যে কারণে ফের ভোটাররা বেছে নিলেন ট্রাম্পকে
৭ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৩৬
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিন অঙ্গরাজ্যের ফল ঘোষণা বাকি থাকতেই ২৯৪টি ইলেকটোরাল কলেজ নিশ্চিত করে দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউজের দরজায় এখন ট্রাম্প।
ধারণা করা হচ্ছিল এবারের নির্বাচনে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই জমতে পারে। নির্বাচন পূর্ববর্তী জরিপের ফলাফলে সেই চিত্রই ওঠে এসেছিল। এমনকি সবশেষ জরিপেও কমলা হ্যারিস রিপাবলিকান প্রার্থীর থেকে ১ শতাংশ এগিয়ে ছিলেন। তবে সব হিসাব আর কাজে আসেনি, বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ইতিহাসে নিশ্চিতভাবে এটিই সবচেয়ে নাটকীয় প্রত্যাবর্তন। হোয়াইট হাউজ ছাড়ার চার বছর পর আবারো সেই কার্যালয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরতে যাচ্ছেন ট্রাম্প। কোটি কোটি মার্কিন ভোট দিয়ে দ্বিতীয় দফায় তাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছেন।
ট্রাম্পের এবারের নির্বাচনি প্রচারণার পর্বকে ইতিহাসের অংশ বললে কম বলা হবে না। প্রচারণার সময় ট্রাম্পকে দুই দফা হত্যা চেষ্টা হয়, তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন নির্বাচনের কয়েক মাস আগে নাম সরিয়ে নেন।
মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেই অঙ্গরাজ্যগুলোতে হয়েছে, সেসব অঙ্গরাজ্যে ভোটাররা ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ভোটারদের অনেকেই ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার পেছনে অর্থনীতি ও অভিবাসনের মত ইস্যুগুলোকে সামনে রাখছেন।
আগের নির্বাচনে, ২০২০ সালে, জো বাইডেনের কাছে হারলেও নির্বাচনের ফল মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন ট্রাম্প। নির্বাচনে হারার পরও প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকার জন্য সেবার তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেসব কার্যক্রমের সমালোচনা এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
২০২১ সালের ছয়ই জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলের সহিংস হামলার দায়ে তার বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। পাশাপাশি, ব্যবসায়িক নথি জাল করার দায়ে গত বছর অভিযুক্ত হওয়ায় তিনি প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন যাকে আদালত অপরাধী হিসেবে রায় দিয়েছেন।
কাজেই ট্রাম্পকে নিয়ে তীব্র বিতর্ক তৈরি হওয়ার বিষয়টি খুব একটা অবাক হওয়ার মত বিষয় নয়।
প্রচারের পুরোটা সময় ট্রাম্প বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেছেন, তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হেয় করে কৌতুক করেছেন ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
অর্থনীতি নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্য যেভাবে সাড়া ফেলেছে
নির্বাচনি প্রচারের সময় যত মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই বলেছেন যে তারা সুযোগ পেলে ট্রাম্পের ‘দুর্গন্ধযুক্ত কথাবার্তা’ বন্ধ করে দিতেন— কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার পক্ষপাতী।
কারণ হিসেবে তারা ট্রাম্পের একটি প্রশ্নের ওপর জোর দিচ্ছেন যেটি তিনি সব র্যালিতে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনারা কি দুই বছর আগের তুলনায় এখন ভালো আছেন?’
ট্রাম্পকে ভোট দেওয়া বহু মানুষ বলেছেন, তারা মনে করেন ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তারা বর্তমানের চেয়ে ভালো ছিলেন।
অর্থনৈতিক মন্দা বা মূল্যস্ফীতির মত অর্থনৈতিক সংকটের জন্য বাইডেন প্রশাসন দায়ী বলে মনে করেন ভোটারদের একটা বড় অংশ।
বাইডেন প্রশাসনের অধীনে রেকর্ড মাত্রার অবৈধ অভিবাসন নিয়েও ভোটারদের একটা বড় অংশকে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করতে দেখা যায়। ট্রাম্প বা তার সমর্থকদের মতো এই ভোটারদের অনেকেই সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের পক্ষপাতী।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার নীতি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’
এবারের নির্বচানি প্রচার ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
পুরো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ডানপন্থি ও বামপন্থিদের মধ্যে আমি হতাশা দেখতে পেয়েছি একটি বিষয়কে ঘিরে– তা হলো, তারা মনে করেন ইউক্রেনে যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে তা যদি আমেরিকার ভেতরে খরচ করা হত তাহলে তা আমেরিকার অর্থনীতিকে অনেক শক্তিশালী করতে পারতো।
এই বিষয়টি মাথায় রেখে অনেকেই কমালা হ্যারিসকে ভোট দিতে পারেননি যিনি চার বছর জো বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা মনে করেছেন যে কমালা হ্যারিসকে ভোট দিলে ইউক্রেন বিষয়ক নীতি অনেকটা একরকমই থাকতো।
তবে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসলে মার্কিন নীতির কতটা পরিবর্তন হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের মধ্যে।
২০১৬ সালে তিনি যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন তখন রাজনৈতিকভাবে অনেকটা বহিরাগতই ছিলেন। সেসময় শুরুতে একটা সময় পর্যন্ত তিনি অভিজ্ঞ রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের পরামর্শ নিয়েছেন। তবে এই দফায় তিনি খুব একটা নিয়মমাফিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চান বলে মনে হয় না।
ঐ উপদেষ্টাদের অনেকেই পরবর্তীতে ট্রাম্পকে ‘মিথ্যাবাদী’, ‘ফ্যাসিস্ট’, ‘অনুপযুক্ত’ বলে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তাদের মতে, এ দফায় ট্রাম্প যদি তার অনুগতদের পাশে রেখে শাসনকাজ পরিচালনা করেন, তাহলে খুব শীঘ্রই তিনি তার চরমপন্থী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে দেবেন।
এবারের নির্বাচনে ভোটারদের সামনে আমেরিকার দুইটি দিক তুলে ধরা হয়েছিল।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোটারদের বলেছিলেন যে তাদের দেশ ক্রমাগত ধ্বংসের পথে যাচ্ছে এবং শুধুমাত্র তিনি দেশকে ‘আবারো মহান দেশে পরিণত’ করতে পারবেন।
অন্যদিকে, কমলা হ্যারিস সতর্ক করেছিলেন যে যদি ট্রাম্প নির্বাচিত হন তাহলে আমেরিকার গণতন্ত্রই অস্তিত্বের সংকটে পড়বে।
ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রচারে রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার কিম জং আনের মত কর্তৃত্ববাদী নেতাদের প্রশংসা করেছেন। তার বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘তারা তাদের ক্ষেত্রের শীর্ষে রয়েছেন, আপনার ভালো লাগুক আর না লাগুক।’
তিনি গণমাধ্যমে তার সমালোচনা বন্ধ করার বিষয়েও কথা বলেছেন। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে তিনি এমন মন্তব্যও করেছেন যে গণমাধ্যমের কর্মীরা মারা গেলেও তিনি খুব একটা ব্যথিত হবেন না।
তবে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এখন মানুষ হয়তো বাস্তবিক জানতে পারবে যে এতদিন প্রচারের সময় তিনি যা যা বলেছেন, তার কতটুকু বলার জন্য বলা আর কতটুকু আসলেই তিনি বাস্তবায়ন করতে চান।
প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পাননি। এবার দ্বিতীয় দফায় তার প্রস্তাবিত অনেক পরিকল্পনাই হয়তো বাস্তবে রূপ দিতে চাইবেন তিনি।
আর মনে রাখতে হবে শুধু যে আমেরিকানরাই ট্রাম্পকে দ্বিতীয় দফায় মোকাবিলা করতে যাচ্ছে, তা নয়। বাকি বিশ্বও দেখতে পাবে যে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বলতে তিনি আসলে কী বোঝান।
যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব, ইউক্রেন আর মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধ করার দাবি সহ ট্রাম্পের দাবি করা বিভিন্ন নীতি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সেগুলো এখন দেখার বিষয়।
ক্ষোভ ও হতাশার অনুভূতি
হোয়াইট হাউজে ফিরে আসার পর ট্রাম্পের ওপর নিয়ন্ত্রণ অনেক কম থাকবে। তিনি দ্রুত একটি ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছেন, যা আমেরিকার প্রশাসনের প্রায় সব দিক পরিবর্তন করবে।
কংগ্রেসে তার রিপাবলিকান সমালোচকরা বেশিরভাগই পরাজিত বা অবসর নিয়েছেন। ফেডারেল আদালতগুলো এখন তার নিয়োগকৃত বিচারক দিয়েপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে তিনজন ট্রাম্প-নিযুক্ত বিচারক রয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট এ বছর একটি রায় জারি করে যা প্রেসিডেন্টদের ব্যাপকভাবে বিচার থেকে দায়মুক্তি দেয়।
কমলা তার প্রাথমিক বার্তায় বেশিরভাগ আনন্দের ওপর জোর দেন, কিন্তু ট্রাম্প ভোটারদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার গভীর অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলে তা কাজে লাগান।
তিনি জনগণের মধ্যে উচ্চ মূল্য নিয়ে হতাশা এবং অপরাধের আতংক এবং বাইডেনের শাসনামলে অবৈধভাবে প্রবেশকারী অভিবাসীদের প্রতি ক্ষোভকে কেন্দ্র করে নিজের প্রচারণা চালান।
তিনি মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণকে ব্যবহার করে ডেমোক্র্যাটদের এক বিশৃঙ্খল বিশ্বের নিয়ন্ত্রক ও উৎসাহদানকারী হিসেবে তুলে ধরেন।
এটি ছিল এমন একটি কৌশল, যা ট্রাম্প ২০১৬ সালে নিখুঁতভাবে ব্যবহার করেন। তিনি প্রায়শই স্বৈরশাসকদের মতন ভাষা ব্যবহার করে নিজেকে দেশের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে সক্ষম একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন।
আততায়ীর ব্যর্থ প্রচেষ্টা
তবে সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুহূর্তটি আসে জুলাই মাসে, যখন পেনসিলভেনিয়ার বাটলারে ট্রাম্পের একটি সমাবেশে একজন বন্দুকধারী গুলি চালায়। একটি গুলি ট্রাম্পের কানের পাশে দিয়ে যায় এবং তার এক সমর্থক নিহত হন।
রক্তমাখা মুখ নিয়ে, ট্রাম্প দাঁড়িয়ে মুষ্টি উঁচিয়ে চিৎকার করে বলেন, ফাইট! ফাইট! ফাইট! ‘লড়ো! লড়ো! লড়ো!’
কয়েক সপ্তাহ পর, গলফ খেলার সময় গাছের আড়াল থেকে একটি বন্দুকের ব্যারেল দেখতে পেয়ে সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা তার উপর দ্বিতীয় হত্যাচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়।
মামলায় শক্তি
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ ওঠেছিল। সেসব কারণে মামলার মুখোমুখিও হতে হয়। বিদ্রোহে তার ভূমিকা, গোপন তথ্য পরিচালনা এবং নির্বাচন হস্তক্ষেপের জন্য রাজ্য এবং ফেডারেল অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
তিনি অভিযোগগুলোকে নিজেকে একটি অত্যধিক ক্ষমতাশালী সরকারের শিকার হিসাবে চিত্রিত করার জন্য ব্যবহার করেন। এই যুক্তি রিপাবলিকান পার্টির মূল সমর্থকদের মধ্যে সাড়া ফেলে। এই সমর্থক গোষ্ঠী সরাসরি শত্রু মনোভাব পোষণ না করে থাকলেও ক্রমবর্ধমানভাবে প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতা কাঠামোর প্রতি সন্দিহান ছিল।
(বিবিসি’র উত্তর আমেরিকার সম্পাদক সারাহ স্মিথ ও ভয়েজ অব আমেরিকার প্রতিবেদন অনুসারে)
সারাবাংলা/এইচআই