মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে নড়িয়া উপজেলা
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৮:৩৫
।। এম এ কে জিলানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
নড়িয়া থেকে ফিরে: প্রমত্তা পদ্মার ভয়াল থাবা গত মধ্য অগস্ট থেকে কেড়ে নিতে শুরু করেছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উত্তর ও পূর্ব-পশ্চিমের কয়েক কিলোমিটার এলাকার সড়ক, বসত-ভিটা, বাজার, দোকান-পাটসহ কয়েক হাজার অবকাঠামো।
গত রোববার (৯ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১টা ১৭ মিনিটে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেল, উত্তর দিকের মসজিদ, একাধিক ওষুধের দোকানসহ সামনে থাকা অবকাঠামোর সবকিছুই গ্রাস করেছে পদ্মা। কয়েকটি ভাঙা দেয়াল আর কৃষ্ণচূড়া ও হরিতকি গাছের সঙ্গে মিতালি করেছে পদ্মার ঢেউ। হরিতকি গাছে ঝুলছিল ডা. আকরামের বিজ্ঞাপন, বাঁকা হয়ে দেয়াল আকড়ে ছিল ডা. কামরুলেরসহ একাধিক বিজ্ঞাপন।
ঠিক ১ ঘণ্টা পর ২টা ১৭ মিনিটে (৯ সেপ্টেম্বর) ভাঙা মসজিদের কিছু অংশ, আগের ভাঙা দেয়াল, কৃষ্ণচূড়া ও হরিতকি গাছসহ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কিছু অংশ বুকে টেনে নেয় উত্তাল পদ্মা। এভাবেই নড়িয়াকে গিলছে ভয়ঙ্কর পদ্মার থাবা।
গত রোববার (৯ সেপ্টেম্বর) নড়িয়া উপজেলা সরেজমিন ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পদ্মার সর্বনাশা থাবা নড়িয়া উপজেলাকে এমনভাবে গ্রাস করছে যে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে প্রাণচঞ্চল এই জনপদটির।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলাকে বিগত কয়েক বছর ধরেই গ্রাস করছে পদ্মা। গত দুএক সপ্তাহ ধরে এই উপজেলায় পদ্মার ভাঙন আরও ভয়ঙ্কর রুপ নিয়েছে। যেভাবে ভাঙন চলছে তাতে এখনই উদ্যোগ না নিলে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে নড়িয়া।
স্থানীয় বাসিন্দা ইকবাল মাঝি (বয়স ৪০) সারাবাংলাকে বলেন, ‘নড়িয়া বাজার থেকে মুলফৎগঞ্জ পর্যন্ত সড়কটি এখন পদ্মা নদীর নীচে। এই সড়কের উত্তরে কোর্টঘর বাজার, ওয়াপদা বাশতলা, সাহেবের চরসহ একাধিক জনপদ পদ্মার আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’
পূর্ব নড়িয়ার স্থানীয় বাসিন্দা আনিস উদ্দিন সরদার (বয়স ৭০) সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক সপ্তাহের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে দাসপাড়া, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসানালয়সহ কয়েকশ বছরের পুরানো মন্দির।’
শেহের আলীর স্থানীয় বাসিন্দা রশিদ মোল্লা (বয়স ৭৫) বলেন, ‘শেহের আলীর সড়ক থেকে কলমির চর দিয়ে জাজিরা পৌরসভার শফি গাজীর মোড় পর্যন্ত আড়াই মাইল সড়ক চলে গেছে নদী গর্ভে। নড়িয়ার প্রায় ৪০টি মসজিদসহ মানুষের বসত-ভিটা কেড়ে নিয়েছে পদ্মা। শেহের আলী গ্রামের উত্তরে প্রায় ২ মাইলজুড়ে মানুষের জনবসতি ছিল। এখন কিছুই নেই। ভাঙতে ভাঙতে বিলিন হয়ে গেছে শেহেরআলী সড়কও। যে কোনো সময় এই জায়গাও (শেহেরআলী) চলে যাবে।’
নড়িয়া পৌরসভার মেয়র মো. শহিদুল ইসলাম বাবু সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভাঙনের এখন যে অবস্থা চলছে তা চলমান থাকলে আগামী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে নড়িয়া পৌরসভা মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। পৌর ভবন, পৌর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও পদ্মার পানি চলে এসেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরই মধ্যে নড়িয়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ৭০ শতাংশ এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৯০ শতাংশ পদ্মার ভাঙনে শিকার হয়ে নদী গর্ভে হারিয়ে গেছে। স্কুল, মসজিদ, দালান-কোঠাসহ প্রায় ৮০টির মতো অবকাঠামো নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। পৌরসভার বাশতলা বাজার এবং পূর্ব নড়িয়া বাজারও হারিয়ে যাওয়ার পথে।’
নড়িয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম ইসমাইল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘চলমান ভাঙনের কারণ নদী বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। তবে আমার মতে, নদী শাসনের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়াতে নড়িয়াবাসি ভাঙনের শিকার হচ্ছেন। সময়মতো এবং পরিকল্পনামাফিক নদী খনন না করাও ভাঙনের অন্যতম কারণ। এ ছাড়া এই নদীতেই পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ চলছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণও ভাঙণের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে।’
ভাঙনের ফলে ৪ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হারিয়েছে তাদের বসত-ভিটা, প্রায় ৮ কিলোমিটার সড়ক এখন পানির নিচে চলে গেছে উল্লেখ করে উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, ‘নড়িয়াতে ৩ থেকে ৪ ধরেই ভাঙন চলছে। তবে এবারের ভাঙন যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়ঙ্কর। এই উপজেলার মুক্তারের চর ইউনিয়নের ৩টা ওয়ার্ড এবং কেদারপুর ইউনিয়নের ৪টা ওয়ার্ড এরই মধ্যে পদ্মার গর্ভে হারিয়ে গেছে। পৌরসভার বাজারের ৪০টি দোকান চলে গেছে বানের পেটে।’
পৌর ভবন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নড়িয়া বাজার এবং হাইস্কুল ভবন এখন ভাঙনের হুমকির মুখে জানিয়ে ইসমাইল হক বলেন, ‘যে কোনো সময় এগুলো পদ্মার গ্রাসে পরিণত হতে পারে। সামনে কী যে হবে বলা মুশকিল।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াছমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভাঙন থেকে নড়িয়া উপজেলাকে বাচাতে প্রাথমিকভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডর মাধ্যমে ৭ কোটি টাকার মাটির বস্তা ফেলা হচ্ছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে বা স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধ করতে এখনো কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি।’
সারাবাংলা/জেআইএল/এমআই