সোনালী ধানের দেশ, হেমন্তের মিঠে রোদ্দুরের দেশ
২৯ নভেম্বর ২০২৪ ২১:৩০
বাংলাদেশ ধানের দেশ, প্রাণের দেশ। কার্ত্তিকের কুয়াশার দেশ। নতুন ধানের পিঠার দেশ। বাংলাদেশের নতুন ধান দিয়ে প্রচলিত অনুষ্ঠানগুলোর একটি হলো নবান্ন। নবান্ন শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’ বা ‘নব অন্ন’। নবান্ন উৎসব হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত বাংলা অগ্রহায়ণ মাসে অর্থাৎ হেমন্তকালে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। মোট কথা, নবান্ন শব্দটির সাথে নতুন ধান ওঠার সম্পর্ক রয়েছে। কিষান-কিষানীদের সব হাসি-কান্নার অবসান ঘটিয়ে অগ্রহায়ণের নতুন আমন ধান ঘরে উঠানোর কাজের মাঝে খুঁজে পায় অপার আনন্দ। গ্রাম বাংলার নতুন এক আবহের সৃষ্টি হয়। নবান্ন উৎসব যেন সব দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।
নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালিদের হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি। প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মবর্ণনির্বিশেষে নবান্নকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি উৎসবে মেতে ওঠে। একে অন্যের মধ্যে তৈরি হয় সামাজিক সুসম্পর্ক, সম্প্রীতি আর ভালোবাসা। এ উৎসবকে ঘিরে সনাতনী সম্প্রদায়ের আছে নানা রকম লৌকিক পার্বণ বিধি। কার্তিক মাসের শুরুতেই কৃষকের ঘরে ঘরে নতুন ধানে পূর্ণ হতে থাকে। কৃষক-কৃষাণিরা ব্যস্ত হয়ে ওঠে সেই ধান কাটা, শুকানো, মাড়াই এবং এরপর সেই ধান ঢেঁকিতে গুঁড়া করে বহুবিধ পিঠা-পায়েস ইত্যাদি তৈরিতে। এটা যে ঋতুতে হয় সেটি হেমন্ত। প্রকৃতির রোষানলে ষড়ঋতুর যে দুই ঋতু এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে তার একটি হলো হেমন্ত। বাংলার প্রতিটি ঋতুর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট। ভিন্ন ভিন্ন রুপ। সব মিলিয়েই এই বাংলা। হেমন্তের মাঠ-ঘাট, শিশির ভেজা সকাল, মাঠের পাকা সোনালী ধান, কৃষকের ধান ঘরে তোলার দৃশ্য, ঘরে ঘরে ডোলা ভর্তি ধান, কৃষক-কৃষাণির আনন্দ সবই হেমন্তের রূপের অণুষঙ্গ। বৈচিত্র্য রূপের সাজে প্রকৃতিতে হেমন্ত বিরাজ করে। হেমন্ত ঋতুতে চলে শীত-গরমের খেলা। হেমন্তের শুরুতে এক অনুভূতি আর শেষ হেমন্তে অন্য অনুভূতি। ভোরের আকাশে হালকা কুয়াশা, শিশিরে ভেজা মাঠ-ঘাট তারপর ক্রমেই ধরণী উত্তপ্ত হতে থাকে। বাংলার চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ীই এদেশ ষড়ঋতুর দেশ। পালা করে প্রকৃতি একে এক তার ছয়টি রুপ আমাদের সামনে আনে। আমরাও অপেক্ষায় থাকি দুই মাস অন্তর অন্তর ঋতুর পালাবদলের। বাংলাদেশের বেশিাংশ অনুষ্ঠানই এক সময় ছিল ঋতুভিত্তিক। এখনও আছে। আর আছে বলেই বাঙালি বারো মাসে তেরো পার্বন পালন করে। একই ধানের বহুমুখী ব্যবহার দেখা যায় এই বাংলায়।
নবান্ন এলেই আমাদের স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে গ্রাম বাংলায় এক সময় ব্যাপক ব্যবহার করা ঢেঁকির কথা। কারণ ধান ভানতে ঢেঁকিই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। সময়ের পরির্তনের সাথে সাথে গ্রামীণ ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি পাল্টে যাচ্ছে বিজ্ঞানের ছোয়ায়। সেই পরিবর্তনের হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়কার অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ ঢেঁকি। এখন আর কোন বিশেষ উৎসব বা ধান ভানার জন্য শোনা যায় না সেই শব্দ। সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে ঢেঁকি অনেক হারানো জিনিসের পাতায় স্থান পেয়েছে। অথচ একসময়কার আবশ্যকীয় যন্ত্রের নাম ছিল ঢেঁকি। গুটিকতক বাড়িতেই আজও টিকে আছে এই ঢেঁকি। অথচ এক সময় ছিল যখন ঢেঁকি গ্রামের মানুষের প্রতিটি বাড়িতে ছিল। গাব গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি করা ঢেঁকি ছিল টেকসই। শীতকাল এলেই বাড়িতে বাড়িতে ঢেঁকি পার দেওয়ার শব্দ কানে ভেসে আসতো। বাড়ির বধূদের দিন কেটে যেত নতুন ধানের চাল গুঁড়া করায়। পরিবারের নারীরা সেসময় দৈনন্দিন ধান, গম ও যব ভাঙার কাজ ঢেঁকিতেই করতেন। পাশাপাশি চিড়া তৈরির মত কাজও ঢেঁকিতেই করতো। বিশেষ করে বাংলার বিশেষ উৎসব যেমন ঈদ, পূজা, নববর্ষ বা পৌষের পিঠা পার্বণ সব অনুষ্ঠানেই বাড়িতে বাড়িতে দেখা যেত ঢেঁকির ব্যাবহার। ঢেঁকিতে ধান ভানতে কমপক্ষে তিনজন মানুষের দরকার হয়। এক বা দু’জন একসাথে পা দিয়ে পেছনের অংশে চাপ দেয় আর সামনে থাকা একজন মুখের গর্ত থেকে ঠিক সময়ে গুঁড়া তুলে নেয় এবং দেয়। এতে সামান্য ভুল হলে বিপত্তি ঘটতে পারে। ঢেঁকির জন্য আলাদা একটি ঘরও থাকতো। সেই ঘরের নাম ছিল ঢেঁকি ঘর।
সে সময় গ্রামের বধুদের ধান ভাঙার গান আর শব্দ ছন্দের মত সারা গ্রামে ছড়িয়ে পরতো। সেই শব্দ আজ আর ভেসে আসে না। ঢেঁকির শব্দের সাথে সাথে গানেরও প্রচলন ছিল। তার বদলে চালকলের কান ফাটানো আওয়াজ শোনা যায়। অল্প সময়েই অনেক চাল গুঁড়া করা যায় এসব কলকারখানায়। সেসময় নিজ বাড়ির ধান ভানার কাজ করার পাশাপাশি ধনীদের ধান ভানার কাজ করে বাড়তি আয় রোজগারও করতো। ঢেঁকিতে ভাঙা চাল ছিল সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। বাংলা গল্প গানেও ঢেঁকির উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু ধান গম ভাঙা যন্ত্র আবিষ্কার হওয়ায় ঢেঁকি আজ প্রায় বিলুপ্ত। ক্রমেই গ্রাম বাংলা থেকে ঢেঁকি হারিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রবাদ আজও টিকে আছে এই ঢেঁকিকে কেন্দ্র করে। কথায় বলে আমড়া কাঠের ঢেঁকি। যদিও এই কাঠ দিয়ে কোনওদিন ঢেঁকি তৈরি করা হয়নি আর করা যায়ও না। আর ধান ভানতে শিবের গীত- এ তো প্রচলিত কথা। তবে এই ধান ভানা শব্দটি এসেছে ঢেঁকি ব্যবহারের কারণেই। হেমন্ত ঋতুতেই বাড়িতে বাড়িতে ঢেঁকির শব্দ বেশি শোনা যেতো।
আমাদের জীবনযাত্রায় ঋতু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের ফসল উৎপাদন এবং ঋতু নির্ভর ফল ঋতু বদলের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ঋতু বদলের সাথে সাথে প্রকৃতি ভিন্ন বৈচিত্রে হাজির হয়। প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সাথে আমাদের মনেও বৈচিত্র্য আসে। প্রিয় ঋতুর তালিকায় ভিন্ন মত আছে। তবে সৌন্দর্যের তালিকায় হেমন্তের আলাদা কদর রয়েছে। কারণ হেমন্ত হলো নবান্ন উৎসবের ঋতু। নতুন ধানে ঘরে ঘরে পিঠা-পুলি-পায়েস তৈরির ধুম এই ঋতুতেই শুরু হয়। সারা বছরের মহাজনের কাছ থেকে ধার নেওয়া পাওনা পরিশোধের সুযোগ হয় ফসল ঘরে ওঠার পরেই। সারা বছরের মুখের অন্নের যোগানও আসে এ সময়। হেমন্ত তাই সুখ-সমৃদ্ধির কাল। তাই মুখের হাসিটা অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশিই থাকে কার্তিকের নবান্নের দেশের মানুষের।
হেমন্ত এলে পাল্টে যায় প্রকৃতি ও মানুষ। গ্রামের পরিবেশে আনন্দ বিরাজ করে। গ্রাম্য মেলা, ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস বানানোর আয়োজন, ঢেঁকির শব্দ সব মিলিয়ে এক অন্যরকম প্রকৃতিকে বরণ করে নেয় হেমন্তে। হেমন্তের এই নবান্ন উৎসব আমাদের একটি ঐতিহ্য। সেই অতীত কাল থেকেই গ্রাম বাংলায় ধুমধামের সাথে পালন করা হয়ে থাকে। এই উৎসব ঘিরে গ্রামে বিরাজ করে আনন্দ। একসময় যাত্রাপালা, গান নিয়ে মেতে থাকতো এই সময়। এখন সময়ের সাথে সাথে এসব ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। যেভাবে হেমন্ত ঋতুই প্রায় হারিয়ে গেছে। সেভাবেই নবান্ন উৎসবের কথাও কেবল বইয়ের পাতায় লেখা থাকবে। বইয়ের পাতায় লেখা থাকবে ঢেঁকির কথা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই