করোনা মোকাবিলায় পর্তুগাল সফল হলো যেভাবে
২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৪:১৯
বিশ্ব ইতিহাসে ২০২০ সাল একটি বিপর্যয়ের বছর হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর ফলে সারা পৃথিবী স্থবির হয়ে পড়েছে। চীনের উহান প্রদেশে প্রথম অস্তিত্ব জানান দেওয়া করোনাভাইরাস পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ৩১ জানুয়ারি ইতালিতে করোনা সংক্রমণের মাধ্যমে পশ্চিম ইউরোপ ক্রমেই করোনা সংক্রমণের নাভিকেন্দ্রে পরিণত হয়। এই অঞ্চলেরই একটি দেশ পর্তুগাল। এখানে ২ মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত হলেও মাত্র দু’মাসের মধ্যে দেশটি করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। দেশটিতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ সম্পূর্ণ নির্মূলের কাজ করে যাচ্ছে।
দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের একটি স্বাধীন দেশ পর্তুগাল। আয়তন ৯২ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা সোয়া কোটির কিছু বেশি। পর্তুগালের সীমান্তবর্তী একমাত্র দেশ স্পেন। কিন্তু দেশটি পর্তুগালের তুলনায় অনেক বড় এবং উত্তর ও পূর্ব দিকে পর্তুগালকে বেষ্টন করে আছে। স্পেনের উত্তর-পূর্বে ফ্রান্স এবং ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বে জার্মানি এবং দক্ষিণ-পূর্বে ইতালি। এ অঞ্চলে পর্তুগাল একমাত্র দেশ যেখানে করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যু দুটোই সবচেয়ে কম।
পর্তুগালের পশ্চিম ও দক্ষিণে সুবিস্তৃত আটলান্টিক মহাসাগর। আইবেরীয় উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত পর্তুগালের দক্ষিণ-পূর্বে স্পেন সীমান্ত ঘেঁষে জিব্রাল্টার প্রণালীর ওপাশেই আফ্রিকা মহাদেশের দেশ মরক্কো। আটলান্টিকের তীর ঘেঁষে পর্তুগালের বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত। এছাড়া স্বায়ত্তশাসিত আসোরেস ও মাদেইরা দুটো দ্বীপপুঞ্জ পর্তুগালের নিয়ন্ত্রণাধীন।
১২ শতকের মাঝামাঝি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে পর্তুগাল বিশ্বে স্থান করে নেয়। ১৫ শতকের দিকে এটি পরিণত হয় ইউরোপের প্রধানতম সমুদ্রাভিযান কেন্দ্রে। ভাস্কো দা গামা প্রথম উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারতে আগমন করেন। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে পর্তুগিজরাই সর্বপ্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে সমুদ্রবাণিজ্য শুরু করে। অতীতে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় পর্তুগালের উপনিবেশ থাকলেও বর্তমানে তাদের কোন উপনিবেশ নেই। তাদের সর্বশেষ উপনিবেশ ম্যাকাওকে পর্তুগাল ১৯৯৯ সালে চীনের কাছে হস্তান্তর করে। তবে দেশের বাইরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের ভাষা পর্তুগিজ।
এককালে জলদস্যু হিসেবে কুখ্যাত হলেও বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শান্তিপ্রিয় দেশ পর্তুগাল। ইউরোপে অভিবাসীদের জন্য পর্তুগাল এখনো একটি উন্মুক্ত দ্বার। ইউরোপের একটি দরিদ্র দেশ পর্তুগালের মাথাপিছু আয় ২৩,৭৩১ মার্কিন ডলার। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য মতে ২০১৯ সালে দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২.২%। গত এক দশকে পর্তুগালের স্বাস্থ্যখাতে কিছুটা ব্যয় সংকোচন লক্ষ্য করা গেছে। তবুও ২০২০ সালের করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে পর্তুগালের সাফল্য নজরকাড়া।
পর্তুগালে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২ মার্চ, ২০২০ তারিখে। ইতালি ফেরত ৬০ বছর বয়সী একজন ডাক্তার ও স্পেনে কর্মরত ৩৩ বছর বয়সী একজন যুবকের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্তের মধ্য দিয়ে পর্তুগাল করোনা ভাইরাস আক্রান্ত দেশের তালিকাভুক্ত হয় এদিন। ১৬ মার্চ ২০২০ তারিখে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে প্রথম একজন করোনায় মৃত্যুবরণ করেন।
১ পর্যন্ত পর্তুগালে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের মোট সংখ্যা ৫৮,২৪৩। মোট মৃত্যু হয় ১,৮২৪ জনের এবং মোট সুস্থ হয়েছেন ৪২,১০৪জন। পর্তুগালে কোভিড-১৯ সংক্রমিত ও মৃতদের মধ্যে নারীদের হার অধিক। করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে। সেখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬,২১২,৭০৮, মৃত ১,৮৭,৭৯৩।
সারা বিশ্বে মৃতের সংখ্যা বিবেচনায় করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রথম ১০টি দেশ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১,৮৭,৭৯৩), ব্রাজিল (১২১,৫১৫), মেক্সিকো (৬৪,৪১৪), ভারত, (৬৫,৪৬৯) যুক্তরাজ্য (৪১,৫০১), ইতালি (৩৫,৪৮৩), ফ্রান্স (৩০,৬৩৫), স্পেন (২৯,০৯৪), পেরু (২৮,৯৪৪) এবং ইরান (২১,৬৭২)। রাশিয়ায় মৃতের সংখ্যা ১৭,২৭২(১২তম স্থান), জার্মানি ও বেলজিয়ামে প্রায় ১০ হাজার করে। কিন্তু পর্তুগালে মাত্র ১৮২৪ জন (৪৮তম স্থান) মারা গেছে। স্পেন হলো পর্তুগালের নিকটতম প্রতিবেশী। কাজেই এখানে করোনা ছড়িয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
পর্তুগাল উল্লেখযোগ্যভাবে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পশ্চিম ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মধ্যে পর্তুগালের করোনা সংক্রমণ এবং মৃতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে পর্তুগাল সরকার শুরুতেই কিছু পদক্ষেপ নেয়। পর্তুগিজ পত্রপত্রিকার বরাতে জানা যায়, মার্চের শুরুতে প্রথম রোগী শনাক্তের পর ১২ মার্চ সরকার এখানে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য সতর্কতা গ্রহণ করার ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে ১৮ মার্চ এখানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে এই সময় জনসমাগম বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানপাট সন্ধ্যা ৮টার মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। ক্যাফেটেরিয়া ও বারগুলো বন্ধ করে দেয়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি ঘোষিত হয়। সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালতে সপ্তাহের ৫ কর্ম দিবসকে ২ টি শিফটে ভাগ করা হয়। পাবলিক যানবাহনগুলোতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে বসার ব্যবস্থা করা হয় এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কঠোর তদারকির মধ্যে রাখে। পাশাপাশি সিটি লকডাউন ঘোষণা করে স্থানীয় সরকার। এতে এক শহর থেকে অন্য শহরে বা শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
পর্তুগালের অভিবাসীরা সরকারি নির্দেশনার প্রতি সম্মান দেখায়। তারা সরকার কর্তৃক ঘোষিত দিকনির্দেশনা মেনে কঠোরভাবে মাস্ক-গ্লাভস ব্যবহার, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা, খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা বজায় রাখা ইত্যাদি শুরু করলে কিছুদিনের মধ্যে দেশটিতে করোনা সংক্রমণের হার কমতে থাকে। প্রায় ২ মাস চলার পর পর্তুগালে করোনা রোগী সংক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেলে মে মাসের ১৮ তারিখে পর্তুগাল সরকার নার্সারি স্কুল, ক্যাফেটেরিয়া, রেস্তোরা, জাদুঘরসহ টুরিস্ট স্পটগুলোকে শর্তসাপেক্ষে আবার খুলে দেওয়ার অনুমতি দেয়। বর্তমানে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে দোকানপাট স্বাভাবিক সময়ের মত খুলে রাখার অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে লিসবনের বাইরে যেখানে করোনা আক্রান্তের হার কিছুটা বেশি সেসব যায়গায় এখনো বিশেষ স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি আছে।
ইউরোপের দুর্বল অর্থনীতির দেশ হলেও করোনাকালে পর্তুগাল তার নাগরিক, অভিবাসী ও অভিবাসনপ্রার্থীদের প্রতি বিশেষ নজর রেখেছে। করোনার সময়ে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পর্তুগালের সাফল্য ইউরোপের অনেক ধনী দেশকে তাঁক লাগিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে পর্তুগালকে একটি নতুন মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে ইউরোপে।
পর্তুগাল সকল নাগরিক ও বৈধ অভিবাসীর একটি জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা নম্বর প্রদান করে। এই নম্বরটির সাথে ট্যাক্স নম্বর (ফিনান্স নম্বর) এবং সামাজিক সুরক্ষা নম্বর (সোশ্যাল নম্বর) এর সংযোগ থাকে। পর্তুগালের অধিবাসীদের এই জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা নম্বর (এসএনএস) দিয়ে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। এতে প্রত্যেক রোগীর আজীবনের অসুখের তালিকা ও চিকিৎসার বিবরণ থাকে। ফলে কখনো স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক কোন রোগীর জীবনের যে কোন পর্যায়ের অসুখ ও তার চিকিৎসার বিবরণ খুঁজে পান। এতে যেমন চিকিৎসা প্রদান করতে সুবিধা হয় তেমনি চিকিৎসা বীমা গ্রহণের জন্য রোগীও লাভবান হন।
করোনাকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পর্তুগাল সরকার দেশটির বৈধ ও অবৈধ সকল নাগরিককে এই এসএনএস নম্বর গ্রহণের সুযোগ দেয়। প্রত্যেকের আবাস অনুযায়ী নির্দিষ্ট ই-মেইল ঠিকানায় নির্দিষ্ট তথ্য প্রদান করে ঘরে বসেই এসএনএস নম্বর পাওয়ার সুযোগ দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। এরপর সেই নম্বরটি নিয়ে নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে (সান্তা সাউদ) গিয়ে দেখালে পূর্ণাঙ্গ এসএনএস নম্বর দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এই এসএনএস নম্বর থাকলে পর্তুগালে ফ্রি জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায়। একই সাথে সরকার ঔষধ ক্রয়ের ক্ষেত্রেও রোগীর আর্থিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে ভর্তুকি দেয়।
কোন ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ আক্রান্তের লক্ষণ দেখা দিলে পর্তুগাল তথা ইউরোপের জরুরি সেবা নম্বর ১১২-এ কল দিলে সরকারিভাবে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়িতে এসে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। চিকিৎসকগণ রোগীকে ব্যবস্থাপত্র প্রদান, অন্যান্য দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। রোগীর সংস্পর্শে আসা অন্যান্যদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেনটাইনের ব্যবস্থা করা হয়। একান্ত জরুরি প্রয়োজন না হলে করোনাকালে হাসপাতালে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ। তবুও বিশেষ প্রয়োজনে দেশটিতে জরুরি স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন কার্পণ্য করছেন না চিকিৎসকরা।
শুধুমাত্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দিকেই নজর দেয়নি পর্তুগাল। বরং করোনাকালে কর্ম হারানো লাখ মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথাও ভেবেছে দেশটি। লকডাউনের শুরুতেই পর্তুগালের শহরের অভ্যন্তরে চলমান গণপরিবহনগুলোতে ফ্রি যাতায়াতের ব্যবস্থা করে সরকার। বাস, ট্রাম, ট্রেন, মেট্রো সবকিছুর ক্ষেত্রেই এই নির্দেশনা কার্যকর হয়। পাশাপাশি কর্ম হারানো মানুষদের ৬ মাসের অগ্রিম নিষ্কর্ম বেতন প্রদান নিশ্চিত করে সরকার। এই সময় নাগরিকদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় কিছু ক্ষেত্রে আয়কর মকুফ করা হয়।
কোভিড-১৯ এর কারণে পর্তুগালের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর ইউরোপের দরিদ্র এই দেশটির জিডিপি গ্রোথ ২.৯ শতাংশ কমে যাবে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, করোনার ধাক্কা মোকাবিলা করতে হয়ত মারাত্মক মন্দায় পড়বে দেশটি। বর্তমানে তেমন কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির দেশটির পর্যটন খাত ইতিমধ্যে ব্যাপক বিপর্যয়ে পড়েছে। শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষিতে পর্তুগালের উৎপাদন বিশেষ না কমলেও আবাসন খাতে ব্যাপক ধ্বস নেমেছে। কর্মহীন মানুষের আনাগোনা বেড়েই চলেছে দেশটিতে।
করোনাভাইরাসের কারণে পর্তুগালের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দেশটির স্বাস্থ্যখাতের শক্তিমত্তা বের হয়ে এসেছে এই বিপর্যয়ের সময়ে। প্রতিবেশী দেশ স্পেন বা উত্তরের ফ্রান্স, ইতালি ইত্যাদি যেসব দেশ করোনায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, সেখানে পর্তুগালে করোনা মোকাবেলায় সাফল্য চোখ ধাঁধানো। করোনার মতো একটি প্রাণঘাতী রোগে পর্তুগালে যে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেনি এর চেয়ে ইতিবাচক আর কিছু হতে পারে না। কেননা মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই এ পৃথিবীতে।
লেখক: পর্তুগাল প্রবাসী