Monday 03 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ও তৈরিতে যাদের অবদান

ফারাহানা নীলা
২ মার্চ ২০২৫ ০৮:৫৭ | আপডেট: ২ মার্চ ২০২৫ ১৭:০৬

২ মার্চ প্রথম পতাকা উত্তোল করা হয়।

ঢাকা: আজ ২ মার্চ। বাংলাদেশের জন্য একটি গর্বের দিন। অহংকারের দিন। এই দিনেই বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে উড়ানো হয় বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা।

এই পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অনেক ইতিহাস। সেই ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত আছে অনেকের বীরত্ব ও সাহসীকতার পরিচয়। সেইসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকেই জানা গেছে সেদিনের ইতিহাস।

প্রথম বাংলাদেশের পতাকার নকশা করেন শিবনারায়ন দাশ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলের ছাত্রনেতা শিবনারায়ন দাশ । বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রথম নকশাকারক তিনি।

বাংলাদেশের পতাকার নকশা করেন শিবনারায়ন দাশ।

সেদিনের ইতিহাস তুলে ধরে শিবনারায়ন দাশ বলেন, ‘১৯৭০ সালের ৬ই জুন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাত ১১টার পর পুরো পতাকার নকশা সম্পন্ন করেছিলাম। ১৯৭০ সালের ৭ই জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে অংশ গ্রহণের কথা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়। ছাত্র নেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এই লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে সবার আলোচনার শেষে সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এরপর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে রাত ১১টার পর পুরো পতাকার ডিজাইন সম্পন্ন করি আমি শিবনারায়ন দাস।’

(২০২৪ সালের ১৯ এপ্রিল ৭৭ বছর বয়সে ঢাকার পিজি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয় )

১৪ বছরের দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে পতাকা তৈরি করে আনেন কামরুল আলম খান খসরু

মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা সিটি গেরিলা কমান্ডার ও বিএলএফের অন্যতম সদস্য কামরুল আলম খান খসরু। নিজ হাতেই লিখেছেন সেদিনের গল্প :

পতাকা তৈরি করে আনেন কামরুল আলম খান খসরু। ছবি: সংগৃহীত

‘‘সেদিন ১৯৭০-এর ৬ জুন। শিবনারায়ণ দাস অতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে ড্রইংটি (পতাকার নকশা ) মধ্যরাতে এনে সিরাজ ভাইয়ের হাতে দেন। পতাকাটি তৈরি করে এনে দেওয়ার জন্য দরকার পড়ে সাহসী ও বিচক্ষণ এক কর্মীর। সেই মধ্যরাতে আমাকে ডেকে আনা হয় ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে। সিরাজ ভাই আমাকে কাপড় সংগ্রহ করে দর্জি দিয়ে সেলাই করে ড্রইংমতো পতাকা তৈরি করার দায়িত্ব অর্পণ করেন। আমি তখন মার্শাল ল কোর্ট কর্তৃক ১৪ বছরের দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে সাবধানতার সঙ্গে চলাফেরা করছি। সিরাজ ভাই আমাকে বলেন, ‘যেখান থেকে পারিস এই ড্রইং অনুযায়ী একটি পতাকা তৈরি করে নিয়ে আয়, রাত ফুরাবার আগেই।’’

তিনি বলেন, ‘আমি নিউমার্কেট এলাকা সংলগ্ন বস্তির (এখন সেখানে বড় মার্কেট) এক অবাঙালি দর্জির দোকানে গিয়ে দরজা নক করে বলি, আমার একটি পতাকা তৈরি করতে হবে, দরজা খোলো। তাকে ড্রইংটি দেখিয়ে বলি, এমন একটি পতাকা তৈরি করে দিতে হবে; তাড়াতাড়ি চাই। আমি তার দোকানে লাল, সবুজ, সোনালি রঙের কাপড়ের বান্ডিল খুঁজতে থাকি, কিন্তু পাইনি। অবাঙালি দর্জি বলে, এই রঙের কাপড় পাওয়া যেতে পারে খালেক দর্জির দোকানে। খালেক দর্জির দোকানটি আবার বলাকা ভবনের তিন তলায় । আমি অবাঙালি দর্জিকে খালেকের দোকানে গিয়ে আমার কথা বলে ড্রইংমতো পতাকা তৈরি করে আনতে বলি। দর্জি রওনা হওয়ার পর শঙ্কায় পড়ি- ড্রইং হাতে নিয়ে দর্জি গিয়ে পাকিস্তানি আর্মিদের ডেকে না আনে! কারণ তখনকার পরিস্থিতি এমন ছিল যে, কাউকে বিশ্বাস করা যেত না। আমি নিউমার্কেটের ছাদে থাকার সময়েই মেশিনে কাপড় সেলাই করার আওয়াজ ভেসে আসে। আমি পতাকার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। দর্জি এসে বলে, ‘নেন খসরু ভাই। খালেকের কাছে কাপড় ছিল। ও বানিয়েও দিল।’’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘আমি পতাকাটি খুলে এক ঝলক দেখে তা ভাঁজ করে গেঞ্জির মধ্যে ঢুকিয়ে গন্তব্যে রওনা হই। রেললাইন এবং হলের প্রাচীর টপকে পৌঁছাই ইকবাল হলের পশ্চিম দিকের গেটের কাছে (এখন সেখানে এক্সটেনশন বিল্ডিং)। রাত তখন শেষ প্রহর। আমি হলে প্রবেশ করে দেখি, ছাত্র নেতারা রুদ্ধশ্বাসে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। সিরাজ ভাইয়ের হাতে পতাকাটি তুলে দিলে তিনি আমায় জড়িয়ে ধরে বলেন- ‘আমি জানি, তুই পারবি। তখন সবাই বলল, খসরুর নামও ইতিহাসে লেখা থাকবে।’’

প্রথম পতাকা বহনকারী মুহিবুল ইসলাম ইদু

মুহিবুল ইসলাম ইদু, ১৯৭১ সালে তিনি সিদেস্বরী ডিগ্রী কলেজের আই এ’র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। নিজের হাতে লেখা সেদিনের ইতিহাস তুলে দেন তিনি :

প্রথম পতাকা বহনকারী মুহিবুল ইসলাম ইদু

‘১৯৭১ সালের মার্চ মাসের এক তারিখে যখন পাকিস্তানি সরকার নির্বাচিত সংসদ ভেঙ্গে দেয় তখন স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে। সেই সময়কার পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার পাশাপাশি ঘোষণা দিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পতাকা কোথাও প্রদর্শন বা বহন করা যাবে না। এমনকি যারা পতাকা বহন বা প্রদর্শন করবে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হবে।

সেই ঘোষণার পরপরই বিক্ষোভে ফেটে পরে ছাত্ররা। সর্বদলীয় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবে।

‘আমি যখন মিছিল সহকারে পতাকা বহন করে নিয়ে আসছিলাম তখন পথে রমনা পার্কের বিপরীতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনের সামনে আমাদের মিছিলকে সেনাবাহিনী আটকে দেয়, কিন্তু আমাদের সাথে মানুষের এতবেশী উপস্থিতি ছিলো যে সেনারা পিছু হটে আমাদের পথ করে যেতে দিতে বাধ্য হয়। ‘গুলবাগ থেকে মিছিল শুরু করার পর থেকে দলে দলে মানুষ আমাদের সাথে যোগ দিতে থাকে। মুক্তিপাগল মানুষ তখন স্বাধীনতার জন্য মুখিয়ে ছিলো আর সেজন্যই পতাকা দেখে তারা আবেগ তাড়িত হয়ে পরে। সেজন্য শাসকের বন্দুকের মুখেও তারা ভীত হয়নি।’এই হাজার হাজার মানুষের মিছিল নিয়ে জনতার ঢল ঠেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে যাই । তুলে দেই ছাত্র নেতা শেখ মো. জাহিদ হোসেনের হাতে। তিনি ওই পতাকাটি একটি বাঁশের আগায় বেঁধে বটতলায় গিয়ে আ স ম আব্দুর রব এর হাতে তুলে দেন।

(২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি চিরবিদায় নেন মুহিবুল ইসলাম ইদু)

২ মার্চ ব্যাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করে আ স ম আব্দুর রব। ছবি: সংগৃহীত

ছাত্রলীগ নেতা এবং তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ স ম আব্দুর রব । তিনিই প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। সেদিনের ইতিহাস তিনি নিজে বহুবার বলেছেন গণমাধ্যমকে।

‘১৯৭১ এর ২ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এক বিশাল সমাবেশ হয়। আমাদের আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল, এদিন আমরা পতাকা উত্তোলন করবো। সেই সমাবেশে আমি যখন বক্তৃতা করছিলাম। তখন নগর ছাত্র নেতা শেখ জাহিদ হোসেন একটি বাঁশের মাথায় পতাকা বেঁধে রোকেয়া হলের দিক থেকে মঞ্চস্থলে মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসেন। পতাকা তুলে দেন আমার হাতে। আমি তখন সেই পতাকা তুলে ধরি। ‘আমি পতাকাটা এভাবে মেলে ধরার পর মনে হলো গোটা ঢাকা শহর চিৎকার দিয়ে উঠেছে, পুরো বাঙালি জাতি চিৎকার করে বলছে, ‘জয় বাংলা’। এটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমি না হলে এটা হয়তো আরেকজন এই পতাকা উত্তোলণ করতো। এটা বাঙালি জাতির অর্জন।’

সেদিন-ই প্রথম উত্তোলন হয়, বাংলাদেশে জাতীয় পতাকা ।

[ তথ্যসূত্র : ২০২০ সালে মুঠোফোনে নেওয়া সাক্ষাতকারের মাধ্যমে ]

সারাবাংলা/এফএন/এমপি

জাতীয় পতাকা জাতীয় পতাকা উত্তোলন দিবস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর