Sunday 13 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ক্যাপিটল হিলে সহিংসতা এবং মিডিয়ার ‘উত্তেজনা’


৮ জানুয়ারি ২০২১ ২৩:০১ | আপডেট: ৯ জানুয়ারি ২০২১ ১২:৩৪

যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে ডোনাল্ড ট্রাম্পপন্থি জমায়েতের আক্রমণ, হট্টগোল, হামলা-পাল্টা হামলা, গুলি, মৃত্যু আর জানাশোনার সাইবার বলয়ের ভেতরে তার তাৎক্ষণিক সম্প্রচার মিডিয়াকে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচায়। বিশ্বব্যাপী মহামারির কথা বলতে বলতে তারা একে তো ক্লান্ত প্রাণ এক, তার ওপর ‘নাচুনে বুড়ি’ ডোনাল্ড ট্রাম্প সহিসংতার ‘ঢোলের বাড়ি’ শুনে প্রথমে যে প্রতিক্রিয়া দেখালেন, তা মিডিয়ার জন্য ছিল দীর্ঘ আরাধনার ফল।

তাই, কৌতূহল থেকেই হোক আর পেশার ভেতর নিজেকে মানানসই করে তুলতেই হোক, বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) দিনব্যাপী দেখলাম স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক নিউজ আউলেটগুলো ইনিয়ে-বিনিয়ে ক্যাপিটল হিল ‘ক্রাইসিসে’র কথা বলতে থাকা আর বাংলা ভাষার প্রচারমাধ্যমগুলোর বক্তব্য। এত ‘বড়’ গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকা, আর সেইখানে কি না এই ঘটনা…

বিজ্ঞাপন

ঘটনা কী?

৬ জানুয়ারি ২০২০। সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী জো বাইডেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়মাল্য পরিয়ে দেওয়ার কথা ট্রাম্পের সেকেন্ড ইন কমান্ড মাইক পেন্সের। মানে, আগের সেই কথাই থাকলো— বাইডেন বিজয়ী।

কিন্তু, এতদিন মিডিয়া যে ট্রাম্পকে লাই দিয়ে মাথায় তুললো, তাকে নিয়ে এখন মিডিয়া কোথায় যাবে?

ট্রাম্পের কংগ্রেস ফেয়ারওয়েলের নিউ মিডিয়া ট্রায়ালে সবাই দেখল— ট্রাম্পপন্থি অন্তত হাজার মানুষ সংসদীয় গণতন্ত্রের ‘তীর্থস্থান’ পার্লামেন্টে হামলে পড়ছে। আর হামলাকারীদের ভয়ে আইনপ্রণেতারা থরথর করে কাঁপছেন, ভয়ে গোপন সুড়ঙ্গ পথে পালিয়ে যাচ্ছেন। আর হামলাকারীরা পার্লামেন্টে ঢুকে স্পিকারসহ আইনপ্রণেতাদের আসনে বসছেন, ভাঙচুর আর লুটপাটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মিডিয়া তাই সচিত্র প্রতিবেদন আর লাইভ ব্রডকাস্টের মোড়কে রোমহর্ষক এক ‘ব্যর্থ বিপ্লবে’র স্টোরি নিয়ে হাজির। মূল কাহিনির মধ্যে ট্রাম্প কোথাও নেই। কিন্তু ট্রাম্প ‘আছেন’ হামলাকারীদের চেতনায়, আদর্শে। তাই, তার নাম ঘুরেফিরেই আসলো, আসতেই থাকল। বাড়তে থাকল তার সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও)।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বৈশ্বিক রাজনীতির রাঘব বোয়ালরা ওই ঘটনার নিন্দা জানালেন। ওয়াশিংটনে কারফিউ দেওয়া হলো। জারি হলো ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের পুরাতন সারথি ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সও প্রেসিডেন্টপন্থিদের সরাতে ন্যাশনাল গার্ড ডাকলেন।

আর, মিডিয়া ডাকল রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তারা আবার দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বিতর্কে মেতে উঠলেন। তাদের অনেকেই বললেন— যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাহী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো মার্কিন প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী থাকায় ট্রাম্পপন্থিরা অতটা ‘ম্যাসাকার’ চালাতে পারেনি। তারা ভেবেছিলেন ক্ষমতার পালাবাদল আরও সহিংস হবে। তাও অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। আরেক অংশ বললেন, ‘সর্বনাশ’ হওয়ার আর কিছু বাকি নেই। পার্লামেন্টের মতো ‘মহাপবিত্র’ গন্তব্যেও আক্রমণ হয়েছে। সেখানে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। মার্কিন প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতাই, এমন ঘটনা ঘটানোর সুযোগ করে দিয়েছে।

আবার, বাংলাভাষী মার্কিন রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলছেন— নিজেদের দেশেই গণতন্ত্রের এমন বীভৎস রূপ রেখে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে নেয়? যেন ক্যাপিটল হিলের সহিংসতা তাদের একান্ত নিজস্ব গণতন্ত্রহীনতার নৈশকালীন চুলকানির মধ্যে শান্তির মলম হয়ে এসেছে।

পার্লামেন্টে সহিংসতা কি এই প্রথম?

এর আগে, পার্লামেন্টে সহিংসতা এত বড় আকারে না হলেও ক্যাপিটল হিলে এর আগে কয়েকদফা হামলা হয়েছে। এছাড়াও, হংকংয়ের নগররাষ্ট্রের পার্লামেন্ট বন্দি প্রত্যার্পণ আইনবিরোধী আন্দোলনকারীরা দখল করে নিয়েছিলেন। তাছাড়াও, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাস্তায় নামা থাইল্যান্ড-বেলারুশ-ফ্রান্সের তরুণদেরও পার্লামেন্ট অভিমুখে আন্দোলন পরিচালনা করতে দেখা গেছে।

তো, সেইসব পার্লামেন্ট আক্রমণের ঘটনার আমরা হয়তো খবরও রাখিনি। কিন্তু মার্কিন পার্লামেন্টে ট্রাম্পপন্থিদের হামলা এই যে আমাদের ভাবাচ্ছে, এর পেছনে রয়েছে মিডিয়ার ‘মধ্যস্থতাকারী’ হতে চাওয়ার আজন্ম লালিত বাসনা।

যতক্ষণে উত্তেজিত মিডিয়া ক্যাপিটল হিল আক্রমণের খবর জানাচ্ছে, জানাচ্ছে আক্রমণ পরবর্তী অভিযান এবং তার ডেভেলপমেন্ট, ততক্ষণে, সেই ‘হটকেক স্টোরি’র সাবপ্লটে কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাচ্ছেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু, কোনোভাবেই ওই বর্ষীয়ান ডেমোক্রেট মিডিয়ার ‘ফোকাস’ পাচ্ছেন না। থাকছেন দুই বা তিন নম্বর গুরুত্বের জায়গায়।

বাইডেন কাহিনী

বেচারা বাইডেন!

স্বীকৃতি তো মিলল, কিন্তু নিষ্কৃতি মিলল কই? ক্যাপিটল হিলের গণ্ডগোল মেটাতে তাকে আবার সেই ট্রাম্পেরই শরণাপন্ন হতে হলো। অনেকটা নিরুপায় হয়েই তাকে বলতে হলো— ট্রাম্প যেন তার লোকেদের বাড়ি ফিরে যেতে বলেন। শান্তি ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখেন।

আর, ট্রাম্প যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় বসেই ছিলেন। ইতোমধ্যেই ক্যাপিটল হিলের সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগ এনে ট্রাম্পের ‘মূল অস্ত্র’ টুইটার তাকে ‘ব্লক’ করেছে। হামলাকারীদের সম্ভাষণ জানিয়ে করা তার ভিডিও সরিয়ে নিয়েছে ফেসবুক আর ইউটিউব।

তাই কার্যত মিডিয়া ও নিউ মিডিয়া থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসেই হোয়াইট হাউজের সোস্যাল মিডিয়া বিভাগের মাধ্যমে ট্রাম্প তার সমর্থকদের উদ্দেশে বললেন— সবাই যেন শান্ত থাকে আর বাড়ি ফিরে যায়। তিনি ভোটের ফলাফল মানেন না, ঠিক আছে। কিন্তু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে বাইডেনের কাছে ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা বুঝিয়ে দেবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

এদিকে, ট্রাম্পের এই ঘোষণা কীভাবে আসবে, তাই নিয়ে ভেবে ভেবে নির্বাচনের পর থেকে অনেক বিশ্লেষক কোনো কূল-কিনারা করতে পারেননি। অনেকে তো, বলতে চাইছিলেন— ট্রাম্প যে ‘খচ্চর’ প্রকৃতির, কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরেই থাকবেন।

যাই হোক, এক বিবৃতি দিয়ে সেই ‘অসাধ্য’ চোখের নিমিষে সাধন করলেন ট্রাম্প। হার মেনে নিলেন। তবুও তিনি থাকলেন আলোচনার মধ্যমণি হয়ে। যদিও নেতিবাচকতা থাকল, থাকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সমর্থকদের লেলিয়ে দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ।

অপরদিকে, জো বাইডেন জয়ী হয়েও যেন নিষ্প্রভ। তাই, ডেমোক্রেটরা তখন কোনোভাবেই ট্রাম্পকে ‘ম্যানেজ’ করতে না পেরে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড মাইক পেন্সের ওপর ‘ভর’ করলেন। এমনকি, নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেওয়ার আগের এই দুই সপ্তাহের জন্য ট্রাম্পকে সরিয়ে পেন্সকে কিভাবে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বানানো যায়, তার সাংবিধানিক ছক কষলেন। যদিও রিপাবলিকান অধিকৃত কংগ্রেসে সেই আশা পূরণ হবে, তা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।

শেষের খুব কাছাকাছি

এই আলাপ ‘দীর্ঘ বাজে প্যাঁচালে’ পরিণত হওয়ার আগেই আমরা একটু ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে দেখব— গণতান্ত্রিক দুনিয়ার ‘রোল মডেল’ মার্কিন মুল্লুকে নভেম্বরের ৩ তারিখ যে নির্বাচন হলো, সেখানে নজিরবিহীন সব ঘটনা ঘটলো। গুটিকয়েক মার্কিন প্রেসিডেন্টের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মাত্র এক মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারলেন ট্রাম্প।

ফলাফল না মেনে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট করলেন। সেখান থেকেও ফলাফল নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ঘোষণা আসল, ভোট পুনর্গণনাও হলো। মার্কিনিদের ইতিহাসে প্রথম, পরাজিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জনসম্মুখে নিজেকে বিজয়ী বলে প্রচার করতে থাকলেন, করতেই থাকলেন।

ক্ষমতায় থেকেও তিনি অভিযোগ করলেন— বিরোধীরা নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর প্রভাব খাটিয়ে ‘কারচুপি’ করে তাকে পরাজিত বানিয়েছেন, তিনি আসলে হারেননি। জটিলতার জল গড়াতে গড়াতে কংগ্রেসের যৌথসভা অবধি চলে গেল। সেখানেও ট্রাম্প না বাইডেন— এই প্রশ্নের সরল উত্তর মিলল না।

উল্টো ট্রাম্পপন্থিরা ক্যাপিটল হিলের যৌথ অধিবেশনে হামলা চালিয়ে সেই সংকটের ময়দান থেকে সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের প্রাণ নিয়ে সুড়ঙ্গপথে পালিয়ে যেতে বাধ্য করল।

যখন জনমত-আদালত-পার্লামেন্টসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্ভূত জটিলতার সমাধান দিতে ব্যর্থ হলো, ঠিক তখনই জনতার দর্পণ বা রাষ্ট্রের চতুর্থ নাকি পঞ্চম স্তম্ভ— মিডিয়া, সেই মিডিয়া আসলো ত্রাণকর্তা হয়ে। আউটলেটগুলো তাদের কভারেজের জাদুকরি শক্তি ব্যবহার করে দীর্ঘ জটিলতার দ্রুত আর ‘সম্মানজনক’ সমাধান বাতলে দিলো। আর এই ‘রোল প্লে’টাই করতে চেয়েই ক্যাপিটল হিলের সহিংসতা নিয়ে মিডিয়ার এত উত্তেজনা।

এখন ক্যাপিটল হিলে ঘটে যাওয়া ওই ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ আর ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা পরবর্তী আদর্শ গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় ট্রাম্প-বাইডেন দুই পক্ষই হয়তো সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকবেন। বাইডেন হোয়াইট হাউজে ওঠার জন্য বাক্স-পেটরা গোছগাছ করতে লেগে যাবেন, আর ট্রাম্প ‘আবার আসিব ফিরে’ মন্ত্র জপতে জপতে ২০২৪ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের আশায় অগ্রিম লবিং শুরু করবেন।

ক্যাপিটল হিলে সহিংসতা জো বাইডেন ডেমোক্রেট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউ মিডিয়া মার্কিন পার্লামেন্ট মিডিয়া রিপাবলিকান

বিজ্ঞাপন

যখন গিটার বাজে, হৃদয়ও কাঁপে
১৩ জুলাই ২০২৫ ১৩:৪৫

আরো

সম্পর্কিত খবর