Friday 29 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকার বেওয়ারিশ কুকুরের দায়িত্ব কে নেবে?

ফারহানা হক
২৯ নভেম্বর ২০২৪ ১১:২৯

ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো বেওয়ারিশ কুকুর। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটিতে কুকুরহত্যা দেশের সচেতন নাগরিক সমাজে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। সামাজিকমাধ্যমে তুমুল সমালোচনা হয়েছে। প্রাণীপ্রেমীরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং বিচার দাবি করেছেন। কুকুর ও বিড়াল হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের পক্ষে আদাবর থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন অভিনয়শিল্পী কাজী নওশাবা আহমেদ। আদালতের মাধ্যমে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানিয়েছে সংগঠনটি।

বিজ্ঞাপন

দেশের বিভিন্ন পরিমণ্ডলের তারকারা জাপান গার্ডেন সিটির ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিনয়শিল্পী জয়া আহসান। তিনি এক ফেসবুক পোস্টে জানান, ‘ক্ষুধার্ত কুকুরকে খাবার সেধে খাওয়ালো বিষ। ছয়টি কুকুর ও একটি বিড়ালকে বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলেছে জাপান গার্ডেন সিটি বিল্ডিং কমিটির লোকজন। প্রায় ৫ বছর ধরে এটি তারা চেয়েছিল। পারেনি স্থানীয় প্রাণীপ্রেমীসহ বিভিন্ন প্রাণী কল্যাণ সংস্থার প্রতিবাদে। আজ ঘটনা ঘটিয়ে দিলো তারা।’ এর ঠিক আগের পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, ‘গণমাধ্যমের বন্ধুদের অনুরোধ করছি, বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আপনারা বরাবরের মতোই পাশে থাকুন। এই বর্বরতা মেনে নেওয়া যাবে না। এটি কেবল কুকুর হত্যা নয়, বিষ প্রয়োগে কাউকে হত্যা মানে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে মনে-প্রাণে ধারণ করা একটা সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই।’ এছাড়া প্রাণী হত্যার প্রতিবাদে জাপান গার্ডেন সিটি ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয় প্রাণীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন।

বিজ্ঞাপন

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিছুদিন আগে জাপান গার্ডেন সিটিতে বিষ প্রয়োগ করে কুকুর-বিড়াল হত্যা করা হচ্ছে বলে খবর ছড়ায়। এ সংক্রান্ত কিছু ভিডিও এবং ছবিও ভাইরাল হলে ওই রাতেই জাপান গার্ডেন সিটিতে ছুটে যান অনেকে। ঘটনা প্রসঙ্গে জানা যায়, বেশ কিছু দিন ধরে জাপান গার্ডেন সিটিতে একদল বসবাসকারী ‘জেজিজি লাইফ সেফটি’ নামের ব্যানার ব্যবহার করে বেওয়ারিশ কুকুর নিধনের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। জাপান গার্ডেন সিটির ভেতরে এ সংক্রান্ত কিছু ব্যানার-ফেস্টুন পাওয়া যায়। সেখানে লেখা ছিল– ‘সকল বেওয়ারিশ কুকুর প্রাণীপ্রেমীদের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হোক’, ‘জাপান গার্ডেন সিটির পরিচ্ছন্নতার স্বার্থে কুকুরের উচ্ছিষ্ট খাবার, মল-মূত্র কুকুরপ্রেমীদের বাসায় প্রেরণ করা হোক’, ‘বেওয়ারিশ কুকুর নিধন করো, এনজিও ব্যবসা বন্ধ করো’- ইত্যাদি।

এ বিষয়ে জাপান গার্ডেন সিটির ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সদস্যরা তখন জানান, যেটা হলো সেটির সঙ্গে আমরা একমত না। আমরা কুকুরমুক্ত এলাকা চাই, কিন্তু বিষ দিয়ে মারার পক্ষে আমরা না। সিটি করপোরেশন এসে নিয়ে যাক, এটা আমরা চাই। কারণ কুকুরের জন্য সাধারণ বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে আমাদের ওপর চাপ আছে। ফ্ল্যাট মালিক সমিতির আরেক সদস্য জানান, অনেকে অভিযোগ দেয় কুকুর নিয়ে, আমাদের কমিটি থেকে সিদ্ধান্ত দেওয়া আছে নিরাপত্তারক্ষীদের, কুকুর দেখলে বের করে দিতে। আমরা কুকুর এখান থেকে বের করে দেই। তবে আজকের ঘটনা দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেবো। আপনারা যথাযথ ব্যবস্থা নেন।

এ তো গেল জাপান গার্ডেন সিটির কথা। এর আগে গত সেপ্টেম্বরেই রাজধানীর ডেমরা এলাকায় কুকুরের আক্রমণে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় এক শিশুর। বাসার গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল পাঁচ বছরের শিশু মাহিনুর। হঠাৎ একটি বেওয়ারিশ কুকুর তার ওপর আক্রমণ করে। পরে আরও তিনটি কুকুর শিশুটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিশুটির চিৎকারে আশপাশের লোকজন কুকুরগুলো তাড়ানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে বাঁশ দিয়ে আঘাত করলে কুকুরগুলো পালিয়ে যায়। ততক্ষণে কুকুরের কামড়ে-আঁচড়ে শিশুটির মুখ-মাথা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। পরে গুরুতর অবস্থায় শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

শুধু শিশু মাহিনুর কিংবা নিহত ইজাজুলকেই নয় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কুকুরের আক্রমণের ঘটনা বাড়ছে। ২০১২ সালে উচ্চ আদালত নির্বিচার কুকুর নিধনকে অমানবিক উল্লেখ করে তা বন্ধের নির্দেশ দেয়। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কুকুরকে বন্ধ্যা (প্রজননক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া) করে তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার ঘোষণা দেয় সরকার। দুই বছর পর তাও বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০২০ সালে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রাজধানী থেকে হাজার হাজার কুকুর সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণাও থেমে যায় এক রিট আবেদনে। একদিকে কুকুর নিধনে নিষেধাজ্ঞা, অন্যদিকে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলো যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় রাজধানীতে বেড়েছে বেওয়ারিশ কুকুরের উপদ্রব। এতে কেউ কেউ প্রাণও হারাচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ২০২৩ সালে সারা দেশে ৬ লাখের বেশি মানুষ কুকুরের কামড় খেয়ে জলাতঙ্ক রোগের টিকা নিয়েছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫ লাখের সামান্য কম। এর মধ্যে শিশুদের সংখ্যা বেশি। এই দুই বছরে জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৮৬ জন। শুধু তাই নয়, ২০১২-২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে কুকুরের কামড়ে মারা গেছে ৭৭১ জন। তবে ২০১০ সালের আগে দেশে প্রতিবছর জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে আড়াই হাজার মানুষ মারা যেত। জলাতঙ্ক রোগ নির্মূলে সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা কমে এসেছে। তবে আক্রান্তের সংখ্যা কমেনি। ২০২০ সালে জলাতঙ্কের টিকা নিয়েছিলেন ১ লাখ ৫২ হাজার ১৪ জন, ২০২১ সালে ২ লাখ ৭৮ হাজার।

দেশে সংক্রামক রোগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। এই হাসপাতালে কুকুর-বিড়ালসহ বিভিন্ন প্রাণীর আক্রমণে আহত হয়ে ২০২৩ সালে চিকিৎসা নেয় ৯৪ হাজার ৩৮০ জন। ২০২২ সালে চিকিৎসা নেওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ৮৯ হাজার ৯২৮ জন। তবে এর মধ্যে সিংহভাগই কুকুরের আক্রমণে আহত হয়।

এদিকে ঢাকার রাস্তায় প্রায়ই অসুস্থ কুকুরকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এসব কুকুর শহরে ঘুরে বেড়ায়। ফলে তাদের থেকে সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। ঢাকার রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে অসংখ্য মানুষ রাত কাটায়। এই মানুষগুলো সহজে অসুস্থ কুকুরের সংস্পর্শে গিয়ে অসুখ ছড়াতে পারে। একইভাবে রাস্তার পাশে খোলা দোকানেও এসব কুকুর থেকে সংক্রামক ব্যাধি ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিডিসি ও বিভিন্ন প্রাণিকল্যাণ সংগঠনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় ১৭ লাখ কুকুর রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে আছে ৫০ হাজারের বেশি ও উত্তর সিটিতে আছে ৪০ হাজার কুকুর। ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিট করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বেওয়ারিশ কুকুর স্থানান্তর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। প্রাণিকল্যাণ সংগঠন ‘অভয়ারণ্য’র সভাপতি রুবাইয়া আহমেদ, পিপলস ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ারের চেয়ারম্যান রাকিবুল হক এমিল ও অভিনেত্রী জয়া আহসানের পক্ষে ব্যারিস্টার সাকিব মাহবুব এই রিট করেছিলেন। বেওয়ারিশ কুকুর নিধনে আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজধানী জুড়ে বাড়ছে কুকুরের উৎপাত ও আক্রমণের শিকার হয়ে আহতের সংখ্যা।

নগর-পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বেওয়ারিশ কুকুর শিশু ও নারীদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার যে কোনও মানুষের জন্যও কুকুর নানা সমস্যা তৈরি করছে। উন্নত বিশ্বে রাস্তাঘাটে যেখানে-সেখানে বেওয়ারিশ কুকুর দেখা যায় না। কুকুর নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সারা বিশ্বেই বেওয়ারিশ কুকুরের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণে বন্ধ্যত্বকরণ কার্যক্রম চালানো হয়। আমাদের দুই সিটি করপোরেশন এমন উদ্যোগ একাধিকবার নিলেও আর্থিক ও জনবল সংকটের কারণে তা সফল হয়নি।’

কুকুরের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণে বন্ধ্যত্বকরণের লক্ষ্যে উভয় সিটি করপোরেশন কার্যক্রম চালালেও তা ধীরগতিতে চলছে। দক্ষিণ সিটির ১০টি অঞ্চলে ৩ জন ভেটেরিনারি কর্মকর্তা ও ১০ পরিদর্শকের জায়গায় মাত্র ৩ জন রয়েছেন। এ ছাড়া অন্যান্য প্রয়োজনীয় জনবলের সংকট রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটির ১০টি অঞ্চলে কোনও ভেটেরিনারি কর্মকর্তা ও পরিদর্শক নেই। ফলে কুকুরের সংখ্যা বেড়েই চলছে।

লেখক: প্রযুক্তিবিদ, ব্যবসায়ী

সারাবাংলা/এসবিডিই

বেওয়ারিশ কুকুর

বিজ্ঞাপন

দুর্ঘটনার কবলে রিয়ালের টিম বাস
২৯ নভেম্বর ২০২৪ ১১:১৬

শীর্ষে থেকেই বছর শেষ মেসিদের
২৯ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৩১

আরো

সম্পর্কিত খবর