৮ ডিসেম্বর ১৯৭১— মুক্ত হয় বৃহত্তর কুমিল্লা
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:১০ | আপডেট: ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০২:২৮
১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর। এ দিন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পতন হয়। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর, তথা বৃহত্তর কুমিল্লা মুক্ত হয়। তবে অবরুদ্ধ ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে তখনো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ক্রিয় অবস্থান ছিল।
কুমিল্লা বিমানবন্দরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিসেনারা আর্টিলারি আক্রমণ চালিয়ে শেষ রাতের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। রাতব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। হানাদার বাহিনীর কতিপয় সেনা বিমানবন্দরের ঘাঁটি ত্যাগ করে শেষ রাতে বরুড়ার দিকে ও সেনানিবাসে ফিরে যায়। কুমিল্লা বিমানবন্দরের ঘাঁটিতে ধরা পড়া কতিপয় পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে।
সে দিন কুমিল্লার রাস্তায় নেমে আসে জনতার ঢল। আপামর জনগণ মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে নেয়। বিজয়ের আনন্দে মিত্রবাহিনীর শিখ সৈন্যদের দুই চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। তবে সে অশ্রু ছিল আনন্দের অশ্রু।
বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী জনতার উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। তৎকালীন পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জহুর আহমেদ চৌধুরী দলীয় পতাকা এবং মুক্ত কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক অ্যাডভোকেট আহমদ আলী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত হওয়ার পর সর্বত্র উড়ানো হয় লাল-সবুজ পতাকা। বিজয়ের আনন্দে জয়বাংলা স্লোগানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। চাঁদপুরে বিজয়ের সুবাতাস বয়। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা ট্যাংক নিয়ে চাঁদপুরে প্রবেশ করে এবং পলায়নপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়। চাঁদপুর সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়।
কিছু বিচ্ছিন্ন জায়গা ছাড়া মেঘনা নদীর পূর্বপার মিত্র-মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর তখনো মুক্ত হয়নি। অবশ্য পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি তিতাস-ডোলভাঙা নদী বেষ্টিত বাঞ্ছারামপুর থানা মুক্তিযোদ্ধারা অবরুদ্ধ করে রাখে।
এ দিন যশোর ক্যান্টনমেন্ট মিত্র-মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়। দাউদকান্দি, ইলিয়টগঞ্জ, বিদ্যাকূট, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), হাজিগঞ্জ, মিরসরাই (চট্টগ্রাম), ঝালকাঠি, কালকিনি (মাদারীপুর), দৌলতপুর (কুষ্টিয়া), মিরপুর (কুষ্টিয়া), মেলান্দহ (জামালপুর), মাগুরা মুক্ত হয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সবেধন নীলমনি দুটি স্যাবার জেট মিত্রবাহিনী ভূপাতিত করে।
শহর-নগর-বন্দর-গ্রাম একের পর এক জয় করে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী ঢাকার দিকে ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসতে থাকে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিজয় ও মুক্ত এলাকার তাজা খবর আসতে থাকায় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে যৌথবাহিনীকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত রক্ত গরম করা রণসংগীত বাজাতে থাকে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সব জায়গায় পরাস্ত হয়। সারা বাংলাদেশে তারা অবরুদ্ধ হয়। আত্মসমর্পণ করছে অথবা আত্মসমপর্ণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ দিন হানাদার বাহিনীকে লক্ষ্য করে বিমান থেকে আত্মসমর্পণের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দলখলদার বাহিনীর উদ্দেশে যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল মানেকশের লেখা ওই বার্তায় দ্রুত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। সেই সঙ্গে এ আশ্বাসও দেওয়া হয়, আত্মসমর্পণ করলে তাদের প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক আচরণ করা হবে।
কিন্তু রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা চাইছিলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এভাবে আত্মসমর্পণ না করুক। যুদ্ধের মাধ্যমে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে জীবনের তরে বাংলার মাটিতে তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়া ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মূল উদ্দেশ্য। মুক্তিযোদ্ধাদের মনের এই অবস্থা ঠিকই বুঝে ফেলেছিল মিত্রবাহিনী। এরপর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্ত এলাকার জনগণের উদ্দেশ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার নির্দেশনা প্রচার করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার।
সারাবাংলা/এজেড/টিআর