছর বা ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা হচ্ছে। নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনের পর ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য কিছু সময় লাগবে। এর মধ্যে সংস্কার কমিশন তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নর পর ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন অসম্ভব কিছু নয়।

সারাবাংলা/টিআর

অন্তর্বর্তী সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় নির্বাচন নির্বাচন কমিশন সার্চ কমিটি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর