সারাবাংলার অষ্টম বর্ষে পদার্পন ও আগামীর চ্যালেঞ্জ
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:৪৪ | আপডেট: ৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ২১:০২
সত্যের সন্ধানে দুর্বার; সত্য প্রকাশে নির্ভীক/সত্যকে আঁকড়ে ধরে, পাড়ি দেই দুর্গম চারদিক/আমি অনিয়ম-দুর্নীতির যমদূত; সুহৃদ অসহায় নিপীড়িতের/আমি নিমেষেই ডুবাই মিথ্যের বেসাতি; আলো জ্বালি সত্যের/ন্যায়-নীতিতে অটল আমি; নিত্য ভাঙ্গি পরাধীনতার শৃঙ্খল/সমাজ গড়ার কারিগর আমি, লক্ষ্যে আছি অবিচল… এমনি হাজারও প্রত্যয়ে অটুট থাকার অঙ্গীকারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ও বৈষম্যহীন উন্নত এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংগ্রামে জনগণের নিরন্তর সহযোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সারাবাংলা ডটনেট সপ্তম বর্ষ অতিক্রম করে অষ্টম বর্ষে পদার্পন করলো আজ।
সারাবাংলা ডটনেট নিজস্ব স্বকীয়তায় প্রতিযোগিতাপূর্ণ মিডিয়া জগতে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, মুক্তচিন্তা ও মত প্রচারের একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল ২০১৭ সালে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে সপ্তম বর্ষ অতিক্রম করেছে জননন্দিত ‘সারাবাংলা’ পোর্টালটি।
কারও কাছে মাথা না নুইয়ে দৃঢ়ভাবে পথ চলার শপথ নিয়ে জন্ম নেওয়া এ পোর্টালটি দীর্ঘ ৭ বছরের পথপরিক্রমায় হয়ে উঠেছে আগের চেয়ে আরও বেশি সুসজ্জিত ও মননশীল এবং জনগণের সংগ্রামে নিরন্তর প্রকৃত সহযোদ্ধা। যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে এ পোর্টালটি আত্মপ্রকাশ করে, সময়ের আবর্তে তা এখন হয়ে উঠেছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য ও গণমুখী। নানা প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে সারাবাংলা ডটনেট নিজের জায়গা করে নিয়েছে পাঠকের হৃদয়ে। অন্যায়, অসত্য আর অসুন্দরের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে পাঠক নন্দিত এ পোর্টালটি হয়ে উঠেছে আপামর মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।
বিগত ৭ বছরে সারাবাংলা ডটনেট এ দেশের মাটি ও মানুষের কথা বলতে সবসময় সচেষ্ট থেকেছে। পোর্টালটির রিপোর্টিং, সম্পাদকীয়, ফিচার এবং সাহিত্যে ‘মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জনগণের লড়াই-সংগ্রাম এবং জনগণের প্রত্যাশাকে’ তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত দক্ষতায়। জনগণের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের বীরত্বগাথা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে সবসময়।
বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক নানা টানাপড়েনেও বস্তুনিষ্ঠতা, মতাদর্শ ও ন্যায়বোধের আদর্শ থেকে সামান্য বিচ্যুতি ঘটেনি- সময়ের সাহসী এ কণ্ঠস্বরের। জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি মতাদর্শের প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সগৌরবে রয়েছে অবিচল অবস্থানে। খবরের গুণগতমান ধরে রাখার ক্ষেত্রে কারও সঙ্গে কখনো সামান্য আপস করেনি। নতি স্বীকার করেনি কোনো অপশক্তির কাছে। আর তাই প্রচার সংখ্যায় সর্বশীর্ষে অবস্থান না করেও মর্যাদার সোনালি পালক যুক্ত করে নিয়েছে জনগণের সংগ্রামে আত্মগৌরবের নিজ মুকুটে। যা পাঠককুলের দুর্নিবার আকর্ষণের উৎস হয়ে উঠেছে।
টানা প্রায় দুই বছর করোনা মহামারির ভয়াবহ প্রকোপ এবং নানা প্রতিকূলতায়ও সারাবাংলা ডটনেট এখনো নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে। যা অনেকটাই সম্ভব হয়েছে পোর্টালটির শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও নিরন্তর সহায়তা; সাংবাদিক, সংবাদকর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা এবং অগণিত পাঠকের অকুণ্ঠ ভালোবাসায়।
সারাবাংলা ডটনেট সবসময় পাঠকের কথাই বলবে। পাঠকের আকাঙ্ক্ষাকেই তুলে ধরবে পত্রিকার পাতায় পাতায়। জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির সব অর্জনকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে সবসময়ই থাকবে অগ্রণী ভূমিকায়।
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ
গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। অপর তিনটি স্তম্ভ হচ্ছে, আইনসভা, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ। বোঝাই যাচ্ছে গণমাধ্যমের গুরুত্ব ও অবস্থান কোথায়! জনস্বার্থ অভিমুখী মুক্ত গণমাধ্যম ছাড়া একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পূর্ণতা পায় না। সরকার ও প্রশাসনের অসঙ্গতি ধরিয়ে দেওয়াসহ জনগণের সংগ্রামের সহযোদ্ধা হিসেবে গণমাধ্যমকে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হয়।
আসলে গণমাধ্যম হচ্ছে জনগণের সংগ্রামের সহযোদ্ধা, নীতি-আদর্শের যৌথ প্রচারক ও যৌথ আন্দোলনকারী, জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রের পাহারাদার। গণমাধ্যমই সঠিক পথ বাতলে দেয় যাতে সরকার, প্রশাসন ও জনগণ সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে। গণমাধ্যম সরকার, প্রশাসন ও জনগণের প্রতিপক্ষ নয়; তবে জনস্বার্থে নজরদারী করবে। কাজেই বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী গণমাধ্যম ছাড়া জনস্বার্থের রাষ্ট্রব্যবস্থা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে না।
রাষ্ট্রের অন্য তিনটি স্তম্ভ নড়বড়ে হয়ে গেলেও চতুর্থ স্তম্ভ শক্ত থাকলে রাষ্ট্রকে গণমুখী রাখা যায়। আর চতুর্থ স্তম্ভ নড়বড়ে হলে রাষ্ট্রব্যবস্থা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, রাষ্ট্র বিপদগ্রস্ত হয়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব আশাবাদী মানুষ। আঁধার কেটে নিশ্চয়ই আলো আসবে। কিন্তু সেটা কি প্রকৃতির নিয়মে হবে? কাউকে না কাউকে ভূমিকা পালন করতে হয়।
সাংবাদিকতায় ঝুঁকি থাকবেই। সজাগ ও সচেতন থাকলে সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিকরা হারিয়ে যাবেনা। সাংবাদিকতার ডিকশনারি থেকে সততা ও পেশাদারিত্ব শব্দ দুটি কখনই বিলীন হবে না। সেখানে অসৎ আর হলুদ সাংবাদিকতার স্থান নেই।
একটু খেয়াল করলে দেখবেন, হলুদ সাংবাদিকতার ভয়ে মানুষ তটস্থ। হলুদ সাংবাদিকদের কারণে এখন প্রবাদটির নতুন সংস্করণ হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, হলুদ সাংবাদিকরা ছুঁলে ৭২ ঘা। কেউ বিশ্বাস করুন বা না করুন পরিস্থিতিটা এমনই দাঁড়িয়েছে। অনেকে বলেন, হলুদ সাংবাদিকদের দাপট অনেক বেশি। যদিও পেশাদার ও সৎ সাংবাদিকরাই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান ও আদর্শিক।
পেশাদার ও সৎ সাংবাদিকরাই টিকে থাকবেন। যারা টিকে আছেন তাদের অভিবাদন জানাই। তারা সত্যি সত্যিই এই পেশাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন।
আমার মনে হয়, সৎ ও পেশাদার সাংবাদিকরা সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকবে। যারা নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে ব্রত হিসেবে নিতে চান তারাই টিকে থাকবেন। সবাইকে দিয়ে এই কাজ হবে না।
এ কথা এ কারণে বলছি যে, সততা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্ব ছাড়া সুসাংবাদিকতা হয় না। আগে মনেপ্রাণে এই তিনটি বিষয় ধারণ করতে হবে। সাংবাদিকতা পেশার সামগ্রিক স্বার্থেই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলেই লিখে দিতে হবে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভালোভাবে যাচাই করতে হবে। একজন রিপোর্টারের কলমের খোঁচায় অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে। আবার অনেক বড় উপকারও হতে পারে। মানুষের উপকারের বিষয়টিই আমাদের মাথায় রাখতে হবে। দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গল সাধনই তো সাংবাদিকদের কাজ।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আজ থেকে ৫৩ বছর আগে একটি রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর সেই বিজয়ের ৫৩ বছর পূর্তিতে আমরা নতুন ভাবনা, নতুন পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি। আমরা বিশ্বাস করি, মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা বুকে ধারণ করে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে উন্নয়নের অভিযাত্রায় এগিয়ে নিতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে চাই। আমরা অবহেলিত, শোষিত-বঞ্চিত আর নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের পাশে থাকতে চাই। আমরা সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে চাই। আমরা কোনো অন্যায়ের কাছে কিংবা কোনো অপশক্তির কাছে মাথানত করতে চাই না।
আমাদের স্লোগান হচ্ছে, সততাই শক্তি, পেশাদারী সুসাংবাদিকতায় মুক্তি। এটিই আমাদের বিশ্বাস, আমাদের আদর্শ। এর বাইরে আমাদের অন্য কোনো নীতি-আদর্শ নেই।
আমরা জানি, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথ আমাদের পাড়ি দিতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত আছি। আমরা ভাঙবো কিন্তু মচকাব না। আমরা হোঁচট খাব কিন্তু আমরা থেমে যাব না। আমাদের এই অভিযাত্রায় সংগ্রামী মানুষের সহযোগিতা চাই।
আমার বিশ্বাস, এই দেশকে যারা ভালোবাসেন, এই দেশের যারা মঙ্গল চান, তারা নিশ্চয় সারাবাংলার এই অগ্রযাত্রায় পাশে থাকবেন।
আগামীর চ্যালেঞ্জ
সাংবাদিকতার গৌরবোজ্জ্বল সময়ের কথা বলতে গেলে সাধারণত ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতার সংগ্রাম ও ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়কেই বোঝানো হয়। অথচ, বর্তমান সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে তখনকার গণমাধ্যম একেবারেই তার প্রাথমিক অবস্থায় ছিল। সে সময় কোনো বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল অথবা রেডিও স্টেশন না থাকায় এ ক্ষেত্রে সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। স্বাধীন গণমাধ্যম বলতে শুধু সংবাদপত্র ছিল। আর সেটাও পাকিস্তান আমলে মূলত ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ও ‘সংবাদ’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। বলাই বাহুল্য, সারাবিশ্বের মানুষের তখনো ইন্টারনেট, অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যম অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না।
তবে, গণমাধ্যমের সংখ্যা, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষিত জনসম্পদ অথবা পুঁজির অভাব থাকলেও আমরা সে ঘাটতি প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে পূরণ করেছি। পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জন্মলগ্ন থেকেই সাংবাদিকতা সম্পূর্ণভাবে আমাদের ভাষার অধিকার, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক-সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকেছে। প্রকৃতপক্ষে, সে সময় স্বাধীন সাংবাদিকতা বলতে যা সম্ভব ছিল; তা জাতিগত নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চণার বিরুদ্ধে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত গণস্বার্থের ‘দলীয়’ সাংবাদিকতা। আমরা মতাদর্শ ও ন্যায়বোধের সেই পক্ষপাতের বিষয়ে ভীষণভাবে গর্বিত। এর ওপর নির্ভর করছিল আমাদের আত্মমর্যাদা সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে টিকে থাকা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। কিন্তু সাংবাদিকতা পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়ার আগেই দেশের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড, সামরিক শাসন ফিরে আসা এবং ১৯৯০ সাল পর্যন্ত রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে আমাদের সাংবাদিকতা কঠোর প্রতিবন্ধকতা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। আমাদের সংগ্রামী ভূমিকায় ফিরতে হয়েছে।
আব্রাহাম লিংকনের ভাষায়, ‘গভর্নমেন্ট অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’ অর্থাৎ জনগণকে নিয়ে, জনগণের দ্বারা গঠিত ও জনগণের কল্যাণে নিবেদিত সরকারের জন্য আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকি।
আধুনিক সাংবাদিকতা মানে গণস্বার্থের রাজনীতি-অর্থনীতি-সামগ্রিক উন্নয়ন সাংবাদিকতা, বাংলাদেশে নতুনমাত্রায় সাংবাদিকতার বিকাশ শুরু হয় ‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে। যখন গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার নিমিত্তে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসেন এবং জাতীয় সংসদ দেশের নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা শুরু করে, তখন থেকে।
১৯৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত, গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে অনেক সংবাদপত্র, সাপ্তাহিক পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের যাত্রা শুরু হয়েছে। তবে, সার্বিক গুণগত মানের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকা থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে ৫০২টি দৈনিক এবং ৩৪৮টি সাপ্তাহিক পত্রিকা। যা সম্ভবত বিশ্বের যেকোনো শহরের চেয়ে বেশি। অসংখ্য পত্রিকার অস্তিত্ব মানে অনেক পাঠক, সংবাদের জন্য অনেক সূত্র এবং নিজ নিজ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শ্রেণির প্রেক্ষাপটে অনেক মানুষের তথ্যের অবাধ প্রবাহে অংশগ্রহণ। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। চীনা বিপ্লবের কিংবদন্তী মহানায়ক কমরেড মাও সে-তুংয়ের ভাষায়, আসলেই কি ‘হাজার ফুল’ ফুটেছিল, নাকি বিষয়টা এরকম, অনেকগুলো গাছ থেকে একই অথবা একই ধরনের ‘ফুল’ ফুটেছে, সেটা অনুধাবন করতে হবে।
আমাদের বিজ্ঞাপনের বাজার এই সুবিশাল মুদ্রিত গণমাধ্যম খাতের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য মোটেই পর্যাপ্ত নয়। সহায়তার জন্য সরকারি উদ্যোগও নেই। দীর্ঘ সময় ধরে প্রকাশনা চালিয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট আর্থিক সক্ষমতা এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ স্বত্বাধিকারীর নেই। তবে, এ ক্ষেত্রে সরকারি বিজ্ঞাপনের জগত উন্মুক্ত আছে, যার রয়েছে নিজস্ব শক্তিমত্তা ও দুর্বলতা এবং সেইসঙ্গে আমলাতান্ত্রিক ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা।
এ ক্ষেত্রে, স্বভাবতই, যে প্রশ্নটি সামনে আসে এবং যে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ পর্যায়ের স্বচ্ছতা অবলম্বন করা উচিত। তা হলো, এতগুলো সংবাদপত্রের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা কী? যদি এ ক্ষেত্রে মালিকের যথেষ্ট আর্থিক সক্ষমতা না থাকে, সরকারি বা বেসরকারি বিজ্ঞাপন না থাকে, তাহলে কীভাবে এই পত্রিকাগুলো নিজেদের টিকিয়ে রাখছে? অনেক বছর আগে তথ্য মন্ত্রণালয় ঢাকার সংবাদপত্রগুলোর ওপর একটি সমীক্ষা চালায় এবং জানতে পারে, তাদের অনেকেরই নিজস্ব কোনো কার্যালয় নেই; তারা অন্যদের সঙ্গে জায়গা ভাগ করে চলছে। অনেকগুলো পত্রিকার ঠিকানা একই এবং অনেকের কোনো কার্যালয়ই ছিল না। উপরে আমি যে লুকিয়ে থাকা গল্পের কথা বলেছি, তার একটি সূত্র এখানে দেখতে পাচ্ছি।
বেতন ভাতার একটি বাধ্যতামূলক ওয়েজ বোর্ড থাকার পরও, নিরীক্ষা থেকে জানা গেছে, হাতেগোনা কয়েকটি গণমাধ্যম ছাড়া কেউ ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী বেতন বা তার কাছাকাছি পরিমাণ অর্থও কর্মীদের দেয় না। তারপরেও কয়েক বছর পর পর নতুন ওয়েজ বোর্ড করা হয় এবং অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানকে এটি মেনে চলতে বাধ্য করা হয়। এই নীতি কি মানসম্পন্ন সাংবাদিকতায় সহায়তা করছে?
দেশে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা সম্ভবত ৫০ ছাড়িয়েছে এবং কর্মীদের বেতন ও বিনিয়োগের দিক দিয়ে এই খাতের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো। তাদের সমস্যা হচ্ছে, যথেষ্ট পরিমাণ বিজ্ঞাপন না পাওয়া এবং মাসিক সাবস্ক্রিপশন মডেলের মাধ্যমে দর্শকদের কাছে না পৌঁছাতে পারা। এই খাত এখনো পুরোপুরি ক্যাবল অপারেটরদের কুক্ষিগত।
কিছু অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, আমাদের অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। এই মুহূর্তে ২৬২টি নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল আছে, যার মধ্যে আছে প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রগুলোর ওয়েবসাইট।
এ ছাড়া, দেশে অনেকগুলো বেসরকারি এফএম রেডিও স্টেশনও আছে।
সংখ্যার দিক থেকে গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও গুণগত মানের বিষয়টি একটি গুরুতর প্রশ্ন হিসেবে সামনে আসছে, যা আগে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমার দৃষ্টিতে, গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে সরকার, মালিক ও এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার মনে একটি মৌলিক বিভ্রান্তি রয়েছে। এই বিভ্রান্তি থেকে গণমাধ্যমের শীর্ষ পদের ব্যক্তিরাও মুক্ত নন।
সরকারের ক্ষেত্রে, নতুন গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণমাধ্যম যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়, সেগুলোই আমাদের সামনে এসেছে; হয়তো অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রবলভাবে। গণতন্ত্রের জন্য আমাদের সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অল্প কয়েক বছর বাদ দিয়ে গণতন্ত্র চর্চার অভিজ্ঞতা মাত্র ৩৮ বছরের। অভিজ্ঞ গণতান্ত্রিক সরকারের তুলনায় আমাদের দেশসহ অন্যান্য নতুন গণতান্ত্রিক দেশের সরকার সমালোচনা সহ্য করতে চান না। সুনির্দিষ্ট করে সরকারের কাজের ত্রুটি বা দুর্বলতা ধরিয়ে দিলেও, তা সংশোধন না করে অতিমাত্রায় শঙ্কিত হয়ে তীব্র প্রতিক্রয়া দেখান। তারা সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুষ্ঠু প্রক্রিয়া হিসেবে সমালোচনার ভূমিকা একেবারেই বুঝতে চান না। সময়ের প্রবাহে এ ধরনের গণতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে এবং তারা শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়। গণমাধ্যমকেও একই দৃষ্টিতে চিহ্নিত করেন, তথ্যভিত্তিক সংবাদ প্রকাশ করা সত্ত্বেও। প্রথমে গণমাধ্যমকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তারপর তাদেরকে উপহাস বা বিদ্রূপ করা হয়। সবশেষে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল বা ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা চলে।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২ বছরের শাসনামল বাদ দিলে, গত ৩৮ বছরের গণতন্ত্রের মাঝে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল। তাদের আগের ৫ বছরের শাসনামলসহ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের গত ৩৭ বছরের গণতন্ত্রের ১৮ বছরই দেশ শাসন করেছে। এত লম্বা সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতার আলোকে, আমরা তাদের থেকে সমালোচনার বিষয়ে পরিশীলিত প্রতিক্রিয়া বা আচরণ আশা করতে পারি নি।
মালিকদের প্রেক্ষাপটে, অল্প কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগই এই খাতের বিশেষায়িত প্রকৃতি অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের মালিকানায় থাকা অন্য অনেক কিছুর তুলনায় গণমাধ্যম যে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি প্রতিষ্ঠান, এই ব্যাপারটি প্রায়ই তাদের চিন্তায় থাকে না। প্রতিটি পণ্যের গুণগত মানের যেমন একটি সুনির্দিষ্ট নির্ণায়ক থাকে, তেমনি, গণমাধ্যমের গুণগত মান নির্ভর করে তার ‘বিশ্বাসযোগ্যতার’ ওপর। এই বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয় সরকার, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, সব ধরনের ক্ষমতার উৎস, যার মধ্যে গণমাধ্যম মালিকের নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও অন্তর্ভুক্ত—এসব বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা চর্চার ওপর।
অনেক মালিক গণমাধ্যমকে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচারযন্ত্র হিসেবে দেখেন এবং সাংবাদিকদের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে বিবেচনা করেন। নিঃসন্দেহে এসব মালিক ‘গণমাধ্যমকে’ স্বাধীন ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করেন না। তারা ভাবেন, এটি একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। যা তার অন্য প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল করে টিকিয়ে রাখা হবে। কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেওয়া হবে না। এমন গণমাধ্যম মালিকপক্ষ খুব সহজে তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী পরিচালনা করতে পারে। তাদের গণমাধ্যম সংজ্ঞায়িত হচ্ছে এভাবে যে, এই সহযোগী প্রতিষ্ঠান একই মালিকের অন্য ব্যবসার স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখবে এবং অনেক ক্ষেত্রে এই দায়িত্বের অংশ হিসেবে ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে।
সাংবাদিকদের বিভ্রান্তিও সমানভাবে ক্ষতিকর। ন্যায্যতার দাবিকে সমর্থন ও সামরিক, একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার পরও আমরা এখনো ‘অ্যাডভোকেসি’ সাংবাদিকতা ও ‘বস্তুনিষ্ঠ’ সাংবাদিকতার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারিনি। এখানে আমি ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ এবং ১৯৯১ থেকে এখন পর্যন্ত সময়কালকে পৃথক দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতে চাই।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ অংশে, সাংবাদিকতা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নিষ্ঠার সঙ্গে সংগ্রাম করেছে। যা পাকিস্তান আমলের সঙ্গে প্রায় অনেকটাই মিলে যায়। সেই ‘সংগ্রামে’ আমরা গণতন্ত্র, প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক নেতৃত্ব, জবাবদিহিতামূলক সরকার ব্যবস্থা এবং সব ধরনের স্বাধীনতার প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছি।
গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর, সাংবাদিকতা ‘পক্ষপাতমূলক’ অবস্থান থেকে ‘নিরপেক্ষতার’ দিকে সরে আসে এবং নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তারা যে সরকার গঠন করেন, তাদের কাজ দিয়ে বিচার করা হয়, উদ্দেশ্য দিয়ে নয়, তা যতই ন্যায়নিষ্ঠ হোক না কেন। আমাদের প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনিই হোন না কেন, সাংবদিকতার পেশাদারিত্ব আমাদের বাধ্য করেছে অন্যায়, দুর্নীতি, চাটুকারিতা এবং রাজনৈতিক দলাদলির বিরুদ্ধে কলম ধরতে। আগে দেশপ্রেম বলতে গণতন্ত্রের পক্ষে ও সামরিক শাসনের বিপক্ষে সংগ্রাম বোঝানো হতো।
আমার মতে, আমরা সাংবাদিক হিসেবে নিজ পেশার মৌলিক নীতিগুলো সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারিনি এবং পুরোনো পক্ষপাতমূলক মানসিকতাকে এর মধ্যে নিয়ে এসেছি। ফলে গণস্বার্থে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা বিকশিত হচ্ছে না। সমতার চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ও বৈষম্যহীন উন্নত এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংগ্রামে জনগণের নিরন্তর সহযোদ্ধা হিসেবে গণস্বার্থোর বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহ সাংবাদিকতা বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি। এই বিষয়টি আমাদের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক চাহিদা।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই