Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনাকাল; স্বাভাবিক পৃথিবী হচ্ছে আরও জটিল


৩১ মে ২০২০ ২০:৩৬

প্রকৃতি ‘রিসেট বাটনে’ চাপ দিয়েছে। এরকম একটা বিষয় কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোতে আলোচিত হচ্ছে। ফেসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এ ধরণের সংবাদকে উৎসাহ দিচ্ছেন অসংখ্য মানুষ।

মূলত কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে দেশে লকডাউনে কোটি মানুষ ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে আমাদের জীবন এবং জীবিকা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তবে যেহেতু মানুষ ঘরের বাইরে যাচ্ছেন না তাতে সামগ্রিকভাবেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে।

গণমাধ্যমে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রায়ই এ ধরণের সংবাদ চোখে পড়ছে, বন্যপ্রাণীরা প্রত্যাবর্তন করছে, বিলুপ্তির পথে থাকা অনেক প্রাণীরও দেখা মিলতে শুরু করেছে আবার। এসব খবর স্বভাবতই এই বন্দি সময়ে আমাদের মন ভালো করে দেওয়ার মতোই।

সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ আস্তে আস্তে স্থলভূমির পাশাপাশি বন, পাহাড়, টিলা দখল করে নিজেদের আবাসস্থল তৈরি করেছে। উপনিবেশ স্থাপন করে নিজেদের তার মালিক হিসেবে দাবি করেছে। বন-জঙ্গল উজাড় করায় ধীরে ধীরে প্রাণীদের আবাসস্থল ও বিচরণ ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে। অনেক উদ্ভিদ-প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে, অনেকে বিলুপ্তির পথে।

পরিবেশ সচেতন অংশ বরাবরই এই বিষয়ে সোচ্চার থাকলেও, তা ঠেকানো যাচ্ছিল না। সমুদ্রসৈকত, পাহাড় কিছুই বাদ যায়নি মানুষের এ দাপট থেকে। একদিকে চলেছে দখলদারিত্ব, অন্যদিকে দূষণ, নিধন। এরকম পরিস্থিতিতে মহামারি করোনার কারণে মানুষ ঘরবন্দি হয়েছে বাধ্য হয়ে। পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ এখন লকডাউনের কবলে।

মানুষের অবাধ বিচরণ থেমে যাওয়ায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে প্রকৃতিতে। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ থাইল্যান্ডের সমুদ্র সৈকতের কথাই বলা যেতে পারে। করোনা পরিস্থিতির কারণে সেখানে এখন মানুষের আনাগোনা নেই। জনশূন্য সেই সৈকতে দেখা মিলছে বিরল প্রজাতির কচ্ছপের। প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া সেই কচ্ছপ প্রজননের জন্য এ সৈকতকে বেছে নিয়েছে। এ ধরণের আরও খবর পাওয়া যাচ্ছে নিয়মিত। যেমন, দক্ষিণ আফ্রিকার ফাঁকা রাস্তাগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে পেঙ্গুইন। ইতালির নগর আর বড় শহরগুলোতে দিনের বেলাও মিলছে নেকড়ে, হরিণ এবং ভাল্লুকের।

লকডাউনে পরিবহন ও বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় স্বাভাবিকভাবেই কার্বন নিঃসরণ এবং দূষণের মাত্রা কমেছে। বিশ্বের বড় শহরগুলো থেকে এখন দৃষ্টিসীমায় ধরা দিচ্ছে দূরের পাহাড়, আকাশের সীমানা এবং রাতের আকাশে তারকারাজি। দূষণ আর ধোঁয়ার কারণে যেগুলো চোখের আড়াল হয়ে গিয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে ভারতের শিলিগুড়ি শহরের কথা বলা যেতে পারে। সেখানকার বাসিন্দারা তাদের শহর থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরত্বে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশৃঙ্গ দেখতে পাচ্ছেন। ২৮ হাজার ১৬৯ ফুট উচ্চতার পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতসৃঙ্গ ঘরে বসে অবলোকন করতে পেরে দারুণ আপ্লুত তারা। দার্জিলিংয়ের নাইটিঙ্গেল পার্ক থেকে এক বাসিন্দা সে দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করে টুইট করে পুরো কৃতিত্ব লকডাউনকেই দিয়েছেন। একইভাবে নেপালের কাঠমান্ডু থেকে প্রায় দুইশ কিলোমিটার দূরের মাউন্ট এভারেস্ট দেখা যাচ্ছে বলেও গণমাধ্যমে খবর এসেছে।

এসব বিষয় আমাদের মধ্যে এই চিন্তাকে তীব্র করে তুলছে যে, প্রকৃতি এভাবে নিজেকে নিজে সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব নিয়েছে- যে চিত্র প্রজন্ম ধরেও দেখা যায় না। কিন্তু সত্যিকার চিত্র হচ্ছে, কোভিড-১৯ আমাদের স্বাভাবিক পৃথিবীকে আরও বেশি জটিল করে তুলছে।

কিছু ঘটনা কিংবা সংবাদ আমাদের আশাবাদী করে তোলে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এসব সংবাদ পুরোপুরি সঠিক অর্থ বহন নাও করতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে এসব সংবাদ বা উন্নয়ন সত্যিকার হলেও তার প্রভাব স্বল্প মেয়াদি হয়ে থাকে। বরং এতে করে বিশ্বব্যাপি প্রকৃতি ও প্রাণী বৈচিত্রের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বরং এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, প্রকৃতি ও প্রাণী বৈচিত্র্য আগের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি হুমকির মুখে রয়েছে।

ভয়াবহ বিপদ নিজেই রোগ আকারে আবির্ভূত হয়। এখন উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এ ভাইরাসে পাহাড়ি গরিলারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ মানুষের সঙ্গে গরিলার ডিএনএ’র প্রায় ৯৮ শতাংশ সাদৃশ্য রয়েছে। যে কারণে সাধারণ ঠান্ডা থেকে শুরু করে মানুষের শ্বাসকষ্টজনিত রোগগুলো দ্বারা তারাও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষত বনমানুষ শ্রেণীর প্রাণীগুলো, যারা ইতোমধ্যে মানুষের আগ্রাসনে নিজ বাসস্থান হারিয়ে, চোরা শিকারীদের লক্ষ্যে পরিণত হয়ে এবং নানা রোগে ভুগে পৃথিবী থেকে বিপন্ন হওয়ার পথে। আমরা জানি, বিলুপ্তির পথে থাকা এ প্রজাতির মাত্র ৯০০ টির মতো টিকে আছে মধ্য আফ্রিকায়।

বন্যপ্রাণীর জন্য করোনাভাইরাসই একমাত্র ঘাতক নয়। যেসব দেশে বড় পরিসরে বন্যপ্রাণীর আবাস রয়েছে, লকডাউন ব্যবস্থার ফলে সেসব দেশে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। লকডাউনের সীমাবদ্ধতার কারণে দেশগুলোর সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের স্বাভাবিক নিয়মিত কার্যক্রম হ্রাস পেয়েছে, ফলে বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে তারা অপারগ হচ্ছে। এটি উদ্বেগের। কারণ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখতে পাচ্ছি বন্য প্রাণী শিকার বেড়ে গেছে। কলম্বিয়ায় পুমাস, এশিয়ার দেশগুলোতে বিপন্ন প্রাণী এবং আফ্রিকায়ও চোরা শিকারীদের কারণে সর্বোচ্চ ঝুঁকির মুখে পড়েছে বন্যপ্রাণীরা।

চলমান পরিস্থিতিতে পৃথিবীর অন্যান্য অংশের মতো নিরাপদে নেই সামুদ্রিক জীবন এবং গাছপালা। অবৈধভাবে মাছ শিকার বেড়ে গেছে। পরিস্থিতির কথিত সুযোগ নিয়ে এ কাজ করছে মৎস শিকারীরা। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সহানুভূতির সুযোগ নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় অবৈধভাবে মাছ শিকার করছে দুর্বৃত্তরা। এটি পৃথিবী জুড়ে

অবৈধ মাছ শিকারের একটি উদাহরণ মাত্র। লকডাউন পরিস্থিতিতে সাধারণ সময়ের মতো নজরদারি না থাকায় এর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন ডব্লিউডব্লিউএফ। সংস্থাটির আশঙ্কা, এর ফলে অনেক দুস্প্রাপ্য প্রজাতির মাছের মজুদ বিনষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।

একইভাবে দেখা যাচ্ছে, চলমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নিয়মিত অভিযান চালাতে না পারায় অবৈধ অনুপ্রবেশ বেড়েছে। সরকারি তথ্য মতে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ব্রাজিলে চলতি বছরের মার্চ মাসে আমাজনে ৩০ শতাংশ বেশি বন উজাড় করা হয়েছে। একই মাসে আমাজনের কলাম্বিয়া অংশে ভূমিদস্যুরা রেকর্ড পরিমাণ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে।

কোভিড-১৯ এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়েছে প্রকৃতি নির্ভর পর্যটন শিল্পের উপরও। দক্ষিণ আফ্রিকা ও কেনিয়ার মতো দেশে অনেক সম্প্রদায়ের জন্য পর্যটন হচ্ছে রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস। একই সঙ্গে সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত অংশসমূহ যেমন, বনপ্রাণী উদ্যান ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কর্মকান্ড পরিচালনা ব্যয়ের উৎসও এটি। করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে দেশগুলো নিজেদের উদ্যান ও সীমান্তসমূহ বন্ধ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংক্রান্ত বাজেটগুলো ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পর্যটনকে তার আগের অবস্থায় ফিরে আসার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে যখন স্বাস্থ্য ও জীবিকা নিয়ে উদ্বিগ্নতা সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাচ্ছে, তখন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিষয়টি সরকারি তহবিল গঠনের অগ্রভাবে স্থান পাবে- এমনটা আশা করা সমুচিত হবে না।

তার মানে তো এই নয়- আমরা হাল ছেড়ে দেবো। সহজ কথায় বললে, প্রকৃতির সঙ্গে মানব জাতির সম্পর্কের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে আমাদের আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বিশ্ব নেতারা বড় ধরণের উৎসাহব্যঞ্জক এবং পুনরুদ্ধারমূলক পরিকল্পনার বিষয়ে পর্যালোচনা করছেন। জীববৈচিত্র, মহাসাগর, জলবায়ু এবং উন্নয়ন বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সভাগুলো এ বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তা ২০২১ সালের শুরু পর্যন্ত পেছাতে হয়েছে। তবে বিলম্বিত হওয়ার কারণে প্রকৃতি রক্ষায় এই পদক্ষেপ যাতে গতি না হারায় সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে।

জলবায়ু বিষয়ক ২০২০ সালের স্থগিত হয়ে যাওয়া বৈঠকগুলো আগামী বছর অনুষ্ঠিত হবে। সেসব বৈঠকে পরিবর্তিত (রূপান্তরিত) সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার আগে বিশ্ব নেতারা সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের জীববৈচিত্র সম্মেলনে প্রকৃতি বিষয়ে উচ্চাকাক্ষা তুলে ধরবেন এবং এ কাজকে ত্বরান্বিত করবেন;
এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কার্বনমুক্ত এবং প্রকৃতির (জলবায়ু) প্রতি ইতিবাচক সমাজ এবং অর্থনীতির দিকে ধাবিত হতে আমাদের পরিধিকে পুর্নগঠনে বিশ্ব নেতারা প্রতিনিয়ত একটি অদম্য সুযোগের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

আসছে মাসগুলোতে, বিশ্ব অনাকাক্ষিত স্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। যা আমাদের জন্য ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে যদি আমরা এই সংকট থেকে শিক্ষা না নেই এবং টেকসই খাতে বিনিয়োগের চেষ্টার মাধ্যমে আমাদের অর্থনৈতিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা না করি।

সংকটময় এ সময়ে ভীতি কিংবা হতাশা ছড়াতে এসব বলা নয়। লকডাউনের এ অনিশ্চিত এবং একাকিত্বের সময়ে আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার ইতিবাচক সংবাদ। পরেরবার হয়তো আবারও কেউ আপনাকে একটি ভিডিও পাঠাবেন। যেখানে হয়তো আপনি দেখবেন, জেলি ফিশ ভেনিসে সাঁতার কাঁটছে কিংবা পাহাড়ি ছাগল ওয়েলস শহর আক্রমণ করেছে। এসব দেখে প্রকৃতির এই পুনরুত্থান আপনাকে হয়তো আন্দোলিত করবে। কিন্তু বিষয়টি উদ্যাপনের আগে আপনি দ্বিতীয়বার গভীরভাবে ভাবুন। কারণ আপনি হয়তো প্রকৃতি চিত্র সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নন।

(আল জাজিরায় প্রকাশিত মার্কো ল্যামবারটিনি কলাম ‘দ্য করোনাভাইরাস ইজ নট গুড ফর ন্যাচার’ অবলম্বনে)

লেখক: সংবাদকর্মী

ইয়াহইয়া ফজল করোনাকাল করোনাকালের পৃথিবী জলবায়ু জীববৈচিত্র পরিবেশ ও জলবায়ু লকডাউন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর