মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন আর জুলাই বিপ্লব আমাদের ঘুরে দাঁড়াবার আলোকবর্তিকা স্বরূপ। এর নায়ক জেন- জি তথা জেন-জেড প্রজন্ম। সম্মুখভাগে থেকে যাবতীয় অনাচার, বৈষম্য, নির্যাতন আর স্বৈরাচারের অবসানে কখন যে আমাদের অপত্য ছায়ায় এই প্রজন্ম হঠাৎই বড় হয়ে উঠলো তা আমরা কেউ ঠাহর করতে পারিনি। এদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। এদের নিয়ে সত্যিকার অর্থে আমাদের বিশেষ কোন চিন্তাভাবনা ছিলো না। যা ছিলো তাও মোটেই সুখকর ছিলো না। আমাদের মত বুড়োদের দৃষ্টিতে তারা রাতজাগা, হতাশাগ্রস্ত, লক্ষ্যহীন উচ্চাকাঙ্খী এক প্রজন্ম। তারা ঘরের দরোজা বন্ধ করে ল্যাপটপ আর অ্যান্ড্রয়েড হাতে সারারাত কী শ্রাদ্ধ করে তা নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ ছিলো না।
অথচ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তারাই সবার অলক্ষ্যে ‘সিক্রেট কোড’ ব্যবহার করে ইশারা ইঙ্গিতে নিজেদেরকে অদৃশ্য এক রঙ্গিন ছাতার নিচে জড়ো করতে পেরেছিলো। ক্ষমতার সকল হাতিয়ার প্রয়োগ করেও স্বৈরাচার স্বস্তিতে থাকতে পারে নি। শেষমেশ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে পৃথিবীতে যত আন্দোলন- সংগ্রাম জয়ের মালা পড়তে পেরেছে আমাদের এই জেন-জি প্রজন্ম অবশ্যই তাদের পুরোভাগে থাকবে। নি:সন্দেহে এটা আমাদের জন্য গবের্র, আলোর আর উদ্দীপনার ।
বিপ্লব চলাকালীন যে বিষয়টা নিয়ে খটকা লেগেছিলো তা হলো তাদের মুখনিঃসৃত ভাষা। যেসব শব্দ তারা নিজেরা কোন দিন ব্যাবহার করেনি বা এসবের সঠিক অর্থও তারা জানে না সেসব শব্দযোগে অবলীলায় রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়েছিলো তারা। বিসদৃশ ও শ্রুতি কটু সেসব শ্লোগান সভ্যসমাজের শিক্ষিত প্রজন্মের কাছ থেকে কেউ আশাও করেনি। কিন্তু তখন কেউ তাতে তেমন গুরুত্বারোপও করেনি। যুদ্ধে যেমন সবকিছু জায়েজ তেমনি বিপ্লবে সব কিছু সভ্যতা-ভব্যতা মেনে চলবে এটা আশা করাও ঠিক না। যে শব্দগুলো গ্রামীণ জনপদে রাগে, ক্ষোভে, জেদে ব্যবহৃত হয়ে থাকে সেগুলোই শিক্ষার্থীদের মুখে আশ্রয়- প্রশ্রয় পেয়ে গেলো খুব সহজে। কানে বাজলেও বড় অভীষ্ট অর্জনে এসব শব্দ বোমা স্বৈরাচার উৎখাতে ঐকতানের সৃষ্টি করেছিলো সন্দেহ নাই। বিপ্লবের পুরোভাগে থাকা অকুতোভয় মেয়ে শিক্ষার্থীরাও অশ্রাব্য এসব শব্দ প্রয়োগে ছিলো সাবলীল। রাজপথকে তারা ধরেই নিয়েছিলো নিয়তির ‘শেষ’ হিসেবে। তাই সমাজ কি বললো, পরিবার কি ভাবলো, স্বজনরা বিষয়টিকে কীভাবে নিলো- এগুলোর কোনিটিতেই তাদের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিলো না ।
বিপ্লবোত্তর দিনে আমাদের আশা ছিলো সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে একটা সুন্দর সম্ভাবনাময় কাঠামো জাতির সামনে হাজির করা হবে। স্বপ্ন ছিলো বৈষম্যের অবসান হবে। গুম, খুন, অপহরণ, জুলুম-নির্যাতন আর লুটপাটের অবসান হবে। সর্বত্র শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। দিন যায়, সপ্তাহ আসে। মাস যায়, বছর ঘুরে। আশাগুলো কেবলই দুরাশায় থেকে যাচ্ছে। বিপ্লব আঁতুড় ঘরেই শুয়ে পড়েছে। তাকে কতিপয় বয়ষ্ক অভিভাবক কায়দা কানুন করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। প্রশাসনে পুরাতন কুশীলবদের সরিয়ে দেওয়া যাবে না, স্বৈরাচারের গ্রন্থিত স্তরভিত্তিক প্রশাসনে কোন সংস্কার করা যাবে না বলে যে বা যারা এই দাওয়াই প্রস্তাব করেছে তারা আর যাই হোক বিপ্লবের শত্রু, ঘাপটি মেরে থাকা পুরোনো প্লে-বয় ছাড়া আর কিছু না। বুড়োরা কর্তৃত্ব ফলিয়ে গ্রাস করে নিচ্ছে যেখানে যা পাচ্ছে। তাদের দেখে ছোটরাও হাতাচ্ছে, কোপাচ্ছে, কাঁপাচ্ছে। তাদেরও ছোটরা এসব দেখছে, শুনছে। এর দ্বারা তারা কী ম্যাসেজ পাচ্ছে? সব মিলিয়ে জনগণের সামনে ‘যে লাউ সে কদু’র চিত্র ফুটে উঠতে সময় নেয় নি। জনগণ আজ চরম হতাশ, শান্তিপ্রিয় গোষ্ঠী চরম শংকিত আর ছাত্ররা দিকভ্রান্ত ।
বড়রা খিস্তিখেউড় করছে, টকশোতে বসে আস্ফালন করছে, মারমুখী হচ্ছে, অপমানকর ও মানহানিকর শব্দ ও বাক্যযোগে একে অপরকে নাস্তানাবুদ করছে। ছাত্ররা পাশে বসে কথা বললে তাদেরকে ‘হাঁটুর সমান বয়স’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে। ভাবটা এমন যে তারা আবার রাজনীতির কী বুঝে? এগুলো দেখে শুনে ছোটরাও বড়দেরকে অবজ্ঞা করতে শিখেছে আর তাই মান্যগণ্যতা কমিয়ে দিয়েছে। তারাও চোখে চোখ রেখে, মুখে মুখে সমানে সমানে অশালীন ভাষা প্রয়োগে পিছপা হচ্ছে না। সবাই একযোগে নেমেছে একে অপরের বস্ত্র হরণে। আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতির বিপরীতে এ চিত্র বড় বেমানান ও ভয়ংকর। দলবাজীই মুখ্য বাকি সব সুকুমার বৃত্তি তুচ্ছ – এমন একটা সংস্কৃতি এখন দেশ জুড়ে চলছে। যা মোটেই শোভনীয় নয়, কাম্যও হতে পারে না। তাই, আমরা কী শিখাচ্ছি আর ছোটরা কী শিখছে তা আমলে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। আগে তবু ‘পারিবারিক শিক্ষা’ বলে একটা হাতেখড়ি অনুশাসন ছিলো এখন বোধহয় তাও তেমনভাবে নেই। দুর্গন্ধ ও দুর্ব্যবহার ছড়াতে ছড়াতে আমরা কোথায় যাচ্ছি কেউ জানি না। কেউ গা-ও করছি না।
সমাজে এখন যার মুখে যত দুর্গন্ধ তার মার্কেট ভ্যালু ততবেশি। সবাই তাদেরকে সমীহ করে চলে। যার চোখের পাতা যত শক্ত প্রতিষ্ঠার দৌড়ে সে ততবেশি সফল। যার চরিত্রে যত কালিমা তার গলা তত বড়। এহেন পরিস্থিতে জেন-জি প্রজন্ম কী ভাবছে আমরা তা জানার চেষ্টাও করছি না। মাঝেমধ্যে অনেকেই বলে থাকেন আরেকটা বিপ্লবের নাকি প্রয়োজন হবে। কারা সে বিপ্লব করবে? কী তাদের উদ্দেশ্য, কীরকম তাদের প্রস্তুতি ও কতটা আছে তাদের মনের জোর? জানা নেই। এভাবে তো চলতে পারে না। সামনে নির্বাচন। এরপর? আওলাঝাওলা এই পরিবেশ কি এক নির্বাচনেই ম্যাজিক মন্ত্রের মত ঠিকঠাক হয়ে যাবে? হলে তো ভালোই। আর না হলে? সে চিন্তা কি আমাদের আছে? আমাদের সামনেই বেড়ে উঠছে জেন-জি প্রজন্মের উত্তরসূরী জেন-আলফা প্রজন্ম। তারা কী শিখছে, কী দেখছে, কী শুনছে? তাদের খবর কি আমরা রাখি? আর জেন-জি প্রজন্মকে মোকাবেলা করার কোন অনুশীলন কি আমরা করছি? ভেবে দেখা দরকার এবং তা এখনই। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।
লেখক: কলামিস্ট