Tuesday 10 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বিজয়ের মাস

ড. মিহির কুমার রায়
৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৩:১৮ | আপডেট: ৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৫:০৫

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিষয়ক গ্রাফিক্যাল ছবি। সংগৃহীত

মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ অতিক্রান্তপ্রায়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে এ মাসের ১৬ তারিখে চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরবের অধ্যায় রচিত হয়। ৩০ লাখ শহীদ আর অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল এ বিজয়। তাই মহান এ মাস উদযাপনে জাতীয় কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে নেয়া হবে বিভিন্ন কর্মসূচি। বাঙালির সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঘটনা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্নসাধ পূরণ হয় এ মাসে।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর জল, আর আকাশপথে সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বর্বর পাকিস্তাানি হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর চারদিক থেকে ভেসে আসতে থাকে। এ মাসে সুদীর্ঘ ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা আর অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ৯ মাস যুদ্ধ করে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয় দামাল বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস ধ্বংসযজ্ঞ চালালেও ডিসেম্বরে এসে পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শেষ করে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে তৎপর হয়। তালিকা করে একে একে হত্যা করা হয় দেশের খ্যাতিমান শিক্ষক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের। তবে তা সত্ত্বেও তারা বাঙালিদের দামাতে পারে নি। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যেখান থেকে ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, ’ বলে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেখানেই পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করেন পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী। এর মধ্য দিয়ে রচিত হয় নতুন ইতিহাস। বাংলার আকাশে উদিত হয় নতুন সূর্য।

বিজ্ঞাপন

এখানে উল্লেখ্য যে, সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়ে ছিল অনেক আগেই যেমন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ইত্যাদি। আগেরদিন ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক শাসক নিরস্ত্র জনতার উপর আক্রমন শুরু করে এবং বাঙ্গালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে তাকে বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ জেলে আটক রাখা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয় এবং ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে সেই সরকার। পরে বৈদ্যনাথতলাকেই নামকরণ করা হয় মুজিবনগর হিসেবে। যে সরকারের প্রধান বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান এবং উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসনমন্ত্রী করে গঠন করা হয় স্বাধীন বাংলা সরকার। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী মুজব অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। এদিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও অনুমোদন হয়। আওয়ামী লীগের চীফ হুইপ দিনাজপুরের সংসদ সদস্য অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন এবং অস্থয়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান।

একাত্তরের ১৭ এপ্রিলের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্য নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সকাল ৯টার দিকে বৈদ্যনাথতলায় পৌঁছান। গ্রামবাসীর পাশাপাশি দেশী-বিদেশী শতাধিক সাংবাদিক আসেন। তাদের মধ্যে ছিলেন-ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক টালি ও পিটার হেস। বহু প্রতীক্ষিত শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয় বেলা ১১টায়। মেজর আবু উসমান চৌধুরীর পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়ায় ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দীন আহমেদ ইপিআর আনসারের একটি ছোট্ট দল নিয়ে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানান। অভিবাদন গ্রহণের পর স্থানীয় শিল্পীদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন, যা আকাশবাণী থেকে একাধিকবার প্রচারিত হয়। তাজউদ্দীনের ভাষণের মধ্য দিয়েই দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে।

এই পথপরিক্রমায় পরের দিন দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা এবং সংবাদমাধ্যমে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের এই সংবাদ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক সূচনা বা আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ হিসেবে দিনটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উল্লেখ্য যে নামেই বলি না কেন এই সরকারটি গঠিত হয়েছিল ১০ এপ্রিল, ১৯৭১, কলকাতায়। ওই সময়ে গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের যে কয়েকজন সদস্য কলকাতায় উপস্থিত ছিলেন তাদের সম্মতিতে শেখ মজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হয়েছিল যুদ্ধকালীন সরকার তথা মুজিবনগর সরকার। তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের তত্ত্বাবধানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রণয়ন করা হয়; যার আইনগত দিকগুলো ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ঠিক করে ঘোষণাপত্রটি চূড়ান্ত করেছিলেন। মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে ভারতীয় সৈন্যদের সকল ধরনের সমর্থন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারার ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় সৈন্যরা শুধু আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংই দেয়নি, যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিও প্রেরণ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের কৌশল হিসেবে সারাদেশকে কয়েকটি বাহিনী যেমন ৩টি পদাতিক ব্রিগেড, ৩টি আার্টিলারী ব্যাটারী; ১১টি সেক্টরে (১০,০০০ যোদ্ধা ভাগ), ব্রিগেড ও সেক্টর বর্হিভূত দল যেমন কাদের বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, আফসার বাহিনী ইত্যাদি (জনবল প্রায় ১০,০০০ যোদ্ধা) করা হয়েছিল এবং প্রতিটি সেক্টরের দায়িত্ব এক একজন কম্পানি কমান্ডারকে দেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কম্পানি ছিল সবছেয়ে বড় কোম্পানী। সে সময় মুক্তিযোদ্ধের সর্বধিনায়ক কর্ণেল এম.এ.জি. ওসমানীর নেতৃত্বে যখন সারাদেশ যখন উত্তাল তখন এই কাদেরীয়া বাহিনী টাঙ্গাইলের মধুপুর জঙ্গলে তাদের আবস্থান গেড়ে বসে এবং সেখান থেকে গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হয় যা ছিল বাংলাদেশের সবচাইতে আলোচিত ঘটনা।

আমার মুক্তিযোদ্ধের শরনার্থী জীবন, মেঘালয়ের এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়, তারপর শরনার্থী শীবিরে আশ্রয়, দুঃখ -কষ্ঠ-যন্ত্রনা, মুক্তিযোদ্ধের নয় মাসের বর্ণনা যা বলে শেষ করার মতো নয়। উল্লেখ্য বাংলাদেশ থেকে ১ কোটি শরনার্থী ভারতের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল যার মধ্যে ত্রিপুরার বিশ্রামগড় অন্যতম। ১৬ই ডিসেম্বর থেকে মিত্র বাহিনীর বিভিন্ন দল চারদিক থেকে এসে ঢাকা অবরোধ করতে থাকে এবং একইদিন মুক্তিবাহিনী যোদ্ধারা শহরের মধ্যে আগে থেকেই প্রবেশ কওর মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের সাথে মিলিত হয়। তার আগে ১৩/১৪ই ডিসেমম্বর রাতে জেনারেল নিয়াজী পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধানকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার অনুরোধ জানায়। তারপরপরি পাকিস্থানের জেনারেল নিয়াজীকে যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দেন। ভারতীয় বাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশকে ১৫ই ডিসেম্বরের মধ্যে যুদ্ধ বিরতির আবেদনের বিষয়টি জানানো হলে তিনি পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতি ও আত্মসমর্পণকে সহজ করার জন্য ১৫ই ডিসেম্বর বিকঅল ৫ টা থেকে পরের দিন বিকাল ৩ টা পর্যন্ত ভারতের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি ঘোষনা করেন। ১৬ই ডিসেম্বর ভোর বেলা লে. জেনারেল নিয়াজী তার অধিনস্থদের যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দেন। আত্মসমর্পণের সময় বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন গ্রুপ ক্যাপটেন এ কে খন্দকার, লে.কর্নেল সফিউল্লাহ, মেজরটি.এম হায়দার এবং কাদিরীয়া বাহিনীর কমান্ডার কাদের সিদ্দিকী। বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে দুই পক্ষের মরধ্র আত্মসমর্পনের দলিল সই হয়। শেষ হয় ৯ মাসের পাকিস্থানীদের দখলদারিত্ব, জন্ম নেয় নতুন দেশ বাংলাদেশ।

লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক

সারাবাংলা/এসবিডিই

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর