শিক্ষাক্রমের বড়সড় পরিবর্তন ও আমাদের প্রস্তুতি
১৫ জুন ২০২২ ১৩:২০
জাতি কতদূর অগ্রসর হবে কিংবা জাতীয় সমৃদ্ধি-প্রবৃদ্ধি-অগ্রগতি হার কেমন হবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে সেখানকার প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির ওপর। শিক্ষাব্যবস্থা কতটুকু কার্যত ও ফলপ্রসূভাবে শিক্ষার ফলকে তুলে ধরতে পারছে, গুণগত মানকে ধরে রেখে শিক্ষাকে সহজলভ্য করতে পারছে—তা এই সূচকগুলোর মান নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। আর শিক্ষা হলো একটি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ; যা মানুষের সুকুমার বৃত্তি, মানবিকতার উৎকর্ষ সাধন এবং অর্জনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের পদ্ধতি বা শিক্ষা পদ্ধতিকে যদি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের রুচি-জীবনবোধ-বিশ্বাস-উপলব্ধির সাথে সম্পূর্ণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলা না যায় বা কার্যকারী পদ্ধতিতে সাজানো সম্ভব না হয়, তবে তা দ্বারা কখনোই জাতিগত ও সমষ্টিগত উন্নতি সম্ভব নয়।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শিক্ষা পদ্ধতির বড় ধরণের পরিবর্তন আসতে চলেছে। গত ৩০ মে রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) যৌথ সভায় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন এনে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুন এই রূপরেখায় মোটা দাগের পরিবর্তন গুলো হলো— তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না, পুরোটাই মূল্যায়ন হবে সারাবছর ধরে চলা বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে ১০টি বিষয় পড়তে হবে, এখনকার মতো মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থাকবে না। বিভাজন হবে একেবারে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে। আর পরীক্ষা ও সনদকেন্দ্রিক পড়াশোনার পরিবর্তে পারদর্শিতাকে গুরুত্ব দিয়ে একেবারে দশম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত শেখার ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে- ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
নতুন এই রূপরেখার সারমর্ম দাঁড়ালো, পরীক্ষা নির্ভরতা কমিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বশিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যেন শিক্ষার ফলকে প্রকৃত অর্থে প্রয়োগিক ও বাস্তবিক করে তুলে মেধার বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয়। মুখস্থ নির্ভরতা কমিয়ে সৃজনশীলতা, অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ইতিহাস-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ন্যায়-মানবিকতা-মূল্যবোধের প্রতি গুরুত্বারোপ করে কারিকুলাম ও সিলেবাসকে সাজানো হয়েছে। শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা ও অন্যান্য কার্যক্রমেও উৎসাহিত করা হয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এই পরিবর্তনগুলো ছিলো সময়ের দাবি—নিঃসন্দেহে তা শিক্ষার মান উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। উন্নত দেশগুলোতে ক্রমাগত কারিকুলাম সংস্কার করা হয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, জনগোষ্ঠীর চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন করা হয়। ফলে শিক্ষাক্রম হয় সর্বাধুনিক। দেশে প্রবর্তিত নতুন এই শিক্ষাক্রম আমাদেরকেও সেই স্বাদ দিবে বলে প্রত্যাশা করা যায়। তবে এই বড় ধরণের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে আমাদের পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ আছে কিনা, শিক্ষকগণ সঠিক প্রস্তুতি নিতে পারছেন কিনা, তাদের প্রশিক্ষণ যথাযথ হচ্ছে কিনা—সেই বিষয়গুলোও প্রশ্নের দাবী রাখে। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনমাফিক বিজ্ঞানাগার আছে কিনা, পাঠাগার আছে কিনা, খেলার মাঠ আছে কিনা সেসব দিকেও নজর দেওয়া জরুরী।
নতুন এ জাতীয় শিক্ষাক্রমের মূল লক্ষ্য পড়াশোনাকে আনন্দময় করে তোলা। একই সাথে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে ঝরে পড়া কমানো। শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ পাঠগ্রহণ শেষ করতে পারা নিশ্চিত করা; অর্থাৎ পুরো শিক্ষাক্রম হবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। তবে প্রাথমিক ভাবে এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক কিছুটা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে দ্রুত এই বিড়ম্বনা কাটিয়ে তুলে নতুন পদ্ধতির সাথে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভ্যস্ত করিয়ে দিতে পূর্ব পরিকল্পনাও প্রস্তুত করে রাখা দরকার।
লেখক: লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মত-দ্বিমত শাকিরুল আলম শাকিল শিক্ষাক্রমের বড়সড় পরিবর্তন ও আমাদের প্রস্তুতি