ধান, চাল সংগ্রহে আমদানি নির্ভরতা কাটানো জরুরী
২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:৪১
চলমান আমন মৌসুমে ১০ লাখ টন ধান ও চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। গতবারের চেয়ে কেজিতে দাম তিন টাকা বাড়ানো হয়েছে। ধানের দাম প্রতি কেজি ৩৩ টাকা, সেদ্ধ চাল প্রতি কেজি ৪৭ টাকা ও আতপ চাল প্রতি কেজি ৪৬ টাকা দরে কেনা হবে। এছাড়া বাজারে দামসহনীয় রাখতে ৫ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি সচিবালয়ে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির বৈঠকে কেনাকাটার এই সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এবার আমরা প্রয়োজনের চেয়ে লক্ষ্যমাত্রা একটু বাড়িয়ে ধরেছি, যাতে করে সংগ্রহ করতে গিয়ে কোনও ঘাটতি সৃষ্টি না হয়। বৈঠক শেষে খাদ্য সচিব জানান, ১৭ নভেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমন মৌসুমের ধান চাল সংগ্রহ চলবে। আর আতপ চাল সংগ্রহের সময় ১৭ নভেম্বর থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত চলবে।
চলতি বছর সাড়ে ৩ লাখ টন ধান ও সাড়ে ৫ লাখ টন চাল এবং এক লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওএমএস, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। ২০২৩-২৪ সালের আমন মৌসুমে সাত লাখ টন চাল ও ধান কেনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল ২ লাখ টন ধান ও ৫ লাখ টন চাল ছিল। চার লাখ টন সেদ্ধ চাল ৪৪ টাকা ও ১ লাখ টন আতপ চাল ৪৩ টাকা কেজি দরে আর ২ লাখ টন ধান ৩০ টাকা কেজি দরে কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এদিকে সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমনের আবাদ। উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮ লাখ ৩৯ হাজার টনে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে উৎপাদিত মোট চালের প্রায় ৪০ শতাংশ আসে আমন থেকে। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরপর বন্যায় মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছেন কৃষক। বন্যায় সবশেষ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছেন ময়মনসিংহ বিভাগের কৃষক। দেশের ধান উৎপাদনের বড় একটি হাব বলা যায় ময়মনসিংহ অঞ্চলকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা— এ চার জেলায় খাদ্য উৎপাদন হয়েছিল ৪৪ লাখ ৮৮ হাজার ৯৫০ টন। বিপরীতে এ অঞ্চলে চাহিদা ছিল মাত্র ১৮ লাখ ৭ হাজার ২৩৩ টন। বাকি ২৬ লাখ ৮১ হাজার ৭১৭ টন উদ্বৃত্ত খাদ্যে পূরণ করা হয় রাজধানীসহ আশপাশের জেলাগুলোর চাহিদা। তবে সাম্প্রতিক বন্যায় এ অঞ্চলের লক্ষাধিক হেক্টর জমির আমন ধান নষ্ট হয়েছে। গত আগস্টের বন্যায় দেশের পূর্বাঞ্চলে ২৩ জেলায় ২ লাখ ৮ হাজার ৫৭৩ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; দুর্দশায় পড়েন ১৪ লাখেরও বেশি কৃষক।
কৃষি মন্ত্রণালয় বন্যার ক্ষয়ক্ষতির সবশেষ হিসেবে বলেছে, ফসলি জমি ২ লাখ হেক্টরের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ৩৭ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমি। ফলে সব মিলিয়ে কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরে বন্যাসহনশীল ধানের জাত নিয়ে কথা বলে আসছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ব্রি ধান ৫১ ও ব্রি ধান ৫২ বন্যাসহনশীল রোপা আমনের জাত। অথচ এবারের বন্যায় বন্যাসহনশীল ধানের জাতগুলো কোনও ভূমিকা রাখতে পারেনি। দেশে চাল উদ্বৃত্ত থাকা জেলাগুলোর শীর্ষে রয়েছে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঝিনাইদহ, জয়পুরহাট, শেরপুর, নওগাঁ, বগুড়া, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ভোলা। এসব জেলায় ৮০ থেকে ১৮৩ শতাংশ পর্যন্ত চাল উদ্বৃত্ত থাকে। কুড়িগ্রাম, জামালপুর, নীলফামারী, রংপুর, মাগুরা, যশোর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ ও পটুয়াখালী জেলায় ৫১ থেকে ৭৭ শতাংশ চাল উদ্বৃত্ত থাকে। গাইবান্ধা, নাটোর, টাঙ্গাইল, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় ২২ থেকে ৪৮ শতাংশ চাল উদ্বৃত্ত থাকে। রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী ও বান্দরবান জেলায় ১ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত চাল উদ্বৃত্ত থাকে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও রাঙামাটি— এ জেলাগুলোয় ৪৬ থেকে ৯১ শতাংশ পর্যন্ত চালের ঘাটতি রয়েছে। আর মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও মাদারীপুরে রয়েছে ১৯-৪০ শতাংশ চালের ঘাটতি।
এবারকার উপর্যুপরি বন্যা পরিস্থিতির কারণে চালের ঘাটতি দেখা দেবে বন্যাকবলিত জেলাগুলোতেও। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ২০ শতাংশ মানুষ। সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলে এ হার সবচেয়ে বেশি, ২৪ শতাংশ। এমনকি দেশের রাজধানী ঢাকায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার ১৭ শতাংশ। প্রতিবেদনের দাবি, দেশের সাম্প্রতিক বন্যায় কৃষি ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এর প্রভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্যসংস্থান করতে পারছে না প্রতি ১০ জনের তিনজন বা ৩০ শতাংশ। নিম্নআয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। খাদ্যব্যয় সংকোচনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ২৯ শতাংশ মানুষ। আর সার্বিক জীবন-জীবিকায় ব্যয় সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে ৭১ শতাংশ মানুষ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তথা বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বছরে দেশে চার কোটি টনের মতো চাল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে দেড় কোটি টন আসে আমন মৌসুমে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসলের ফলন কমে যাওয়ায় চালের দাম যেন আর বেড়ে না যায় তার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার শুল্ক কমিয়ে আমদানিকে উৎসাহিত ও স্থানীয় মজুদ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। গত ২০ অক্টোবর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু দৈনিক চাল গ্রহণের পরিমাণ ৩২৮ দশমিক ৯ গ্রাম। ১৭ কোটি মানুষের প্রতিদিনের হিসাব ধরে বছরে প্রয়োজন হয় প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টন চাল। শুধু ভাত হিসেবে এ চাল মানুষ গ্রহণ করে। এর বাইরে বিভিন্ন পোলট্রি ফিড, বীজসহ অন্যান্য প্রয়োজনে চাল ব্যবহার হয় আরও এক কোটি টন। সব মিলিয়ে প্রয়োজন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। কিন্তু গত বছরে উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ টন। দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল, দ্বিতীয় গম। বিভিন্ন দেশ থেকে আগে চাল আমদানি হলেও এখন তা শূন্যের কোটায় নেমেছে। বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মজুদ বাড়ানোর পাশাপাশি দামসহনীয় রাখতে শুল্ক কমিয়ে আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর পরও দেশের প্রধান খাদ্যশস্যটি আমদানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) জটিলতায় কমছে গম আমদানিও। বাজারে তাই খাদ্যপণ্য দুটির দাম ঊর্ধ্বমুখী। সরকারি হিসাবে চাল আমদানি এখন শূন্য। খাদ্য ও দানাদারজাতীয় খাদ্যপণ্য আমদানি করা হলেও গত দুই বছরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কোনও চাল আমদানি করা হয়নি বলে খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ মূলত ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানি করে। চালের সরবরাহ বাড়াতে সব ধরনের আমদানি শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া অগ্রিম আয়করও ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে নামানো হয়েছে। অর্থাৎ চাল আমদানিতে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ছাড়া আর কোন শুল্ক বা কর নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে, এর ফলে প্রতি কেজি চাল আমদানিতে খরচ ২৫ টাকা ৪৪ পয়সা কমবে। এনবিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানো, ভবিষ্যত খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ও সহনীয় পর্যায়ে রাখার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত ২০ অক্টোবর চাল আমদানির ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। অর্থাৎ মোট করভার ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এরপর গত ৩১ অক্টোবর বিশ্ববাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অবশিষ্ট আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৫ শতাংশ সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং অগ্রিম আয়করের হার ৫ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ কমিয়ে ২ শতাংশ ধার্য্য করা হয়। অর্থাৎ, মোট অবশিষ্ট করভার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এই দুই দফা কমানোর পর চাল আমদানিতে এখন মাত্র ২ শতাংশ অগ্রিম আয় কর দিতে হবে। এছাড়া আর কোনও শুল্ক-কর দিতে হবে না। আমদানিতে এসব শুল্ক-কর প্রত্যাহার ও অগ্রিম আয়কর কমানোর কারণে প্রতি কেজি চালের আমদানি খরচ কমবে ২৫ টাকা ৪৪ পয়সা। এনবিআর আশা করছে, এতে চালের আমদানি বাড়বে, বাজারে সরবরাহ বাড়বে। তাতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। একইসঙ্গে চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।
ইতোমধ্যে আবার ভারত থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৫০ হাজার টন নন-বাসমতি আধা সেদ্ধ চাল কিনছে সরকার। ভেলপুর পট্টভি এগ্রো ফুডস ৪৭৭ মার্কিন ডলারে এই চাল বিক্রি করবে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্য মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র জমার মেয়াদ এর মধ্যে শেষ হয়েছে। এতে সর্বনিম্ন দর হিসেবে প্রতি টন ৪৭৭ ডলার প্রস্তাব এসেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের চাল পরিবহনের খরচও অন্তর্ভুক্ত। এই দরপত্রে ভারতীয় একাধিকসহ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের কোম্পানিও অংশ নেয়। কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৪৭৭.৭৭ ডলার থেকে ৪৯৯.৭৭ ডলার পর্যন্ত প্রতি টন চালের দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছিল। সম্প্রতি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে ৪৭৭ ডলার দরে ভেলপুর পট্টভি এগ্রো ফুডস থেকে এই ৫০ হাজার টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেয় কমিটি। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮৬ কোটি ২০ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় হলেও গত কয়েক বছর ধরেই খাদ্য আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে এবং এক দশক আগেও বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতার হার ছিল এক অঙ্কের ঘরে। কিন্তু ছয় বছর ধরে তা দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে। গত এক দশকে প্রতি বছর জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৬ লাখ করে। যদিও বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেশের খাদ্যশস্য চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। গবেষনা বলছে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষক পর্যায় ও নিজ জাতের কারণে প্রতি বছর ৬৭ লাখ টন চাল নষ্ট হয় এবং পরবর্তিতে চালের ঘাটতি মেটাতে বছরে ৩৫-৪০ লাখ টন আমদানি করতে হয়। প্রতি বছর উৎপাদন পর্যায়ে এই রকম ধান অপচয় রোধ করা গেলে চালের আমদানিনির্ভরতা কমে আসবে বলে প্রতীয়মান হয়। কৃষি অর্থনীতিবিদগন মনে করেন, চাল আমদানি মজুতের স্থিতি বাড়ানোর জন্য করা যেতে পারে যা কোনভাবেই মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশের বেশি নয় হয়। এর কারন হলো, বেশি আমদানি হলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
খাদ্যশস্যে আমদানিনির্ভরতা বাড়লেও দেশ এখন ধান চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার পর ও বাস্তবতার নিরিখে ধান চাল প্রবৃদ্ধির হার কীভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে কারন-
এক. ধানের জাতের উন্নয়ন ও মানসম্মত বীজ সরবরাহ বাড়াতে হবে তার সাথে সাথে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা একটা চ্যালেন্জ হিসাবে নিতে হবে যার সাথে ধানের উৎপাদন সম্পৃক্ত রয়েছে বাংলাদেশে জমির উৎপাদিকা শক্তি নানা কারণে কমে গিয়েছে কেবল মাত্র ভারসাম্যহীন উৎপাদন উপকরণের ব্যবহার করার কারনে।
দুই. সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ধান উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায় চাহিদা মেটাতে দেশ আমদানি নির্ভরশীল হয়ে পড়লেও কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ গত কয়েক বছর যাবত ৯ হাজার কোটি টাকা ঘুরপাক খাচ্ছে। বর্তমান বছরের বাজেটে কৃষিখাতের অংশ মোট বাজেটের মাত্র ৬.১ শতাংশ যার একটি বৃহৎ অংশ কৃষি ভর্তুকিতে চলে যাবে।
ফলে উন্নয়নখাতে তেমন কিছু থাকে না। তা ছাড়াও স্বাভাবিক ভর্তুকির অতিরিক্ত হিসাবে কৃষিজাত সামগ্রী রপ্তানির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা হারে ছাড় প্রদান, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উন্নয়ন সহায়তার হার হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলের জন্য ৭ শতাংশ করা ইত্যাদি বলবৎ রয়েছে। এ বিষয়গুলো টেকসই কৃষি উন্নয়নের মানুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর ব্যাপারেও প্রতিকারমূলক ও প্রাকৃতিক কারণগুলোর মোকাবিলায় উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে, ভাইরাসজনিত মহামারীকারীন কৃষিখাতের গুরুত্ব এবং দুর্যোগ বিবেচনায় নিয়ে সার্বিক কৃষিখাতে প্রণোদনার অর্থ বাড়িয়ে দেওয়া। বিশেষ করে যেসব ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গা চাষী আমাদের প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদন করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখছেন এবং অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন, তাদের এ প্রণোদনায় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
তিন. তথ্য বলছে, বিগত বছরগুলোতে জাতীয় বাজেটে কৃষিখাতের বরাদ্দ অবহেলিত হয়ে এসেছে এবং কৃষিখাতে ভর্তুকি অন্যান্যবারের মতো এবারেও একই অবস্থা রয়েছে। আবার ব্যাংকিংখাতের হিসাবে দেখা যায়, গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যক্তি পর্যায়ে যে বিনিয়োগ হয়েছে তা সামষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ এবং এতে কৃষিখাতের অংশ আরও কম। অথচ ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৃষি বাণিজ্যিকীকরনের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল যেখানে পরিবার ভিত্তিক চাষাবাদকে পরিহার করে খামার ভিত্তিক বৈজ্ঞানিক চাষাবাদকে (গ্রিন হাউজ) উৎসাহিত করা হয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন রুপে আবির্ভূত হয়েছে, ক্ষুদ্র প্রান্তিকচাষীরা অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেনা। বাজার ব্যবস্থাপনায় এইসব কৃষকদের কোন প্রবেশাধিকার এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি যার প্রমাণ কৃষিপন্য বিশেষত কৃষকের ধানের মূল্য না পাওয়া। যার প্রভাব পড়েছে ক্রমাগতভাবে কৃষি প্রবৃদ্ধির হ্রাসে। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানোর পাশাপাশি তাকে প্রকৃতিবান্ধবও করে তুলতে হবে। জনগনের স্বাস্থ্য, পুষ্টির সঙ্গে সমন্বয় রেখে কৃষি ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে সম্ভাব্য খাদ্য বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে। পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র এবং পারিবারিক কৃষকদের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই চাল তথা খাদ্য উৎপাদনে আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং দেশ হবে স্বনির্ভর।
লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি
সারাবাংলা/এসবিডিই