Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ একটি সামাজিক ব্যাধি

রশীদ এনাম
২৫ জুন ২০২৩ ১৩:১০

ঈদ-উল আজহা দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে। শহর-নগর ছেড়ে সবাই ছুটিতে ঈদ উদযাপনের জন্য গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন। কু ঝিক ঝিক কু ঝিকঝিক কু ঝিকঝিক করে ট্রেনে করে বাড়ি যাচ্ছেন পরিবার নিয়ে মাঝ পথে চলন্তট্রেনে পাথড়ছুড়ে মারলো গিয়ে পড়লো আপনার ফুলের মতো শিশুর চোখে বা মাথায় কেমন লাগে বলুন ? না এসবের কোন মানে হয় না।

চলতি বছরে ২৩ সালে বেশ কয়েকবার চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। গত ৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামগামি সুবর্ণ এক্সপ্রেসে কুমিল্লার লালমাই এলাকায় পাথড় নিক্ষেপের ঘটনায় দুজন আহত হন। গত ১৯ মার্চ কিশোগঞ্জের মানিকখালি ও সরাচর স্টেশন এলাকায় ট্রেন থামিয়ে এগারসিন্দুর এক্সপ্রেসে যাত্রী না নেয়ায় বৃষ্টির মতো পাথর নিক্ষেপ করলে প্রায় ৩০ জন যাত্রী আহত হন। ১৮ এপ্রিল জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের ট্রেনের গার্ড পরিচালাক আব্দুল লতিফ চলন্ত ট্রেনের ছুড়া পাথরে আহত হন। গত ২৫ মার্চ টাঙ্গাইল থেকে ঢাকাগামী পদ্মা এক্সপ্রেসে ছুড়া পাথরে ট্রেনের চালক তৌহিদুজ্জামান সহ পাঁচজন গুরুতর আহতন হন। নাটোর থেকে পদ্মা এক্সপ্রেসে করে ঢাকা আসার পথে চাকুরী প্রত্যাশী রবিউল ইসলাম মারাত্বকভাবে আহত হন। গত ১৬ জুন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরছিলেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ফারুক আহমেদ রাজু বিবাড়িয়া এলাকায় চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারলে সে গলায় মারাত্বকভাবে আহত হন। আহা মানুষের নিরাপত্তা সাড়ে তিন হাত মাটিতে কবরস্ত হয়েগেছে। কোথায় নিরাপদ আমরা। ধারবাহিকভাবে ঘটছে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ।

বিজ্ঞাপন

গত ছয় বছরের ব্যবধানে প্রায় দুই হাজারের ও বেশি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। ট্রেনের জানালার কাঁচ ভেঙ্গেছে বগির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছুদিন আগে সুবর্ন এক্সপ্রেসে বাড়ি যাচ্ছিলাম কুমিল্লা ফেনির মাঝখানে যায়গাটা নাম মনে নেই। জানালার ফটক দিয়ে বিশাল সাইজের পাথর এসে পড়ে ট্রেনের যাত্রির মাথায়। মাথা ফেটে গুরুতর আহত হন। খুব সম্ভবত ২০১৩ সালে ঈদের ছুটি শেষে চট্টগ্রাম থেকে ফিরছিলাম। ট্রেনের অন্য বগিতে ছিল, প্রকৌশলী প্রীতি দাশ(২৪) বিয়ে হয়েছে মাত্র ১৭ মাস। ভাটিয়ারী এলাকায় চলন্ত ট্রেনে ছোড়ে মারা পাথরের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়। ২০১৮ সালে খুলনা বেনাপুল রোডে কমিনিউটের ট্রেনে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরের আঘাতে চলন্ত ট্রেনের পরিদর্শক বায়েজিদ মারাত্বকভাবে আঘাত পান। ৪১দিন পর মৃত্যুর কাছে হার মানেন। গত ২০১৯ সালে জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বগিতে চলন্ত ট্রেনে বাহির থেকে পাথর ছোড়ে মেরে পালিয়ে যায়। দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান তিনি। সৈয়দপুরে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরে এক ছোট শিশুর চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ২০১৯ সালে সিরাজগঞ্জ ও এবং পাবনার ভেড়ামারা এলাকায় রকেট মেইল এক্সপ্রেসে ছুড়া পাথরে এক্সপ্রেসে জিসান(৪) ও জুথিঁ(১৪) মারাত্বকভাবে আহত হয়েছিল। চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা বার বার হচ্ছে কিন্তু প্রতিকার নেই। কর্তৃপক্ষ দেখে দেখে তন্দ্রাবিলাস করছে। চলতি বছরে (২০২১) সালে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে ১১০ বারেরও বেশি। এ ঘটনায় প্রায় ২৯ জন আহত হয়। এই কাজটি হয়ত অবুজ শিশুদের জন্য ক্ষনিক আনন্দের কিন্তু অন্য একটি পরিবারের জন্য কান্নার এবং বিষাদেরও বটে। অনেকে খেলার চলে কে কয়টা জানালার ভিতর প্রবেশ করাতে পারে এই প্রতিযোগিতায় নেমে, ট্রেনের জানালায় পাথর ছুড়ে মারে। না এটা হতে পারে না।

বিজ্ঞাপন

একবার ভাবুন, যাত্রা পথে যদি এসব পরিস্থিতিতে পড়তে হয় কেমন লাগে? চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ে মারার ঘটনাটি দেশে নতুন নয়। ১৮৫৩ সালের পর থেকে বাংলাদেশে ট্রেন যাত্র শুরু করে। নিরাপদ যাত্রা একমাত্র মাধ্যম বাংলাদেশ রেলওয়ে। ট্রেন যাত্রা মানে আরামদায়ক ভ্রমণ। সড়ক পথে বিনিয়োগ না করে রেলওয়েখাতে আরো বেশি বিনিয়োগ করে ট্রেন যাত্রা নিরাপদ করা জরুরী। আমাদের প¦ার্শবর্তী দেশ ভারতে প্রতিদিন প্রায় ১৪ হাজারেরও বেশি ট্রেন নিরাপদে প্রতিদিন বিভিন্ন প্রদেশে আসা যাওয়া করে। এক প্রদেশ থেকে সকালে ট্রেনে উঠে অফিস শেষ করে ট্রেনে নিরাপদে বাড়ি ফিরে।

রাজধানী এক্সেপ্রেসে করে কলকতা থেকে দিল্লী গিয়েছিলাম চমৎকার আসনব্যবস্থা, ট্রেনের আভ্যন্তরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ট্রেন ব্যবস্থাপনা এত সুন্দর যে কেউ দেখে মুগ্ধ হবে। আমাদের হাতেগুনা কয়েকটি মাত্র আন্তনগর ট্রেন। তাও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত। নিরাপত্তা বা নিরাপদ শব্দ দুটো আমাদের অভিধানে আছে বাস্তবে নেই। চট্টগ্রামে সুবর্ন এক্সপ্রেস, সোনার বাংলায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসাযাওয়া করে দেশের প্রথম শ্রেনীর মানুষ। নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা যদি হয় গোধের উপর বিষফোঁড়া তাহলে কেমন লাগে? ইদানিং সামাজিকব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে চলন্ত ট্রেনে পাথর পাথর নিক্ষেপ করা। ছোড়া পাথরের আঘাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না সাধারন জনগন।

বাংলদেশ রেলওয়ে পুলিশের কর্মকর্তা রেলওয়ে নিরাত্তা কর্মীরাও রেহাই পাইনি পাথর থেকে। শিশু থেকে শুরু করে যুবক যুবতি বৃদ্ধা কেউ রেহাই পাচ্ছে না। পাথর ছোড়ে মারার হট স্পট কিংবা পাথর নিক্ষেপের জায়গাগুলো এখনই চিহ্নিত করা জরুরী।

দেশের পনেরটির বেশি জায়গা আছে যেখানে প্রায় সময় চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায় কিছু বিপদগামী শিশু ও কিশোর গ্যাং,দুর্বৃত্ত, বখাটে, সুবিধাবঞ্চিত শিশু। ওদের কাছে হয়ত বিষয়টা ক্ষনিক আনন্দের। কিন্তু তারা জানে না চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ মানে একটি পরিবারের সারাজীবনের আক্ষেপ। ছুড়ে মারা পাথর সারা জীবনের জন্য কান্নার।

চট্টগ্রামের ২নং গেট রেলক্রসিং, পাহাড়তলী, সিতাকুন্ড, ভাটিয়ারী, বাড়বকুন্ডু, কুমিল্লা, লালমাই, বিবাড়িয়া, ফেনীর ফাজিলপুর, কালদহ, নরসিংদী, জিনারদী, ঘোড়াশাল, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নীলফামারীর সৈয়দপুর, আক্কেলপুর, উল্লাপাড়া, যমুনা সেতু, খুলনার ফুলতলা,বেনাপুল ইত্যাদি এলাকায় বিভিন্ন সময়ে চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে অহরহ।

গত রবিবার ৯জানুয়ারি, ২০২২ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র কৌশিকপাল শাটল ট্রেনে করে সন্ধ্যায় শহরের ফিরছিল ২নং গেট রেলক্রসিং এলাকায় চলন্ত ট্রেনে টোকাইদের ছোরা পাথরের আঘাতে মারাত্বকভাবে আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি হন। গত এপ্রিল-র ২০২২ প্রথম সপ্তাহে শাটল ট্রেনে পুলিশের অভিযান চলাকালীন সময়েও বেশকয়েকটি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে।

এই ব্যাধি থেকে জাতী পরিত্রাণ চাই এ জন্য চাই জনসচেতনত জরুরী। সর্বাঙ্গে ব্যাথা ঔষধ দিব কোথা ভেবে বসে থাকলে চলবে না। পাথর ছোড়ার এলাকাগুলো চিহ্নিত করে ঐ এলাকায় সচেতনতা মুলক বিভিন্ন ক্যাম্পিং, মাইকিং, বস্তি এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে মানববন্ধন, কাউন্সিলিং, স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে সচেতনতামুলক কার্যক্রম করা যেতে পারে। চিহ্নিত এলাকাগুলো সিসিটিভি ক্যামেড়ার আওতায় আনা যেতে পারে। তার আগে রেল লাইনের পাশে বস্তিগুলো উচ্ছেদ করা জরুরী। অনেক রাগববোয়ালরা রেলওয়ের জমি গ্রাস করে নিয়েছে। সরকারী জমিগুলো উদ্ধারের নামবালাই নেই। রেল লাইনের আশে পাশে গড়ে উঠা ভাসমান বস্তিগুলো ক্রাইমজোন হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন এলাকায় খুন ছিনতাই, অপরাধমুলক কর্মকান্ড, গাঁজা, মাদক ও ইয়াবা, আইস ব্যবসা এসব বস্তি এলাকায় থেকে হয়ে থাকে। কিন্তু দেখা যায় এসমস্ত বস্তিগুলো কোন সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধি বিভিন্ন পাতি-নেতারা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এসব অপরাধমুলক কর্মকান্ডের টাকার একটা সিংহ ভাগ নেতাদের পকেটেও যায়। পুলিশ প্রশানস বিশেষ করে রেলওয়ে পুলিশ এবং রেলওয়ে নিরাপত্তা কর্মীদের আরও বিচক্ষণ ও সজাগ হওয়া জরুরী।

সাধারন জনগনের নিরাপদ ট্রেন যাত্রা নিরাপদ করার লক্ষ্যে পাথর নিক্ষেপ করা জায়গাগুলো চিহিৃত করে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা যেতে পারে। ট্রেনে পাথর ছোড়ে মারার ঘটনাগুলো শতবারেরও বেশি ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্টিং মিডিয়া ঝর তুলেছে কিন্তু আজও সুরাহা হয়নি। পাথর নিক্ষেপ করা ব্যাধিটি দয়া করে বন্ধ করুন। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ একটি দ-নীয় অপরাধ। রেলওয়ে আইনে ১২৭ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদ-সহ ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ৩০২ ধারা অনুযায়ী পাথর নিক্ষেপে কারও মৃত্যু হলে মৃত্যুদ-ের বিধান আছে। আসুন আমরা সচেতন হই চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ কারীদের ধরিয়ে দিন। আমরা একটি সুন্দর নিরাপদ ট্রেনযাত্রা চাই। মাননীয় রেল মন্ত্রীমহোদয় এবং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি । চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ বন্ধ করতে একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিন।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ একটি সামাজিকব্যাধি মুক্তমত রশীদ এনাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর