উচ্চশিক্ষিত বেকারের চাপ মোকাবিলায় কী করবে সরকার
৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১১:০৪
শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এতে বলা হয়েছে, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার, যার মধ্যে ১৬ লাখ ৯০ হাজার পুরুষ আর ৯ লাখ ৪০ হাজার নারী। এই সময় বেকারত্বের হার ৩.৬ শতাংশ অথচ পাঁচ বছর আগে ২০১৬-১৭ সালে সংখ্যাটি ছিল ২৭ লাখ। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটে যেখানে বেকারত্বের হার বেড়েছে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ চলাকালীন অনেকেই কর্মস্থল থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে, বর্তমানেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের পরিপরিপ্রেক্ষিতে কর্মসংস্থানে স্থবিরতা বিরাজ করছে, সেখানে বিবিএসের জরিপ যে বাস্তবতার সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্য, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে এই জরিপ করার জন্য পুরো দেশকে ১ হাজার ২৮৪টি প্রাথমিক গণনা এলাকায় ভাগ করা হয়, প্রতি এলাকা থেকে ২৪টি খানা নির্ধারণ করা হয়, প্রতি তিন মাসে ৩০ হাজার ৮১৬টি খানা আর সারা বছরে ১ লাখ ২৩ হাজার ২৬৪টি খানা থেকে তথ্য নেয়া হয় এবং ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর এই জরিপ চালানো হয়।
আইএলও, বিশ্বব্যাংক, কমনওয়েলথের হিসাব মতে, এক দশকে বেকারত্বের হার বেড়েছে ১.৬ শতাংশ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, এদের মধ্যে মাত্র ৭ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়, এর মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার রয়েছে। দেশের একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার প্রায় পৌনে এক কোটি, প্রতি বছর এর সঙ্গে বেকারদের নতুন তালিকা যুক্ত হচ্ছে। পরিসংখ্যানগত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় মাধ্যম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এসব প্রতিষ্ঠান শতকরা ৯৫ ভাগ কর্মসংস্থান করে, এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান করছে পোশাক শিল্প। এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ লোক কাজ করছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো কর্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না দেশের প্রচলিত শিক্ষা। এজন্য দিন দিন শিক্ষিত ও তরুণ বেকারের চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকার আশঙ্কাজনক। ফলে সম্ভাবনাময় এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে হতাশা এবং দেশ বঞ্চিত হচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনমিতির সুবিধা থেকে। বিআইডিএস, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) বিভিন্ন সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষিত তরুণরা বেকার থাকায় রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি সম্পদের অপচয় হচ্ছে। ফলে দক্ষতা বাড়ানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার মান বাড়িয়ে বাস্তব কাজের সঙ্গে সংযুক্ত করার এখনই সময় যা বর্তমান। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক বলেন, শিক্ষিত ও তরুণ বেকার বাড়ানোর বিষয়টি উদ্বেগজনক। কেননা যারা শিক্ষিত তারা যে কোনও কাজ করতে পারেন না। তারা চান প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা শোভন কাজ। কিন্তু আমাদের দেশে ৮৫ শতাংশ কর্মসংস্থানই অপ্রাতিষ্ঠানিক। এখানে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা কম। ফলে তারা বেকার থাকছেন। দেশের শিক্ষাকর্মের বাজারের চাহিদা উপযোগী নয়। ফলে এখানে একটা মিস ম্যাচ আছে। কিন্তু শিক্ষার হার বাড়ছে, ফলে শিক্ষিত বেকার বাড়তেই থাকবে। এজন্য শিক্ষাকে বাস্তবমুখী করা দরকার। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, যারা শিক্ষা গ্রহণ করছে তারা তো ব্যক্তিগতভাবে অনেক খরচ করছে। আবার তাদের পেছনে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ আছে। যখন এসব শিক্ষার্থী বেকার থাকছে তখন উভয় বিনিয়োগই অপচয় হচ্ছে।
চলতি বছরের ২৪ মার্চ প্রকাশিত বিআইডিএস’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা এ দেশে যে শিক্ষা দেওয়া হয় সেগুলো বাস্তবতা কিংবা কর্মের সঙ্গে সংযোগ নেই। শিক্ষিত বেকার সংখ্যার মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার তিন বছর পরও শিক্ষার্থীদের ২৮ শতাংশ বেকার থাকছেন। বিশেষ করে যারা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস, লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনা, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং বাংলার মতো বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন। এদিকে যুবকদের মধ্যে ৮ শতাংশ বেকার, যা জাতীয় বেকারত্ব হারের দ্বিগুণ। এদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। তাই বলা যায় উচ্চশিক্ষা চাকরির মানদণ্ড নয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বেকার বেশি থাকার কারণ হলো, কারিকুলামে দক্ষতার অভাব, ইংরেজির ঘাটতি ইত্যাদি। জানতে চাইলে বিআইডিএস’র গবেষণা ফেলো ড. বদরুন নেসা আহমেদ বলেন, বিবিএস বলছে দেশের বেকার রয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। এই মোট বেকারের মধ্যে আবার শিক্ষিত বেকার ১২ শতাংশ। এই সংখ্যাটি কম নয়। আমরা গবেষণা করেছি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ওপর। সেখানেও শিক্ষিত বেকার থাকার চিত্র উঠে এসেছে। এটা অবশ্যই দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। কেননা যারা শিক্ষা শেষ করেও ৫, ৬, ৭ বছর চাকরি বা কোনও কাজ পাবেন না, তারা কী করবেন? চুরি, ডাকাতি ছিনতাইসহ নানা সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারেন। নারী হলে বিয়ে দিয়ে অন্যের আয়ের ওপর চলতে পারেন। কিন্তু আমাদের সমাজ বাস্তবতায় পুরুষের জন্য এটা খারাপ অবস্থা। পাশাপাশি হতাশায় ডুবে অনেক সময় নেশায় আসক্তিসহ আত্মহত্যার প্রবণতার সৃষ্টি হতে পারে। যেটি এখন লক্ষ করা যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, আমাদের কারিকুলাম কারিগরি শিক্ষা বা কর্মমুখী শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ফলে এখান থেকে লেখাপড়া শেষ করে অনেকেই বেকার থাকেন। তবে আমরা এখন কারিকুলাম পরিবর্তনের কাজ করছি। অর্থাৎ অনার্স মাস্টার্সের পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক কারিগরি শিক্ষার ওপর একটি সাবজেক্ট পড়তে হবে। এছাড়া ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিসহ শিক্ষার্থীদের দক্ষতা এবং শিক্ষার মান বাড়ানোর নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর প্রভাব বা ফলাফল শিগগিরই পড়তে শুরু করবে।
মানসম্পন্ন কারিগরি উন্নয়নের একমাত্র শক্তি এবং এজন্য শুধু কারিগরি শিক্ষার আধুনিকায়ন নয়, সরকারের কাছে অংশীদারত্বমূলক সংস্কার কমিটি তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। , শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নতি করতে না পারলে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আবার শিক্ষা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নও যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারবে না। কারিগরি শিক্ষাকে মূল ধারার শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। কেননা বর্তমানের গৎবাঁধা শিক্ষা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৭ সালে এর হার ছিল ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, সেটি বেড়ে ২০২২ সালে হয়েছে ১২ শতাংশ। এই ৫ বছরে স্নাতক পাশ করা বেকারের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৭ সালের হিসাবে এ সংখ্যা ছিল ৪ লাখ, ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ লাখে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কর্মে নিয়োজিত জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ অর্থাৎ ৪৭ দশমিক ১ শতাংশ বেসরকারি বা যৌথ উদ্যোগের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এরপর ২০ দশমিক ৭ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ খানাভিত্তিক (পরিবার) প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত। শুধু ৫ দশমিক ৫ শতাংশ কর্মচারী সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। এদিকে খানাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক অর্থাৎ ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ মহিলা। এরপর যৌথ উদ্যোগ বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ২৯ দশমিক ২ শতাংশ মহিলা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ মহিলা। তবে সবচেয়ে বেশি পুরুষ কাজ করেন বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আছেন ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ এবং খানাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ১৪ দশমিক ২ শতাংশ মহিলা।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট বলেন, বাংলাদেশ যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টে (তরুণ জনগোষ্ঠীর আধিক্য) আছে। এটি সাময়িকভাবে এখনও চলছে। আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্যে এটি শেষ হয়ে যাবে। তরুণ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে এ সময়ের মধ্যে ব্যবহার করা না গেলে পরে এই সুযোগ আর আসবে না। শিক্ষিত তরুণরা বেকার থাকার ফলে নিজের জন্য কিছু আয় করতে পারছে না। পাশাপাশি রাষ্ট্রের জন্যও কিছু দিতে পারছে না। দুই ক্ষেত্রেই কোনও ফল আসছে না। ফলে এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট সুযোগের অপচয় ঘটছে। এছাড়া শিক্ষিত ও তরুণ বেকাররা সামাজিকভাবে ঝুঁকি তৈরি করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ৫৭টি (২০২১ সাল পর্যন্ত ৫০টি) সরকারি এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ২০২১ সালে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ছিল ৪৪ লাখ ৪১ হাজার ৭১৭ জন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল আরও বেশি ৪৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৬। করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার্থী কমে গেছে। তবে শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়ন করছেন প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজার শিক্ষার্থী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন প্রায় ৩ লাখ ৪২ হাজার জন। এর মধ্যে ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যয়ন করছেন ১ লাখ ২৯ হাজার শিক্ষার্থী। এসব সরকারি-বেসরকারি, অধিভুক্ত, অঙ্গীভূত বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষ করে বের হয়। কিন্তু তাদের সেই শিক্ষা কতটা বাস্তব কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে সেই তুলনায় তো কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সেখানে যারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে তারাই চাকরিতে প্রবেশ করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে যারা শিক্ষিত তারা কোথাও না কোথাও কিছু না কিছু করেই থাকে। একেবারেই বেকার বসে থাকে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় এত কলেজ যে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা করাটাও কঠিন।
আমার মনে হয় এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাববার সময় এসেছে এবং বর্তমান সরকার তাদের সংস্কার কর্মসূচিতে প্রাধিকারের মধ্যে রাখবে এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক: গবেষক ও শিক্ষাবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই