নিভে গেল আরো এক আলোর প্রদীপ
১৩ জুন ২০২০ ১৬:২২
রক্তচাপ, স্ট্রোক, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও করোনাভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে হেরে গিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে টানা দুই সপ্তাহ জীবন-মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছেন তিনি। ১৩ জুন, শনিবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
এর আগে রক্তচাপজনিত সমস্যা নিয়ে গত ১ জুন হাসপাতালে ভর্তি হন মোহাম্মদ নাসিম। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকায় ওই দিনই তার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। করোনাভাইরাস ‘পজিটিভ’ আসে। চিকিৎসা চলতে থাকে। এরপর ৪ জুন তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও ৫ জুন ভোরে তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে দ্রুত অস্ত্রোপচার করে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়।
অস্ত্রোপচারের পর নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা নাসিমের শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে গেলে ১৩ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। দুই দফায় ৭২ ঘণ্টা করে পর্যবেক্ষণে রাখে মেডিকেল বোর্ড। এর মধ্যেই পরপর তিনবার নমুনা পরীক্ষা করে করোনাভাইরাস ‘নেগেটিভ’ আসে।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তান রেখে গেছেন।
এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। নাসিমের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। বাবা অন্যতম জাতীয় নেতা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। নাসিমের মায়ের নাম মোসাম্মৎ আমিনা খাতুন, যিনি আমেনা মনসুর হিসেবেই পরিচিত।
নাসিমের বাবা এম মনসুর আলী ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে নিহত জাতীয় চার নেতার একজন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এম মনসুর আলী স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন।
গ্রামের আলো বাতাসে বড় হওয়া নাসিম পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)। সেখান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে গত শতকের ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতির জীবন শুরু হয় নাসিমের। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি প্রভাবে তিনি ছাত্রলীগে যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কারাগারে বাবা মনসুর আলীকে হত্যা করা হলে রাজনীতিতে সক্রিয় হন নাসিম। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর মোহাম্মদ নাসিমকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সেইসময় দীর্ঘদিন তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে।
১৯৮১ সালের আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন নাসিম। ওই সম্মেলনে আওয়ামী লীগের যুব সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালের সম্মেলনে দলের প্রচার সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০২ সালের আগ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ একটি ছিল। এরপর থেকে বিভাগভিত্তিক সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০০২ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে তাকে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য পদে রাখা হয়। ২০১২ সালের সম্মেলনে তাকে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। পরপর তিন মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।
মোহাম্মদ নাসিম ভোটের রাজনীতিতে সফল একজন রাজনীতিবিদ। সিরাজগঞ্জ-১ আসন (কাজীপুর ও সদর উপজেলার একাংশ) থেকে ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। তার ডাকে এলাকার লোক সাড়া দেয়। প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেবার সংসদে বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপের দায়িত্ব পান তিনি।
সিরাজগঞ্জ-১ সংসদীয় আসন (কাজীপুর ও সদর উপজেলার একাংশ) থেকে ১৯৯৬, ২০০১, ২০১৪, ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন তিনি।
১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে সরকার গঠন করার পর তাকে (নাসিম) ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের বছর (১৯৯৭) মার্চে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও তাকে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক সাথে দুই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৯ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত। পরে মন্ত্রিসভায় রদবদল হলে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
২০০৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন ১/১১ সরকারের দেওয়া মামলার কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি নাসিম। ওই নির্বাচনে তার ছেলে তানভীর শাকিল জয়কে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ।
২০১২ সালে কাউন্সিলে প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন নাসিম। মামলা ও সাজা উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে নিজের আসন সিরাজগঞ্জ-১ থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী বর্তমান সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন মোহাম্মদ নাসিম।
রাজনীতিতে তাদের পরিবারের ভূমিকা নিয়ে ‘সংসদে তিন প্রজন্ম’ নামের একটি বইয়ের সম্পাদনা করেছেন মোহাম্মদ নাসিম। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, মোহাম্মদ নাসিম এবং তানভীর শাকিল জয়ের ভূমিকা নিয়ে বইটি লিখেছেন তিনি।
রাজধানী ঢাকা এবং নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন নাসিম। রাজনৈতিক জীবনে রাজপথে সবসময়ই সক্রিয় ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। রাজনীতির পাশাপাশি সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন তিনি।
লেখক: সাংবাদিক