Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালো নেই

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২১ জানুয়ারি ২০২২ ২০:১৭

এখন রাত ২টা বাজে। একটু আগে টেলিফোন বেজে উঠেছে। গভীর রাতে টেলিফোন বেজে উঠলে বুকটা ধ্বক করে উঠে, তাই টেলিফোনটা ধরেছি। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) একজন ছাত্র ফোন করেছে। পত্রপত্রিকার খবর থেকে জানি সেখানে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। মোটামুটি নিরীহ একটি আন্দোলন বিপজ্জনক আন্দোলনে মোড় নিয়েছে। ছাত্রটি ফোনে আমাকে জানাল, অনশন করা কয়েকজন ছাত্রকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। একজনের অবস্থা খুবই খারাপ, ডাক্তার বলেছে কিছু না খেলে ‘কোমায়’ চলে যেতে পারে। ফোন রেখে দেওয়ার আগে ভাঙা গলায় বলেছে, ‘স্যার, কিছু একটা করেন।’

বিজ্ঞাপন

আমি তখন থেকে চুপচাপ বসে আছি, আমি কী করব? আমার কি কিছু করার আছে?

আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি অনেকবার অনেক ধরনের আন্দোলন হতে দেখেছি। কাজেই  আমি একটি আন্দোলনের ধাপগুলো জানি। প্রথম ধাপে যখন হলের মেয়েরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে গিয়েছে, সেটি সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। আমি খুব ভালো করে জানি, একটুখানি আন্তরিকতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের কঠিন দাবি-দাওয়াকে শান্ত করে দেওয়া যায়। কেউ একজন তাদের ভালো-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামায়, তারা শুধু এটুকু নিশ্চয়তা চায়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যদি একটুখানি জনপ্রিয়তা পায়, তখন সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সেখানে ঢুকে পড়ে সেটাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যদি সতর্ক না থাকে, তখন নেতৃত্ব তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। আন্দোলন যদি থেমে না যায় তখন সরকারি ছাত্রদের সংগঠন (এখানে ছাত্রলীগ) তাদের ওপর হামলা করে। প্রায় সবসময়ই সেটি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তাদের শলাপরামর্শে। তারপরও যদি আন্দোলন চলতে থাকে, তখন কর্তৃপক্ষকে পুলিশ ডাকতে হয়। পুলিশ এসে পেটানোর দায়িত্ব নেয়।

আরও পড়ুন- ভিসি ফরিদের বক্তব্যে অনেক মেয়ের উচ্চ শিক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে

এই আন্দোলনে আমি এর প্রতিটি ধাপ ঘটতে দেখেছি। প্রচলিত প্রক্রিয়ার বাইরে যেটি হয়েছে, সেটি হচ্ছে পুলিশের অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতা। যত বড় পুলিশ বাহিনীই হোক, তারা শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলার আগে একশবার চিন্তা করে। এখানে সেটি হয়নি। শটগান দিয়ে গুলি পর্যন্ত করা হয়েছে। বিষয়টি আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। পুলিশের চৌদ্দ পুরুষের সৌভাগ্য যে সেই গুলিতে কেউ মারা যায়নি। বোঝাই যাচ্ছে, সিলেটের পুলিশ বাহিনীর তেজ এখনো কমেনি। তারা দুইশ থেকে তিনশ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করে রেখেছে। যখন প্রয়োজন হবে, কোনো একজনের নাম ঢুকিয়ে তাকে শায়েস্তা করা যাবে! হয়রানি কত ধরনের ও কী কী, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম বয়সী শিক্ষার্থীরা সেটি এবারে টের পাবে।

বিজ্ঞাপন

তবে একটি বিষয় আমি এখনো বুঝতে পারছি না। পুলিশের এই অবিশ্বাস্য আক্রমণটি ঘটার কারণ হচ্ছে ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়কে তালাবদ্ধ বিল্ডিং থেকে উদ্ধার করা। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের জন্য একটি বিল্ডিংয়ে তালাবদ্ধ হয়ে আটকে পড়া এমন কোনো বড় ঘটনা নয়। একাডেমিক কাউন্সিল কিংবা সিন্ডিকেট মিটিং চলার সময় দাবি আদায়ের জন্য বাইরে থেকে তালা মেরে বিশ্ববিদালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের আটকে রাখার ঘটনা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়েই একাধিকবার ঘটেছে। তারা তখন গল্প-গুজব করে সময় কাটিয়েছেন, সোফায় শুয়ে রাত কাটিয়েছেন, গোপনে কিছু খাবার আনিয়ে ভাগাভাগি করে খেয়ে হাসি-তামাশা করেছেন। কিন্তু পুলিশ ডাকিয়ে ছাত্রদের গায়ে হাত তুলে মুক্ত হওয়ার জন্য কখনো ব্যস্ত হননি। এইবার ভাইস চ্যান্সেলরকে উদ্ধার করার জন্যে শিক্ষার্থীদের ওপর একটি অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতা করা হলো। এর চেয়ে বড় অমানবিক কাজ কী হতে পারে, আমি জানি না। স্বাভাবিক নিয়মেই আন্দোলনটি এখন ভাইস চ্যান্সেলরের পদত্যাগের দাবিতে রূপ নিয়েছে। তবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটি এমন কিছু বিচিত্র দাবি নয়। আমরা প্রায়ই নিয়মিতভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের পদত্যাগের দাবি শুনে আসছি।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এবারেও সেই চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে যায়নি। এটিও নতুন একটি ঘটনা— তারা এখন কোথায় থাকে, কী খায়— আমি জানি না।

আন্দোলন যতক্ষণ পর্যন্ত স্লোগান, মিছিল, উত্তপ্ত বক্তৃতা এবং দেশাত্মবোধক গানের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে সেটাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সেটি যদি শেষ পর্যায়ে চলে যায়, যখন শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশন করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেটি খুবই বিপজ্জনক। তাদের প্রচণ্ড ক্রোধ এবং ক্ষোভ তখন এক গভীর দুঃখবোধ ও অভিমানে পাল্টে যায়। হঠাৎ করে তারা টের পায়— তারা আসলে একা। তাদের পাশে কেউ নেই। ‘আমরণ’ কথাটি থেকে ভয়ংকর কোনো কথা আমি জানি না। বড় মানুষেরা সেটিকে কৌশলী একটি শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু এই বয়সী শিক্ষার্থীরা তাদের তীব্র আবেগের কারণে শব্দটিকে আক্ষরিক অর্থে ব্যবহার করে।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোর নামকরণ করা নিয়ে একবার বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। তখন আমাদের শিক্ষার্থীরা শহিদ মিনারে অনশন করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ব্যবস্থা করেছিল। অভুক্ত শিক্ষার্থীদের দুর্বল শরীরে যখন খিঁচুনি হতে থাকে, সেই দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়। (পরে তারা আমাকে তাদের অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছে। দিনরাত তারা বোধ-শক্তিহীনভাবে পড়ে ছিল। অন্য কোনো অনুভূতি নেই, কেবল এক প্লেট খাবারের স্বপ্ন দেখছে! আমি তাদের সেই কষ্টের কথাগুলো কখনো ভুলতে পারি না।) যে কারণেই হোক, আমার এককালীন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা আবার সেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে— বিষয়টি চিন্তা করে আমি খুবই অশান্তি অনুভব করছি।

আরও পড়ুন-

২.

প্রায় তিন বছর আগে অবসর নিয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার আগের মুহূর্তে আমি বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলরকে তিন পৃষ্ঠার একটি লম্বা চিঠি লিখে এসেছিলাম। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে তাকে সেই চিঠিতে বেশ কয়েকটি উপদেশ দিয়েছিলাম। তিনি যদি আমার উপদেশগুলো শুনে সেভাবে কাজ করতেন, তাহলে আজ বিশ্ববিদ্যালয়টি এরকম বিপজ্জনক একটা জায়গায় পৌঁছাত না।

তিনি আমার উপদেশগুলো সহজভাবে নেবেন— আমি সেটি আশা করি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি করা শিক্ষকদের পুরস্কার হিসেবে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। যদিও অনেক দিক দিয়েই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় অনেক আধুনিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপকরা তাদের উন্নাসিকতার কারণে সেটি মেনে নেন না। কাজেই প্রান্তিক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার মতো একজন শিক্ষকের উপদেশ তার ভালো লাগার কথা নয়।

কিছুদিন আগে আমার ওপর জঙ্গি হামলার বিচারের শুনানিতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যে আমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। আমি একদিনের জন্য সিলেটে গিয়েছিলাম এবং বহুদিন পরে ক্যাম্পাসে পা দিয়েছিলাম। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা রীতিমতো অপরাধ। তাই সবাই দূরে দূরে থাকলেও শিক্ষার্থীরা মন খুলে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। আমি বেশ দুঃখের সঙ্গে আবিষ্কার করেছি, আমার পরিচিত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রটি পাল্টে যাচ্ছে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া বিশেষ হয় না (এখানে শুধু পরীক্ষা হয়)। কাজেই ভালো শিক্ষার্থীরা চেষ্টা চরিত্র করে নিজেরা যেটুকু পারে, শিখে নেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈচিত্র্যময় পরিবেশে অন্য সবার সঙ্গে সময় কাটিয়ে তাদের এক ধরনের মানসিক গঠন হয়, তার মূল্য কম নয়। সেজন্য আমি যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, সবসময় তাদের সব ধরনের সংগঠন করে নানা ধরনের কাজকর্মে উৎসাহ দিয়ে এসেছি। শিক্ষার্থীরা জানাল, এখন তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও বিধিনিষেধ রয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের রাস্তায় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে দীর্ঘ আলপনা এঁকেছিল। শিক্ষার্থীরা জানাল, এখন তারা রাস্তায় আলপনাও আঁকতে পারে না। তাদের দুঃখের কাহিনী শোনা ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না। আমি শুধু তাদের ভেতরকার চাপা ক্ষোভটি অনুভব করেছি। সেই ক্ষোভটি এখন বিস্ফোরণে রূপ নিয়েছে।

৩.

কিছুদিন আগে লন্ডনের একটি ওয়েবিনারে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেটি ছিল বাংলাদেশের শিক্ষা সংক্রান্ত একটি ওয়েবিনার। আমি বক্তব্য দেওয়ার পর সঞ্চালক উইকিপিডিয়া থেকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভয়ংকর দুরবস্থার বর্ণনা পড়ে শোনালেন। তারপর এ বিষয়ে আমার বক্তব্য জানতে চাইলেন। আমি বললাম, ‘আমি এই ব্যাপারটি খুব ভালো করে জানি এবং চাইলে সেটি সম্পর্কে বলতেও পারব। কিন্তু নীতিগতভাবে আমি দেশের বাইরের কোনো অনুষ্ঠানে দেশ সম্পর্কে খারাপ কিছু বলি না। কাজেই আমি এটি নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। আপনি যদি সত্যিই জানতে চান, ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করলে বলতে পারি।’ সঞ্চালক বললেন, ‘তাহলে অন্তত এর সমাধান কী হতে পারে, সেটি বলেন।’ আমি বললাম, ‘সমাধান খুব কঠিন নয়। যেহেতেু বাংলাদেশে ভাইস চ্যান্সেলররা হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা-বিধাতা, তাই রাজনীতি করা শিক্ষকদের নিয়োগ না দিয়ে খাঁটি শিক্ষাবিদদের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দিলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেহারা পাল্টে যাবে।’

সেই ওয়েবিনারে আমাদের শিক্ষামন্ত্রীও ছিলেন। তিনি বক্তব্য দেওয়ার সময় বললেন, একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অনেক কাজ করতে হয়, তাই শুধু শিক্ষাবিদ সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তার মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ থাকতে হয়। সেজন্য নেতৃত্ব দিতে পারেন— সেরকম ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দিতে হয়।

বলা যেতে পারে আমি তখন প্রথমবার বুঝতে পেরেছি, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন সবসময় দলীয় রাজনীতি করা শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি আকস্মিক ঘটনা নয়, সেটি সুচিন্তিত কিন্তু বিপজ্জনক ও ভুল সিদ্ধান্ত! একজন শিক্ষক যদি শিক্ষাবিদ হন, তাহলে তার ভেতর নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলী থাকবে না— সেটি মোটেও সত্যি নয়। তাছাড়া এই দেশে দলীয় রাজনীতি করা শিক্ষক সবসময় আদর্শের জন্য রাজনীতি করেন— এটিও সত্য নয়। যিনি এক সময় ‘জিয়া চেয়ার’ স্থাপনের প্রস্তাবক, সাদা দলের রাজনীতি করেছেন, তিনি সময়ের প্রয়োজনে নীল দলের রাজনীতি করে অবলীলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হতে পারেন। সেরকম উদাহরণ কি আমাদের সামনে নেই?

আরও পড়ুন-

৪.

কাজেই আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকেরা যদি আদর্শবাদী হতেন, ভাইস চ্যান্সেলরদের স্বেচ্ছাচারী কিংবা একগুঁয়ে না হতে দিতেন, ভুল কিংবা অন্যায় করলে প্রতিবাদ করতেন— তাহলেও একটা আশা ছিল। কিন্তু সেগুলো হয় না। ভাইস চ্যান্সেলর যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা-বিধাতা, তাই তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘জ্বি হুজুর’ করার একটি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্দয় আক্রমণ শুরু করেছিল, তখন একজন শিক্ষকও ছুটে গিয়ে পুলিশকে থামানোর চেষ্টা করেননি! শিক্ষার্থীরা এখন শিক্ষকদের শত্রুপক্ষ। আমাদের শিক্ষকেরা সব ধোয়া তুলসীপাতা এবং শিক্ষার্থীরা বেয়াদব এবং অশোভন— আমি সেটি বিশ্বাস করি না। শিক্ষক হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জন্য সম্মানবোধ থাকতে হবে, তাদের জন্য ভালোবাসা থাকতে হবে। সেটি এখন নেই। ভর্তি পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের কী পরিমাণ কষ্ট করতে হয়, সেটি সবাই জানে। সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সেটি চোখের পলকে দূর করে দেওয়া যায়। বহুকাল আগে একবার সেই উদ্যোগ নিয়ে সেই সময়কার শিক্ষামন্ত্রী সব ভাইস চ্যান্সেলরকে ডেকেছিলেন। আমি সেখানে প্রস্তাবটি ব্যাখ্যা করেছিলাম এবং তখন আবিষ্কার করেছিলাম— আমাদের বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষকদের ভেতরে রয়েছে সর্বগ্রাসী লোভ! সেটি প্রকাশ্যে ঘোষণা করতেও তারা সংকোচ অনুভব করেন না! সেই সভায় তারা এক কথায় শিক্ষার্থীদের জীবনকে সহজ করার সেই উদ্যোগটিকে বাতিল করে দিয়েছিলেন!

এই মুহূর্তে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি খুবই জটিল পরিস্থিতি চলছে। আমি একমাস দেশের বাইরে ছিলাম বলে পত্রপত্রিকার খবরের বাইরে কিছু জানি না। খবরের বাইরেও খবর থাকে এবং আজকাল সামাজিক নেটওয়ার্কে বিষ উগড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। আমি সেগুলোও জানি না। যখন একটি নিরীহ আন্দোলন একটি বিপজ্জনক আন্দোলনে পাল্টে যাচ্ছে, আমি তখন প্লেনে বসে আছি। দেশে এসে প্রায় হঠাৎ করে জানতে পেরেছি, আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালো নেই।

একদিকে শিক্ষার্থী, অন্যদিকে ভাইস চ্যান্সেলরের নেতৃত্বে সব শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের দাবি খুবই চাছাছোলা, এটাকে মোলায়েম করার কোনো উপায় নেই। যেহেতু নির্দয় পুলিশি হামলা করার লজ্জাটুকু কেটে গেছে, তাই যদি দ্বিতীয়বার সেটিকে প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বন্ধ না করা যায়, এর একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের কোনো উপায় নেই।

সরকারের নিয়োগ দেওয়া ভাইস চ্যান্সেলরকে প্রত্যাহার করা সরকারের জন্য খুবই অপমানজনক একটি বিষয়। তাই সরকার কখনোই সেটি করবে না। ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়ের সঙ্গে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক আছেন, এবং শুধু তাই নয় দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভাইস চ্যান্সেলররাও আছেন, কাজেই তার নিজ থেকে পদত্যাগ করার প্রশ্নই আসে না।

মনে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনির্দিষ্টকাল হাড়কাঁপানো শীতে অনশন করে খোলা রাস্তায় শুয়ে থাকতে হবে, কেউ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। যে ছাত্রজীবনটি তাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় হতে পারত, সেই সময়টি তাদের জন্য অপমান আর অবহেলার সময় হয়ে যাচ্ছে— সেজন্য আমি তাদের কাছে ক্ষমা চাই।

ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয় আমার এই লেখাটি পড়বেন কি না, জানি না। যদি পড়েন তাকে বলব— বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শেষ দিনটিতে আমি তাকে যে চিঠিটি লিখে এসেছিলাম সেটি যেন আরও একবার পড়েন। সম্ভব হলে তার আশপাশে থাকা শিক্ষকদেরও পড়তে দেন।

এখন যা ঘটছে, সেটি যে একদিন ঘটবে— আমি সেটি তিন বছর আগে তাকে জানিয়ে রেখেছিলাম। তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি।

লেখক: শিক্ষাবিদ

সারাবাংলা/টিআর

টপ নিউজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল শাবিপ্রবি শাবিপ্রবি আন্দোলন

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

দু’দিনে ভারতে ৯৯ টন ইলিশ রফতানি
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৪

সম্পর্কিত খবর