Wednesday 03 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এবারের নির্বাচনে হিন্দুরা কি করবে?

খোকন দাস
৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:৫৭

এই দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠী এবারের নির্বাচনে কি করবে? আরো সরাসরি বললে বলতে হয় আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে হিন্দু জনগোষ্ঠী কাকে ভোট দেবে?

এই দেশে দীর্ঘ দিন থেকে এটা প্রচারিত যে, হিন্দুরা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক, হিন্দু মানেই আওয়ামী লীগ। এই অভিযোগ অনেকাংশে সত্য, তবে পুরোপুরি সত্য নয়। হিন্দুদের অনেকে সরাসরি আওয়ামী লীগ করেন, আবার অনেকে সমর্থন করেন এই সর্বৈব সত্য। এর বাইরে সত্য হচ্ছে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আওয়ামী বিরোধী।

হিন্দু মানে আওয়ামী লীগ বা হিন্দুরা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক – এটা এই জনগোষ্ঠীর জন্য বড় ধরনের একটা ট্যাগিং, আওয়ামী লীগ সচেতনভাবে এই ট্যাগিং জারি রাখতো বিবিধ কারণে। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে হিন্দুদের উন্নয়নের চাইতে ভারতকে ম্যানেজ করাসহ তাদের রাজনৈতিক স্বার্থই ছিল সবচেয়ে বেশি। এক কথায় হিন্দু জনগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে এ যাবৎ।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে অন্যদলগুলোও এই ট্যাগিং এর চর্চা করে তাদেরকে আওয়ামী লীগের দিকে ঠেলে দিয়েছে। হিন্দুদের মনে তারা এই ধারণা সঞ্চার করতে পেরেছে যে, আওয়ামী লীগ না থাকলে হিন্দুদের নিরাপত্তা থাকবে না।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেড় বছর হতে চলেছে, হিন্দুদের নিরাপত্তার সে রকম কোন হুমকি এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। এই বিবেচনায় উল্লিখিত মিথ ভেঙে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্ন আসতে পারে হিন্দুরা এবার কাকে ভোট দেবে?

.

দল হিসেবে বিএনপির বড় দায়িত্ব হচ্ছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রাজনীতির মধ্যে, সাংগঠনিক কাঠামোতে ধারণ করা। বরাবরই তারা ট্যাগিং এর রাজনীতির মধ্যে ঢুকে সংখ্যালঘুদের আওয়ামী লীগের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে বিষয়গুলোর গুরুত্ব তাদেরকাছে অনুভূত হয়েছে। তাদের সংস্কারের ৩১ দফায় বিষয়টা গুরুত্ব পেয়েছে। তবে সংখ্যলঘুদের সঙ্গে মনস্ত্বাত্তিক ও সাংগঠনিক দূরত্ব দূর করার উদ্যোগ ও কর্মসূচি অনুপস্থিত।

তারা যে প্রার্থী ঘোষণা করেছে তা দেখলেও এটা স্পষ্ট হয়। একঝাঁক সৎ শিক্ষিত ব্যক্তিকে দলের সাংগঠনিক কাঠামো, নেতৃত্বে নিয়ে আসার মতো উদারতা ও প্রজ্ঞা দেখাতে পারেনি, এটা দলটির নেতৃত্বের দুর্বলতা হিসেবে চিহ্রিত হয়ে থাকবে। গত দেড় বছর খুব কম সময় নয়, এই সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতিগোষ্ঠীগুলোকে আস্থায় নেওয়ার কর্মসূচি দৃশ্যমান হয়নি।

বিএনপি যে দুইজনকে মনোনয়ন দিয়েছে তারা হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব করেন না, হিন্দু আওয়ামী লীগ নেতাদের মতোই তাদের অবস্থান। তাদেরকে সামনে রেখে এই কমিউনিটিকে কাছে টানার সুযোগ খুবই কম।

তবে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা জুলাই অভ্যুত্থানের পর যেভাবে চাপা দেয়ার চেষ্টা হয়েছে বিএনপির কারণে তা সম্ভব হয়নি, বরং মুক্তিযুদ্ধের কারা বিরোধিতা করেছিল, কারা দেশের স্বাধীনতাই চায় নি সেই ইস্যুটা নতুন করে উঠে এসেছে। কেবল তাই নয়, ভোটের যুদ্ধের অন্যতম ইস্যু হয়ে তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়ছে। বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরা টন টন বই লিখেও নতুন প্রজন্মের মাথায় ঢুকাতে পারে নি, বিএনপির হাত ধরে এখন ঘরে ঘরে পৌছে যাচ্ছে।

বিষয়টা হিন্দুদের মনে আসার সঞ্চার করবে, কেননা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এই দেশের হিন্দুরা তাদের অস্থিত্বকে একাকার করে দেখে।

.

এবার হিন্দু ভোট কাছে টানার ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর তৎপরতা বেশ চোখে পড়ার মতো। তাদের নিজস্ব দলের ভোট আছে, এখন তারা সুইং ভোট টানার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে যতোটা হিন্দু ভোট পক্ষে টানা যায় সেটা বাড়তি পাওনা। এবারের নির্বাচনে অনেক আসনে হিন্দুভোট নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।

জামায়াতে ইসলামীর কাছে বিষয়টি গুরুত্ব পাবে এটা স্বাভাবিক। দলটির হিন্দু শাখা খোলা, হিন্দুদের কাছাকাছি যাওয়া, তাদের নিরাপত্তায় সক্রিয় অবস্থান নেয়া গুরুত্বের দাবি রাখে। বিশেষ করে এবারের দুর্গা পূজায় দলটির নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্য ব্যাপকভাবে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। কোন কোন স্থানে তারা হিন্দুদের কাছাকাছি যেতে পারলেও সার্বিকভাবে হিন্দুদের আস্থা অর্জন থেকে বহু দূরে আছে। ট্যাগিং এর রাজনীতির পরিবর্তে হিন্দুদের কাছে টেনে নেয়ার যে উদ্যোগ তার তারিফ করতেই হয়।

হিন্দুদের মনের মধ্যে স্থান করে নিতে দলটির ক্ষেত্রে বাস্তব কিছু সমস্যা রয়ে গেছে, যা অতিক্রম করা দলটির পক্ষে প্রায় অসম্ভব। প্রথমত, জামায়াতে ইসলামী একটা ঘোষিত ইসলামী দল। ইসলামী দল হিসেবে অন্য ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে কাজ করতে পারে না তা নয়, তার জন্য তাকে হিন্দু শাখা খোলার মতো স্ববিরোধী ও হাস্যকর কাজ কেন করতে হবে? হিন্দু শাখার লোকজন কি দলটির নেতৃত্বে আসতে পারবে? যদি না পারে তা হলে এই উদ্যোগ এই জনগোষ্ঠীর জন্য একটা তামাশারই সামিল।

দ্বিতীয়ত, দলটির বেশ কয়েকজন ধর্মীয় বক্তা ওয়াজ মাহফিলগুলোতে অব্যাহতভাবে হিন্দুদের দেবদেবী নিয়ে অসম্ভব কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে আসছেন। শিশির মনিরের রোজা পূজা বক্তব্যের পরপরই একজন হুজুরকে দুর্গা মূর্তি নিয়ে বাজে মন্তব্য করতে দেখা গেছে। তাদের ধর্মকে অবমাননা বন্ধ না করে কাছে টানতে চাওয়াতে কতটুকু সাড়া দেবে তা অনুমা করা কঠিন নয়।

তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু জনগোষ্ঠীকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে, এটা কখনোই তারা ভুলে যাবে না। এবং দলটির ভূমিকাও সহজে ভুলে যাবে এটা ভাবার কোন কারণ নেই।

.

আওয়ামী লীগের মধ্যে খুপরিবদ্ধ হয়ে থাকার কারণে বিগত ৫৩ বছরে এই দেশের হিন্দুদের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরি হয়নি,একইসঙ্গে এই কমিউনিটির মধ্যে রাজনৈতিক অধিকার বোধ তৈরি হয়নি। আওয়ামী লীগের পতনের পর নিজেদের দাবির পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে সুযোগ এসেছে নেতৃত্বের অভাবে তা সম্ভব হয়নি।

হিন্দুরা কিছু আসনে নিজেদের প্রার্থী দিয়ে সংসদে তাদের প্রতিনিধি নিয়ে যাওয়ার কাজটা করা ছিল জরুরি, অতীতের ধারাবাহিকতায় সামনের সংসদেও হিন্দুদের কোন প্রতিনিধি থাকছে না। এমনকি হিন্দু পরিববার থেকে আসা সংসদ (যে দলই করুক না কেন) সদস্যের সংখ্যা আসন্ন সংসদেই সম্ভবত তলানিতে থাকবে।

আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডায়ও বিষয়টা সেভাবে আসেনি। এতোগুলো কমিশন হয়েছে, এই দেশের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিষয়ে একটা কমিশন হওয়ার তাগিত অনুভূত হয়নি কারো মধ্যে, এটা দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা। জুলাই সনদ নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে রাজনীতিতে এটাও বাস্তবতা। এসব বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।

গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনেন জন্য নির্বাচন জরুরি, সেই নির্বাচন এখন সমাগত। তবে নির্বাচনই শেষ কথা নয়। একটা কুক্ষিগত অবস্থা থেকে হিন্দুরা মুক্ত হতে পেরেছে, এটা বড় সুযোগ। এখন স্বাধীনভাবে বুদ্ধিবিবেচনা খাটিয়ে, স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতি বিবেচনায় নিয়ে তারা ভোটের সিদ্ধান্ত নেবে।

হিন্দু মানে ওমুক দল, হিন্দু মানে ওমুক মার্কা এই ধরনের খুপরির মধ্যে এই জনগোষ্ঠী কখনোই ঢুকবে না, সে চেষ্টা যারা করবে অতীত স্বৈরাচারের মতো তারা বোধহয় প্রত্যাখ্যাত হবে। মুক্তিযুদ্ধ, নিরাপত্তা, ধর্ম পালনের (কেবল দুর্গা পূজায় পাহারা নয়), মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নারীর নিরাপত্তা এইসব বিষয় নিশ্চয় ভোটের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে।

শেষ কথা, হিন্দুরা নির্ভয়ে কেন্দ্রে যাবে, যাকে ইচ্ছা তাকে ভোট দেবে। হিন্দু মানে ওমুক দল, এই কুক্ষিগত করার রাজনীতি আর করবে না। এবারের ভোটই শেষ কথা নয়, হিন্দুরা দেশ গঠনে সাহস নিয়ে এগিয়ে আসবে, রাজনীতিতে সক্রিয় হবে, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: সাবেক ছাত্র নেতা ও লেখক