শুটকিপল্লির নারী শ্রমিকরা বেতন পান পুরুষের অর্ধেক
১ মে ২০২৫ ১০:০২
কক্সবাজার: জেলার নাজিরারটেক শুটকিপল্লি। এখানে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি-ই নারী শ্রমিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো- নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাত্তার পাশাপাশি বেতন বৈষম্যেরও শিকার হতে প্রতিনিয়ত। তারা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সমান তালে কাজ করেও বেতন পান পুরুষের অর্ধেক। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে মানবেতর দিন কাটছে ভুক্তভোগী নারী শ্রমিকদের। তাদের প্রত্যাশা শ্রমের ন্যায্য মূল্য।
শুটকি মহাল মালিক সমিতির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, শহরের সমুদ্রের পাড়ের ১ নম্বর ওয়ার্ডে ২৫০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এশিয়ার সর্ববৃহৎ শুটকিপল্লি নাজিরারটেকে প্রায় ৫০০ শুটকি মহাল রয়েছে। যেখানে তিন হাজারের বেশি ব্যবসায়ীর অধীনে প্রায় ৩৫ হাজারের বেশিও শ্রমিক কাজ করেন।
শুটকি উৎপাদনে নারী শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও তারা পাচ্ছে পুরুষের অর্ধেক মজুরি। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে নারী শ্রমিকদের দেওয়া হচ্ছে তিনশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা। অন্যদিকে একই সময় পর্যন্ত কাজ করা পুরুষদের দেওয়া হচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত। দীর্ঘদিন চলে আসা এই বেতন বৈষম্যে হতাশ নারী শ্রমিকেরা।
নাজিরারটেকের নারী শ্রমিকদের মধ্যে ছেনুয়ারা আক্তার সারাবাংলা বলেন, ‘দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আমি শুটকিপল্লিতে কাজ করছি। সেই ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ করে বর্তমানে ৫০০ টাকা পাই। পুরুষেরা পায় ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমান বাজারে এই ৫০০ টাকা দিয়ে আসলে কিছুই হয় না।’
মোবারেকা নামে আরেক নারী শ্রমিক সারাবাংলার এই প্রতিবেদকে বলেন, ‘পুরুষদের তুলনায় বেতন কম হলেও কিছু করার নেই। পেটের দায়ে কাজ করতে হচ্ছে। আবার অনেকে দাদনের টাকার জালে আটকা পড়ে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নামমাত্র মজুরিতে কাজ করছে। বেতন বাড়ানোর প্রতিবাদ করলে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেয়। এভাবে অনেককে বেতন না দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে।’
ফাতেমা বেগম নামে আরেক নারী শ্রমিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বামী সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। পাঁচ সন্তান নিয়ে জীবন চালানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই যা দিচ্ছে সেটা নিয়ে দিয়েই কাজ করতে হচ্ছে। পাঁচ সন্তানের সংসারে এই টাকায় কিছুই হয় না। অনেক সময় শরীর আর পারে না।

নাজিরারটেক শুটকিপল্লির অর্ধেকের বেশি-ই নারী শ্রমিক। ছবি: সংগৃহীত
নারীদের বেতন বৈষমের নিয়ে একাধিকবার আওয়াজ উঠলেও অসাধু মালিক সিন্ডিকেটের কারণে আশানুরূপ ফলাফল আসেনি। অনেকে যুক্তি হিসেবে দেখাচ্ছেন, পুরুষেরা ভারী কাজ করে। তবে এবারে এর পরিবর্তন আশা করছে সচেতন ব্যবসায়ীরা।
লিয়াকত হোসেন নামে শুটকি মহাল ব্যবসায়ী সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুটকি মহালে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। পুরুষ শ্রমিকের চাহিদা থাকলেও কম পাওয়া যায়। এছাড়া পুরুষেরা যেসব ভারী কাজ করতে পারে নারীরা তা পারে না। তাই নারীদের বেতন কম দেওয়া হয়। তবে আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে।’
নাজিরারটেক এলাকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও তরুণ ব্যবসায়ী দিদারুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলে, ‘গেল সরকারের আমলে নারী-পুরুষ উভয়ই অনেককিছু থেকে বঞ্চিত ছিল। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে শ্রমের মজুরিতে বৈষম্য করেছে। আমাদের আশা, এই সরকারের আমলে বৈষম্য দূর হবে। নারীরা যেমন তাদের ন্যায্য শ্রমের মর্যাদা পাবে, ঠিক তেমনি পুরুষেরাও পাবে তাদের শ্রমের মূল্য।
এই প্রসঙ্গে কক্সবাজার শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি আমিনুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই সমস্যা সমাধানে আমরা ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রম শুরু করেছি। এরই মধ্যে ১২০০ শ্রমিকের একটা তালিকা করা হয়েছে। বাকি কাজ চলমান। শ্রম-মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবিত ট্রেড-ইউনিয়ন বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে শুটকিপল্লিতে শ্রমিকদের ন্যায্য মুজরি নিশ্চিত করা যাবে। ট্রেড-ইউনিয়নের নিয়ম বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে যার প্রাপ্য মজুরি তিনি তা বুঝে নেবেন। তখন আর বৈষম্য হবে না।’
সচেনত মহল বলছে, নাজিরারটেক শুটকিপল্লিতে বেতন বৈষম্যের গল্প অনেক আগের। সময়ের পরিবতর্নে অনেকে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও কাটেনি তাদের দুর্দশা। শ্রমজীবী এই মানুষদের প্রত্যাশা শ্রম-ঘামের ন্যায্য মূল্য যেন পায় তারা।
সারাবাংলা/পিটিএম