ডেঙ্গুতে বেড়েই চলছে মৃত্যুর সংখ্যা
৪ নভেম্বর ২০১৮ ০৮:১৭
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: বিগত বছরগুলোর মধ্যে ২০০২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিলো সর্বোচ্চ সংখ্যক ৬ হাজার ২৩২ জন। অপরদিকে, চলতি বছরের শুরু থেকে আজ শনিবার (৩ নভেম্বর) পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬৩৩ জন। এদের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন ৮ হাজার ৪৩৭ জন, আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের। বাকিরা এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু মৌসুম শেষ হতে এখনও কয়েক মাস বাকি। সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। যদিও বৃষ্টি মৌসুম শেষ হয়ে শীত মৌসুমের শুরু হয়েছে।
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ডেঙ্গু প্রকোপ অঞ্চলে বাংলাদেশসহ ভারত, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যাণ্ড, পূর্ব তিমুর ও উত্তর কোরিয়া রয়েছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মানুষ এই অঞ্চলে বসবাস করে। দ্রুত নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই অঞ্চলে এই দু’টি রোগ ছাড়াও কীটবাহিত অন্যান্য রোগের ঝুঁকিও বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে কোনো মৃত্যু না হলেও বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৫, মিটফোর্ড হাসপাতালে ২৭, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৪, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ১১, বারডেম হাসপাতালে ১৩, পিলখানার বিজিবি হাসপাতাল ৩ জনসহ ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ১৭৪ জন ভর্তি রয়েছেন।
তবে একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, এবারে ডেঙ্গুর প্রকোপে মৃত্যুর ঘটনা আরও ঘটেছে। সব মৃত্যুর খবর স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমে রিপোর্ট হয়নি। হাসপাতালগুলো থেকেও সেসব সংবাদ আসেনি। প্রকৃত তথ্য পেলে মৃত্যুর সংখ্যায় আরও যোগ হতো।
চলতি বছরের গত ৯ জুন প্রথম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ৩৪ বছরের ফারজানা আক্তার নামের ওই রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন ৭ জুন। সে মাসেই ৩১ বছরের রোজলিন বৈদ্য এবং ২৬ বছরের সেঁজুতি নামে আরও দু’জন মারা যান।
জুলাইতে এক বছর সাত মাসের আরইয়ান, আট বছরের হিমু, নয় বছরের তাহমিদ এবং বারডেম হাসপাতালে কর্তব্যরত ২৭ বছরের ডা. ফয়সাল বিল্লাহ মারা যান।
এর পরের মাস আগস্টে ৫৫ বছরের মৃদুলা বেগম, দুই বছরের শ্রেষ্ঠা ঘোষ, পাঁচ বছরের আমিনা, ১২ বছরের তাহজীব খান, ৪৯ বছরের মাকসুদা বেগম, ৫ বছরের আরাফাত ইসলাম মারা যায়।
সেপ্টেম্বরে মারা যান ৪০ বছরের আর্জিনা বেগম, দুই বছরের সাফায়াত এবং তিন বছর বয়সী সুমাইয়া। অক্টোবরে মারা যায় ১ বছর ৫ মাস বয়সী হাফিজ, ৪০ বছর বয়সী মালতি নাগ, ৩২ বছরের মাহমুদা আক্তার রিতা, ৪৮ বছরের রেহানা আক্তার এবং ১১ বছরের আফরিন হক বৃষ্টি।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে চারটায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ওয়ান ব্যাংকের ফার্স্ট অ্যাসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মিজানুর রহমান। যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে বলা হচ্ছে, তারা এখনও মিজানুর রহমানের মৃত্যুর বিষয়ে কনফার্ম রিপোর্ট পাননি, হাসপাতাল থেকে তার সব ধরনের ইনভেস্টিগেশন রিপোর্টসহ অন্যান্য কাগজপত্র হাতে পেলেই তারা নিশ্চয়তা দেবেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে দেওয়া উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরে ডেঙ্গু জ্বর, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ও হেমোরেজিক শকে আক্রান্ত হয়ে নারী ও শিশুদের মৃত্যুই হয়েছে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানায়, দেশে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায় ২০০০ সালে। সে বছরে রেকর্ড সংখ্যক ৯৩ জন রোগী মারা যান। সেবার মোট রোগী ছিলেন ৫ হাজার ৫৫১ জন। ২০০১ সালে দুই হাজার ৪৩০ জন রোগীর মধ্যে মারা যান ৪৪ জন রোগী, ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২ জন রোগীর মধ্যে মারা যান ৫৮ জন, ২০০৩ সালে ৪৮৬ জন রোগীর মধ্যে মারা যান ১০ জন, ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৪৩৪ জন রোগীর মধ্যে মারা যান ১৩ জন, ২০০৫ সালে ১ হাজার ৪৮ জন রোগীর মধ্যে মারা যান ৪ জন, ২০০৬ সালে মারা যান ১১ জন, রোগী ছিলেন দুই হাজার ২০০ জন, ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কেউ মারা না গেলেও রোগী সংখ্যা ছিলেন যথাক্রমে ৪৬৬ জন, এক হাজার ১৫৩ জন, ৪৭৪ জন এবং ৪০৯ জন। তবে তার পরের বছর থেকেই আবারও মৃত্যু শুরু হয়।
এছাড়া ২০১১ সালে মারা যান ৬ জন, রোগী ছিলেন এক হাজার ৩৫৯ জন, ২০১২ সালে মারা যান একজন, রোগী ছিলেন ৬৭১ জন। ২০১৩ সালে মারা যান ২ জন, রোগী ছিলেন এক হাজার ৭৪৯ জন। আবার ২০১৪ সালে কেউ মারা না গেলেও রোগী ছিলেন ৩৭৫ জন। ২০১৫ সালে মারা যান ৬ জন, রোগী ছিলেন ৩ হাজার ১৬২ জন। ২০১৬ সালে মারা যান ১৪ জন, রোগী ছিলেন ছয় হাজার ৬০ জন এবং গত বছরে মারা যান ৮ জন এবং রোগী সংখ্যা ছিলেন দুই হাজার ৭৬৯ জন।
চলতি বছরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা রেকর্ড ছাড়াবার কারণ জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘চলতি বছরে ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। একইসঙ্গে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহিত এডিস মশার প্রজনন হয়েছে বেশি। বছরের মাঝামাঝিতে বৃষ্টি হয়েছে আর বৃষ্টি হলেই যে কোনো পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এক ডিম থেকে লার্ভা হয় হাজার হাজার এবং সেখান থেকে এডিস মশার জন্ম হয়।’
‘বিক্ষিপ্তভাবে যেখানে পানি জমা হয়েছে সেখানেই এডিস মশার জন্ম হয়েছে। কিন্তু পানি যদি ভেসে যাবার মতো পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকতো তাহলে এতো মশার জন্ম হতো না। আবার এসব মশা ঘরে ঢোকে। ফুলের টবে, ছাদের বাগানের পানিতেও এ মশা জন্মায়। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় এডিস মশার প্রজনন বেড়েছে। এমনকি বিভিন্ন সড়কের আইল্যান্ডেও পানি জমে থাকে, সেখানেও মশার জন্ম হচ্ছে। ফলে এডিশ মশার বংশ বিস্তার বেশি হওয়াতে এবারে ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপক হারে হয়েছে’, বলেন অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ।
ডেঙ্গু রোগের বিভিন্ন ধাপ সম্পর্কে আইইডিসিআরের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমবার ডেঙ্গু জ্বর হলে তাকে কেবল ডেঙ্গু জ্বরই বলা হয়, যেখানে জ্বরের সঙ্গে শরীর ব্যাথা হবে আবার সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রক্তপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তখন তাকে বলা হয় হেমোরেজিক শক। আর জ্বরের সঙ্গে রক্তপাত হওয়ার পরও যদি সময়মতো চিকিৎসা না দেওয়া হয় এবং প্লাটিলেট অনেক কমে যায়, তখন তাকে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম বলা হয়ে থাকে।’
জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম উল্লেখ করে ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘থেমে থেমে হতে থাকা বৃষ্টিটা না কমলে ডেঙ্গুও কমবে না। ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম থাকলেও শীত শুরু হয়ে গেলে কমতে থাকবে এর প্রকোপ।’ তবে এ জন্য সবাইকে সচেতন এবং সাবধান হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘কীটপতঙ্গবাহিত রোগের ঝুঁকি বেড়েছে, এর প্রমাণ চলতি বছরগুলোতে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ। জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এ প্রকোপ আরো বেড়ে গিয়েছে। এ জন্য ঘরের ভেতরে যেন পানি না জমে সেজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।’
সারাবাংলা/জেএ/এমও