করোনাকাল; আদিবাসীদের সেই পুরনো আকাল
১৮ আগস্ট ২০২০ ২৩:১১
আদিবাসীদের ‘স্বার্থে’ কথা বলতে আমাদের অনেকেরই ‘এলার্জি’ আছে। তাই দেশের ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর বিশাল জনসংখ্যা বারবার পিছিয়ে পড়ে, আইনের নানা মারপ্যাঁচে ডাঙ্গায় ওঠা মাছের মতো খাবি খায়। প্রায়শই নতুন নতুন অবরোধে নিজের ভিটেতে, নিজেরাই অস্তিত্ব সঙ্কটে ভোগে। তাই তাদের উন্নয়নে লোক দেখানো নানা মনিটরিং কার্যক্রম কিংবা টাস্কফোর্স গঠন করে জীবনযাত্রার মানের খুব বেশি উন্নয়ন হয় না। এবার করোনাভাইরাস সংক্রমণের দিনগুলোতে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা যেন আরও বেশি সংগ্রামের মুখে পড়েছে। পাহাড় কিংবা সমতল; দুই ক্ষেত্রেই এসব মানুষ প্রতিটি পদে পদে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে বেকারত্ব, স্বাস্থ্যঝুঁকি তথা সুচিকিৎসা না পাওয়া, কৃষিপণ্য বিপণনে বাধা আর খাদ্য সংকট।
গত ৯ আগস্ট ছিল আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। সেই ধারাবাহিকতায়, করোনাকালে বাংলাদেশের আদিবাসীদের জীবন কেমন যাচ্ছে, তা নিয়ে শোরগোল উঠছেই। সত্যিকার অর্থে, এ ধরণের বিশেষ দিন ছাড়া তাদের ‘পক্ষে’ খুব একটা আলোচনা নেই। আমি প্রায়ই বলি, করোনাকালে টানা লকডাউনে সরকার তার জনগণকে বাঁচাতে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা বাস্তবিক অর্থেই প্রশংসনীয়। নগদ অর্থ প্রদান, কম মূল্যে চাল বিক্রি, নানান প্রণোদনা ঋণ; শীর্ষক উদ্যোগগুলো যদি মাঠ পর্যায়ে শতভাগ না হোক অন্তত ৮০ ভাগ বাস্তবায়ন হতো তাহলে অনেক কিছুই বদলে যেতো।
তবে করোনাকালে সমতল আর পাহাড়ের আদিবাসীদের চ্যালেঞ্জ সাধারণ বাঙালির চেয়ে বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একে তো প্রত্যন্ত এলাকা, তার উপর স্বচ্ছতার অভাব; দুইয়ে মিলিয়ে আদিবাসীরা পড়েছেন ফাটা বাঁশের মাঝখানে। তবে পাহাড়িদের চেয়ে সমতলের গারো, সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কয়েক হাজার মানুষের অবস্থা আরও সঙিন। এই জনগোষ্ঠী কৃষি ও দৈনিক পারিশ্রমিকের কাজের সঙ্গে যুক্ত। বলা হচ্ছে, করোনাকালে সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ৭০ ভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে। অথচ জাতীয় বাজেটে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পেলেও, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য কোন মন্ত্রণালয়ও নেই, বরাদ্দও নেই। তাই করোনাকালে পাহাড়িদের যতটুকুও বা খোঁজখবর রাখা হয়, সমতলের জন্য সেটুকুও মেলে না।
সারাদেশে বিভিন্ন খাতে কর্মরত পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল এলাকার হাজার হাজার কর্মীদের বিশাল অংশ চাকরিচ্যুত হয়ে করোনাকালে নিজ গ্রামে ফিরে এসেছে। আদিবাসী শিক্ষার্থী যারা শহরে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন, তারাও লকডাউনে বাড়ি ফিরেছেন। পাহাড়ি আদিবাসী তরুণীদের বড় একটি অংশ ঢাকা ও চট্টগ্রামের পার্লারে কাজ করেন। করোনাকালে তারা গণহারে চাকরি হারিয়েছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুতের সংকট প্রবল, তার চাইতেও বড় সংকট ফোনের নেটওয়ার্ক। তাই সারা দেশে যখন শিক্ষার্থীরা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যস্ত, তখন পাহাড়ি আদিবাসী শিক্ষার্থীরা পিছিয়েই যাচ্ছে।
করোনাকালে আদিবাসী বড় কৃষকরা খুব একটা ঝক্কি না পোহালেও, সংকট ছিল ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের। একাধিক আদিবাসী প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, লকডাউনের আগে ও লকডাউনের শুরুতেই বেশিরভাগ ধান চাষি তাদের আমন ধান বিক্রি করতে পেরেছেন এবং মোটামুটি দাম পেয়েছেন। কিন্তু যারা ফল ও সবজি উৎপাদনকারী কৃষক, তারা পড়েছেন বিপাকে। বিখ্যাত পাহাড়ি কলার প্রতি ছড়া যেখানে সাধারণ সময়ে বিক্রি হতো ১০০০-১৫০০ টাকায়, সেখানে লকডাউনে তা নেমে এসেছে গড়ে ৪০০-৫০০ টাকা ছড়া। বরবটির প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৪০-৫০ টাকায়, লকডাউনে কৃষকরা কেজি প্রতি ১০ টাকাতেও ছেড়ে দিয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে। বাজার না বসায়, কৃষিপণ্য পরিবহন করা যায়নি, কৃষক গুনেছেন ক্ষতির মাশুল। তাছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড় জুম চাষিদের মধ্যে খাদ্যাভাব রয়েছে, যার তীব্রতা বৃদ্ধি পায় বর্ষায়। করোনার মাঝে এরই মধ্যে বর্ষাকাল এসেছে, জুম চষিরাও বিপাকে পড়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এসব প্রতিরোধে দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি।
ত্রাণ বিতরণে এসব অঞ্চলে দারুণ অসঙ্গতি খেয়াল করা গেছে। কম প্রত্যন্ত এলাকায় অনেক পরিবার ৩-৪ বার সরকারি খাদ্য সহায়তা পেলেও, বেশি প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে অনেক পরিবার একবারও পাননি। শুধু তাই নয়, যারা খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন তাদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন প্রাপ্ত খাদ্য সহায়তার মধ্যে চাল-ডাল-তেল ছাড়া আলু, সবজির বেশিরভাগই পচা পাওয়া গেছে।
এর মধ্যেই গত ২১ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জেলায় কোভিড-১৯ সংকটে সরকার কর্তৃক পরিচালিত ত্রাণ কার্যক্রম সম্পর্কে স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলো একটি জরিপ চালায় ও সেই ধারাবাহিকতায় যৌথ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে।
সেই বিবৃতিতে বলা হয়, করোনা মোকাবিলায় সরকারের নানান কার্যক্রম প্রশংসনীয় হলেও মাঠ পর্যায়ে সৃষ্ট কতিপয় সমস্যার কারণে এই ৩ জেলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের খাদ্য নিরাপত্তা চাহিদা পূরণ হয়নি। পার্বত্য অঞ্চলের প্রত্যন্ত ও আধা-প্রত্যন্ত এলাকার একটি ক্ষুদ্র অংশের কিছু কিছু পরিবার ত্রাণের চাল একেবারেই পায়নি। আবার এ সব এলাকার বৃহত্তর অংশে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে পরিবার পিছু ১০ কেজি চাল দেওয়া হলেও তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছিল মাত্র একবারই। ৩ জেলা ও উপজেলা সদরের বাইরে খুব কমই ১৫-২০ কেজি চাল বিতরণ হতে দেখা গেছে। পরিবার পিছু দৈনিক ২ কেজি চালের চাহিদার বিপরীতে প্রদত্ত বরাদ্দ নিতান্তই অপ্রতুল ছিল। তালিকাভুক্ত পরিবারের সংখ্যা ঠিক রাখা হলেও ত্রাণের পরিমাণ ১০ কেজি থেকে কমে গিয়ে হয় ৫ কেজিরও নিচে। বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের ৫টি গ্রামে পরিবার পিছু চাল পেয়েছে ২ কেজিরও কম।
পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জাতীয় পরিচয় পত্র অথবা মোবাইল ফোন ও আ্যাকাউন্ট না থাকা বা স্ব স্ব পরিচয়পত্রে লেখা নামে মোবাইল কিনতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ২৫০০ টাকার প্যাকেজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে তালিকায় অন্যায়ভাবে বাদ পড়ে যাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
এমন অবস্থায় ত্রাণের যথাযথ বিতরণ নিশ্চিতকরণ, এ ধরণের সরকারি কার্যক্রমে আদিবাসী প্রতিনিধিদের মাধ্যমে টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরি। জরুরি আদিবাসী কল্যাণের অধীনে এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের জন্য নগদ সহায়তা, বিনা সুদে ঋণ প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া। সরকারের সব ধরণের উদ্যোগের সঙ্গে আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের সম্পৃক্ত করা। শুধু ত্রাণ নয়, বিদ্যুৎ সুবিধা, সুপেয় পানির পর্যাপ্ততা, উচ্চমানের শিক্ষা, অনলাইন শিক্ষার ব্যবস্থা করা, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং অন্যান্য সুবিধাসমূহের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন অর্জনের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যারা বেকার, তাদের জন্য সরকারের পাশাপাশি বিজিএমইএ, বিজিপিএমএ, এফবিসিসি কর্তৃক স্বল্প মেয়াদে ত্রাণ প্রদান ছাড়াও তাদের কর্মসংস্থানসহ বিশেষ ভাতা প্রদানের উদ্দেশ্যে জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
লেখক: যোগাযোগ কর্মকর্তা
খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি), বাংলাদেশ