ভাগ্যিস আমি মানুষ নই!
৭ জুলাই ২০১৯ ১৭:৩৯
ছোট্ট আম্রপালি গাছ। বেশি তার বয়স না। বছর কয়েক। মানুষের জীবন হিসাব করলে তার বয়স বেশি না। কিন্তু তার সাধারণ জীবনচক্র হিসাব করলে, সে হয়তো মধ্য বয়সে। আর বড়োজোর বছর দশেক। এখন সে আম ফলায় ঘন সবুজ রঙা আম। পাকলে টসটসে এক টুকরো জাফরানি রং যেন। আম্রপালি গাছ খুশি, এ বাড়ির আঙিনায় জন্মে, ফল-ফলান্তি জীবনে শান্তি আছে। শুধু একটাই আফসোস, সে মানুষ নয়। মানুষ হলে নাকি অনেক অনেক দিন বাঁচা যেতো। অনেকদিন ধরে পৃথিবী দেখা যেত। এই যে বৈশাখের ঝড়, আর সোনালী সোনালী টুকরো টুকরো রোদ, মাঝে মাঝে কষ্ট দেয় বটে। কিন্তু সুখ ও তো আছে। স্নিগ্ধ বৃষ্টি ভেজা সবুজ শরীর, আর সূর্যে সবুজে রোদ বিলাস। সে তো বেশিদিন আর দেখা হবেনা। মানুষ হলে হতো। অনেক অনেক দিন, মাস, বছর। আহারে, সে তো মানুষ না।
লামিয়া কে দেখলে তার খুব ভালো লাগে। তার বয়সি। যে উঠোনে আম্রপালি বাস, সে উঠোনের সাথে হে দালান, সেখানে লামিয়া থাকে। সে অর্থে আম্রপালি আর লামিয়া প্রতিবেশী।
লামিয়া গাছ নয়, মানুষ। তবু আম্রপালি’র কেন লামিয়াকে এতো বন্ধু মনে হয়- কে জানে? হিংসে হয় না তো এতোটুকুও। লামিয়া আর আম্রপালি প্রায় সমবয়সী। লামিয়া মানুষ বলে বাঁচবে বেশি, আর সে নয়? বরং লামিয়া কে দেখলে তার সবচেয়ে আনন্দ হয়। মনে হয় বেঁচে যতদিন থাকবে, লামিয়া সাথে থাকুক। লামিয়া মানুষ হলেও বড্ড আদুরে, সবুজ।
লামিয়া বোধহয় আম্রপালি’র মনের কথা বুঝতে পারেনা। আম্রপালি তো বলতে ও পারেনা। সে তো মানুষ নয়। তবে লামিয়া আম্রপালির কাছে আসে। বিকেলবেলা। খেলার বেলায়। লামিয়া আম্রপালি পাশে বসে। কোনোদিন পাতা ছিড়েনা। বরং গান গায়। সে গান আম্রপালি বোঝেনা। কিন্তু কেমন যেন হু হু একটা সুর আছে। শুনতে ভালো লাগে। বিকেলের খেলে যাওয়া বাতাসে, লামিয়ার খেলা বেলায়, আম্রপালি ও খেলার ছলে পাতা দোলায়।
আজকের বিকেলটা অন্যদিনের মতন। প্রায় অন্যদিনের মতনই ছিল। বিকালে বাতাস তার নিয়মেই খেলছিল। চেনা চড়ুই এসে এসে ঠোঁট দিয়ে টোকা দিয়ে যায়, এ পাতা ও পাতায়। যেমন যায় প্রায়ই, তেমন আর কি।
লামিয়াও ছিল। সাথে ছিল তিন তলার সেই শক্তিশালী মানুষটি। যাকে আম্রপালি ভয় পায়। কেমন যেন অনেক বড়, অনেক লম্বা। অনেক দাপট। লামিয়ার মতন আদুরে নয়। যখন তখন ঘাস মাড়িয়ে যাওয়া, পাতা ছিড়ে ফেলা ধরণের মানুষ।
লামিয়ার সাথে কেন এ মানুষটি আম্রপালি বোঝেনি। আর কোনো মানুষ নেই চারপাশে। আম্রপালি চেয়ে দেখছিলো শুধু।
দেখছিলো যে, লামিয়া হাসছেনা একটু ও। লামিয়ার তীব্র চিৎকার, আর তার শরীর কেটে ভেসে যাওয়া লাল লাল জবা ফুলের মতন রক্ত, আম্রপালি কে কেমন কাঁপিয়ে দিয়েছিল। গাছের পাতা ছিড়লে যন্ত্রনা হয় আম্রপালি জানে। কিন্তু লামিয়ার যন্ত্রণার চিৎকার তার কাছে প্রথম, নতুন। লামিয়া ছুটে যেতে চেয়েছিল। লামিয়া বাঁচতে চেয়েছিলো। আম্রপালি বাঁচাতে পারেনি। লামিয়ার তীব্র হাহাকারে – আম্রপালি শুধু কেঁপে কেঁপে উঠেছিল পাতায় পাতায়।
আম্রপালির পায়ের কাছে পরে আছে, খবরের কাগজের টুকরো। এই খবরের কাগজের টুকরো সবাই পড়ছে আজকাল, আস্তে আস্তে, ফিসফিসিয়ে, জোরে জোরে, কেঁদে কেঁদে, রেগে রেগে – শিশু লামিয়া কে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা।
আম্রপালি সে লেখা পড়তে পারেনি। সে তো গাছ মাত্র। সে পড়তে পারেনা। সে আর কক্ষনো লামিয়া কে খুঁজে পায়নি আর। লামিয়ার সাথে আম্রপালির আর দেখা হয়নি কোনদিন। আম্রপালি জানে যে সে মানুষের মতন দীর্ঘায়ু নয়। আজকাল এ ভাবনায় আম্রপালির আর দুঃখ হয়না। বরং বড্ড স্বস্তি হয়। সে ভাবে, – ‘ভাগ্যিস আমি মানুষ নই।’
সারাবাংলা/এমএম